চট্টগ্রাম শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫

সর্বশেষ:

উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি : লোকসান-ধারদেনায় মৃতপ্রায়
লোকসানে জরাজীর্ণ দশা উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরির

উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি : লোকসান-ধারদেনায় মৃতপ্রায়

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২২ মে, ২০২৫ | ১১:৫০ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বায়নের যুগে কাচ বা গ্লাসশিল্পের বাজার খুবই রমরমা। ক্রমবর্ধমান চাহিদায় বড় হয়েছে কাচশিল্পের বাজার। সংযোজন হচ্ছে নতুন প্রযুক্তির মেশিন। কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি ৬৬ বছরের পুরোনো রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি। জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা দেশের প্রথম কাচ উৎপাদনকারী কারখানাটি টানা লোকসানে মরণাপন্ন।

 

কর্মকর্তারা জানান, ৬৬ বছরের পুরোনো জরাজীর্ণ কারখানা এখন মৃতপ্রায়। ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে। এর আগে ২০২০ সালেও অগ্নিকাণ্ডের কারণে ১৫ মাস উৎপাদন বন্ধ ছিল। ওই সময়ে জোড়াতালি দিয়ে লাইফ সাপোর্ট থেকে টেনে তোলা হয়েছিল।

 

কারখানার জিএম (অর্থ) আবদুল মজিদ পূর্বকোণকে বলেন, সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে আমরা সেভাবে কাজ করবো।

 

প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থ বছর থেকে টানা লোকসান গুনে আসছে এ প্রতিষ্ঠানটি। অথচ দেশ-বিদেশে কাচের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। লাভজনক এ শিল্পের বাজার প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে। শুধু ধুঁকছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত গ্লাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি লিমিটেড’।

 

১৯৫৯ সালে কালুরঘাটে উসমানিয়া গ্লাস শিট কারখানায় সাদা রঙের গ্লাস শিট উৎপাদন শুরু হয়। এর মাধ্যমে দেশে কাচশিল্পের গোড়াপত্তন ঘটে। বেসরকারি মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা হয়। একসময় দেশে গ্লাস সরবরাহের অন্যতম ভরসা ছিল এই প্রতিষ্ঠান। শুরুতে বেশ লাভজনক ছিল। নব্বই দশকের পর থেকে অনিয়ম-অবহেলাসহ নানা কারণে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

 

কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বলেন, নীতিনির্ধারকদের দীর্ঘ অবহেলার শিকার হয়ে আসছে কারখানাটি। পুরোনো প্রযুক্তি ও জরাজীর্ণ যন্ত্রপাতি দিয়ে উৎপাদন টিকিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ ৯০-দশকের পর কাচশিল্পে দেশ-বিদেশে অত্যাধুনিক মেশিনের সংযোজন হয়েছে। অবহেলার কারণে আধুনিক ও যুগোপযোগী মেশিন না থাকায় ধুঁকছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া বাজারের অসম প্রতিযোগিতা, কাঁচামাল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি এবং পুরোনো ধাঁচের গ্লাসের চাহিদা কমে যাওয়ায় ক্রমান্বয়ে উসমানিয়া গ্লাস লোকসানের মুখে পড়ে। বছর ঘুরলেই লোকসান ও ঋণের বোঝা বাড়ছে।

 

জিএম (অর্থ) আবদুল মজিদ বলেন, বর্তমানে বিসিআইসি থেকে ধারদেনা ও ঋণ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কোটি টাকার ঋণ হয়েছে।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৭ কর্মকর্তা, ১৮ কর্মচারী ও শ্রমিক মিলে শতাধিক জনবল রয়েছে। প্রতিমাসে তাদের বেতন গুনতে হয় ৪০ লাখ টাকার মতো। কারখানা বন্ধ থাকায় ২০ মাস ধরে বিসিআইসি ঋণ হিসেবে এসব টাকার জোগান দিচ্ছে।

 

উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি হাফিজ উদ্দিন বলেন, ক্রমাগত লোকসানের কারণে ওভার টাইম, লভ্যাংশ ও অন্যান্য ভাতা-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রমিকেরা। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শ্রমিকেরাও ধুঁকছে অর্থ-কষ্টে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা (শ্রমিক) বসে বসে বেতন নিতে চাই না। কাজ করে খেতে চাই। প্রতিষ্ঠানটি চালু করা হোক, না হলে বিসিআইসির অন্য কারখানায় আমাদের একীভূত করার জন্য আমরা প্রধান উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত চিঠি দিয়েছি।

 

১৯৮৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটি পুরোনো প্রযুক্তির কারখানা, নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতা ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে ধীরে ধীরে রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ক্রমাগত লোকসান গুনলেও নতুন কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। এ অবস্থা চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে দেউলিয়া হয়ে পড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন কর্মকর্তা ও শ্রমিকেরা।

 

শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী বলেন, ৬০ বছরের বেশি পুরোনো মেশিনগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এখন অচল-অকেজো হয়ে পড়েছে। তা দিয়ে আর উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব নয়। নতুন ও আধুনিক মেশিন বসাতে হবে। উন্নত প্রযুক্তির মেশিনারিজ স্থাপন না করলে কারখানা ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে।

 

এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী কনটেইনার গ্লাসের চাহিদা বিবেচনায় উসমানিয়ার জায়গায় সম্পূর্ণ নতুন কনটেইনার গ্লাস প্ল্যান্ট স্থাপনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।

 

ক্রমাগত লোকসান :

কারখানার বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ২০১৩-২০১৪ সালে লোকসান হয় ৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের লোকসানের পরিমাণ ছিল এক কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের শুরুতে কোম্পানির তহবিলে জমা ছিল ৪৬১৩ দশমিক ৩৩ লাখ টাকা। উৎপাদন কমে যাওয়া ও সরকারের শেয়ার, করসহ সরকারি কোষাগারে টাকা পরিশোধের পর তহবিল দাঁড়ায় ৩৮৮১ দশমিক ৭০ লাখ টাকা। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

২০১৫-১৬ অর্থবছরে লোকসান হয়েছে সাত কোটি ৯১ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সাত কোটি ৮৮ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এভাবে ক্রমাগত লোকসান বেড়েই চলেছে।

 

২০২৩-২৪ অর্থবছরের লোকসান গুনেছে ১২ কোটি এক লাখ টাকা। এর আগের বছরের (২০২২-২৩ অর্থবছরের) লোকসানের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের লোকসানের পরিমাণ ছিল চার কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরের ১০ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের লোকসান গুনেছিল ১২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০ কোটি ৮২ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট