পাঁচ কারণে এবার হালদা থেকে রুই জাতীয় মাছের রেকর্ড পরিমাণের ডিম পাওয়া গেছে। এ বছর ১৪ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করেছেন আহরণকারীরা। যা গত বছরের তুলনায় ৮ গুণের বেশি। গত ২০২৪ সালে হালদা থেকে ডিম সংগ্রহ করা গেছে মাত্র এক হাজার ৬৮০ কেজি। বর্তমানে ডিমগুলো হ্যাচারিতে রেণু ফোটানোর জন্য ব্যস্ত রয়েছেন আহরণকারীরা।
মূলত প্রত্যেক স্টেক হোল্ডারের সক্রিয় অংশগ্রহণে সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনায় সফলভাবে পরিচালনা, মা মাছ রক্ষায় মৎস্য অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন ও নৌ-পুলিশের সমন্বয়ে ব্যাপক অভিযান, যথাসময়ে রাবারড্যামের পানি ছেড়ে দেওয়া, পর্যাপ্ত বৃষ্টি ও যথাসময়ে উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামা এবং আমাবস্যার ‘জো’ থাকা- এ পাঁচ কারণে এবার প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদায় বেশি ডিম দিয়েছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, হালদা বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট ডিম সংগ্রহকারীরা।
গত বছর ২০২৪ সালে কাক্সিক্ষত ডিম মেলেনি হালদায়। মাত্র এক হাজার ৬৮০ কেজি রুই জাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) মাছের ডিম পায় আহরণকারীরা। তাতে এ বছরও হালদায় ডিম ছাড়া নিয়ে আশা ও শঙ্কার দোলাচলের মধ্যে ছিলেন ডিম সংগ্রহকারীরা। ডিমের আশায় গত মাসাধিকাল ধরে আমাবস্যা ও পূর্ণিমায় দফায় দফা হালদায় অবস্থান করেও ডিম না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েন তারা। এ সময়ে কাক্সিক্ষত বৃষ্টি ও উজান থেকে পাহাড়ি ঢল না নামায় ডিম ছাড়েনি রুই জাতীয় মাছ। শুধু দুই দফায় ‘নমুনা’ ডিম ছাড়ে মা মাছ। অবশেষে দীর্ঘ এক মাস পর সেই কাক্সিক্ষত দিনটি আসে গত ২৯ মে মধ্যরাতের পর। রাত ২টার দিকে হালদা থেকে ডিম আহরণ শুরু করে সংগ্রহকারীরা।
এর আগে ব্যাপক বৃষ্টির ফলে উজান থেকে নেমে আসে পাহাড়ি ঢল। তাতে ডিম সংগ্রহকারীরা মধ্যরাতের পর ডিম ধরার উৎসবে মেতে ওঠেন। হালদার দুই তীর রাউজান ও হাটহাজারীর মানুষের মধ্যে বয়ে যায় আনন্দ। অন্যান্য বছরের তুলনায় হালদায় রেকর্ড পরিমাণ বেশি ডিম পাওয়া গেছে। তাতে ঘুচে গেছে ডিমসংগ্রহকারীদের এক মাসের ক্লান্তি। এখন সবাই হ্যাচারি ও মাটির কুয়াতে ডিম থেকে রেণু ফোটাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। হালদার ডিম সংগ্রহকারী হাটহাজারী গড়দুয়ারা এলাকার বাসিন্দা কামাল উদ্দিন সওদাগর পূর্বকোণকে বলেন, এবার তিনি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ডিম পেয়েছেন। ১০ নৌকায় তিনি প্রায় ৩৭ বালতি অর্থাৎ ৩৭০ কেজি ডিম পান। যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর প্রফেসর ড. মো.মনজুরুল কিবরীয়া পূর্বকোণকে বলেন, এবার পাঁচ কারণে হালদায় রেকর্ড পরিমাণ ডিম ছেড়েছে রুই জাতীয় মাছ। তাতে খুশি ডিম সংগ্রহকারীরা। হালদাতে এবার প্রায় ২৫০ নৌকায় ৫৫০ জন সংগ্রহকারী ডিম আহরণ করে। ডিম পাওয়া গেছে ১৪ হাজার কেজি।
এদিকে হালদার পরিবেশ, মা মাছ রক্ষাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে সম্পৃক্ত বেসরকারী সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউণ্ডেশন (আইডিএফ)। এ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক জহিরুল আলম পূর্বকোণকে বলেন, সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় হালদায় এবার রেকর্ড পরিমাণ ডিম পাওয়া গেছে। হালদায় দীর্ঘদিন ধরে আইডিএফ নানা উন্নয়নমুখী কাজ করে যাচ্ছে। এমনকি মা মাছ রক্ষায় প্রশাসনকে লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে।
হালদা প্রকল্প পরিচালক মুহাম্মদ মিজানুর রহমান পূর্বকোণকে বলেন, হালদার মা মাছ সুরক্ষায় প্রকল্প থেকে ৩৯ জন পাহারাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা রাতদিন হালদা পাহারায় থাকেন। এছাড়া হালদার স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে দফায় দফায় সচেতনতামূলক সভা করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিদিন নিরবচ্ছিন্নভাবে হালদা মনিটরিং করা হয়। এছাড়া মৎস্য অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন ও নৌ পুলিশের প্রতিনিয়ত যৌথ অভিযানের ফলে মা মাছ সুরক্ষা থাকায় এবার পর্যাপ্ত ডিম পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অফিসার শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ পূর্বকোণকে বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর, চবি গবেষকসহ সকলের সমন্বিত প্রয়াসে হালদায় এবার ব্যাপক কর্মকাণ্ড চালানো হয়েছে। অবৈধ মাছ শিকারির বিরুদ্ধে দিনরাত চালানো হয়েছে মোবাইল কোর্ট। ভূজপুরের রাবারড্যাম আগেভাগে ডাউন করা হয়েছে। প্রকৃতিও ছিল অনুকূলে। তাই হালদায় এবার প্রচুর ডিম পাওয়া গেছে। বর্তমানে নদীর দুই তীরে উৎসবের আমেজ চলছে। হালদা থেকে আহরিত ডিম নদীর দুই পাড়ে নির্মাণকৃত রাউজান ও হাটহাজারীর সরকারি হ্যাচারিগুলোতে রেণু ফোটানোর কাজ চলছে।
পূর্বকোণ/ইবনুর