স্বাধীনতার আগে চট্টগ্রামে ট্যানারিশিল্প ছিল ৩০ টি। স্বাধীনের পরও ২২টি জিইয়ে ছিল। ৮০-৯০ এর দশকের পর ধুঁকে ধুঁকে সবকটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে একটি ট্যানারি চালু রয়েছে। নতুন বিনিয়োগ না থাকায় খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে বিপুল সম্ভাবনার এই খাতটি।
চামড়াশিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রামে চামড়াশিল্প অঞ্চল গড়ে তোলার দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু কোনো সরকার সম্ভাবনাময় এ শিল্পের গৌরব পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেয়নি। চট্টগ্রামে একাধিক শিল্পাঞ্চল ও দেশি-বিদেশি বড় বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ থাকলেও এগোয়নি এ খাত।
ট্যানারি ও ব্যবসায়ীরা জানান, বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকায় ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বে জুতা তৈরির বড় ব্র্যান্ড বা ক্রেতারা চামড়া কেনেন না। চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এলডব্লিউজি সনদ গুরুত্বপূর্ণ। বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও চামড়াশিল্পের কমপ্লায়েন্স (দূষণমুক্ত ও উন্নত কর্মপরিবেশ) অর্জন করতে না পারায় এ শিল্পের পথচলা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এলডব্লিউজি কী? ২০০৫ সালে নাইকি, এডিডাস ও টিম্বারল্যান্ডের মতো কয়েকটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও জুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মিলে এলডব্লিউজি গঠন করে। পরিবেশ সুরক্ষায় জোর দিয়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদন নিশ্চিত করাই সংস্থাটির লক্ষ্য। বর্তমানে বিশ্বে এক হাজারের বেশি ব্র্যান্ড ও সরবরাহ খাতের প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজির সদস্য। সংস্থাটি কারখানা পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, ক্ষতিকর উপাদান, বর্জ্য পরিশোধন, কাঁচামালের উৎস ইত্যাদি বিষয় খতিয়ে দেখে। ইউরোপের বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলো এই সনদধারী প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কারখানা থেকে চামড়া বা চামড়াজাত পণ্য কেনে না।
ট্যানারিমালিকদের দাবি, লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকলে ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে চামড়া রপ্তানি করা যায় না। তাই বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত চামড়া বিক্রির ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হচ্ছে চীনের ওপর। এ সনদ না থাকার কারণে চামড়ার বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের (বিটিএ) তথ্য অনুসারে, এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় বাংলাদেশ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বছরে অন্তত ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি মার্কিন ডলার আয় হারাচ্ছে।
১৯৮৬ সাল থেকে চট্টগ্রামে ট্যানারিশিল্পের ব্যবসা করে আসছেন হাজি আবু মোহাম্মদ। মদিনা, তিতাস ও চিটাগাং ট্যানারি নামে তিনি চামড়াপ্রক্রিয়াজাত কারখানা ছিল তাঁর। দীর্ঘদিন ধরে সবকটি ট্যানারি বন্ধ। আবু মোহাম্মদ বলেন, আমেরিকা, স্পেন, ইতালি, জাপান, কোরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা চামড়া রপ্তানি করতাম। পরিবেশ দূষণের নামে গত সরকারের কয়েকটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে চামড়াশিল্প ধ্বংস হয়েছে। নতুন করে সেই বাজার সৃষ্টি করা এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রামে ট্যানারিশিল্পে সবেধন নীলমনি হচ্ছে রিফ লেদার লিমিটেড। বড় শিল্প গ্রুপ টি কে গ্রুপের এ সহযোগী প্রতিষ্ঠানটি কালুরঘাট শিল্পাঞ্চলে ১৯৯১ সালে স্থাপন করা হয়। কাঁচা চামড়া থেকে ফিনিশড পর্যন্ত কমপ্লায়েন্স মেনে তৈরি করা হয়। দেশে সাতটি এলডব্লিউজির সনদ পাওয়া ট্যানারির মধ্যে একটি হচ্ছে রিফ লেদার। এলডব্লিউজির সনদ থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও জুতা রপ্তানি করে আসছে এ প্রতিষ্ঠানটি।
রিফ লেদারের পরিচালক মোখলেছুর রহমান পূর্বকোণকে বলেন, চট্টগ্রামে বিভিন্ন খাতে বড় বড় শিল্প গ্রুপের বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু চামড়াশিল্পে না থাকাটা দুঃখজনক।
পরিবেশগত সমস্যার কারণে এ শিল্প নিয়ে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বের নামকরা ব্র্যান্ড ও চামড়াজাত পণ্য কোম্পানিগুলো এখন কিছুটা পরিবর্তন আনছে। ৮০ শতাংশ সিনথেটিকের সঙ্গে ২০ শতাংশ চামড়া ব্যবহার করছে। একই সঙ্গে দেশীয় বাজারেও চামড়ার ব্যবহার বাড়ানো গেলে চামড়াশিল্পের সুদিন ফিরবে বলে আশা করছি।
চট্টগ্রামে দুটি বড় শিল্প জোনে দেশি-বিদেশি বড় বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগ নেই এ খাতে। কোরিয়ান ইপিজেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক মুশফিকুর রহমান বলেন, দেশি-বিদেশি কোন কোম্পানি চামড়াশিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে আমরা সহায়তা দেবো।
চট্টগ্রামের চামড়াশিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। মিরসরাই শিল্পাঞ্চলে চামড়াশিল্প জোন গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতিও ছিল। কিন্তু দেশি-বিদেশি কোন উদ্যোক্তা এগিয়ে আসেনি।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তাদার-ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন পূর্বকোণকে বলেন, চট্টগ্রামে চামড়াশিল্পের বড় বাজার ছিল। ৮৫-৯০ দশকের পর ধীরে ধীরে সবকটি ট্যানারি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে সংকটাপন্ন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। এই শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ট্যানারিশিল্প অঞ্চল গড়ে তোলার দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু কোনো সরকার আমলে নেয়নি।
ঢাকানির্ভরতায় দেউলিয়ার পথে ব্যবসায়ীরা:
স্বাধীনতার ৫৪ বছরে একে একে বন্ধ হয়ে গেছে চট্টগ্রামের ২২টি ট্যানারি। এরফলে চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসা ঢাকানির্ভর হয়ে পড়েছে। ঢাকার ট্যানারি মালিকদের একচেটিয়া ও মর্জিমাফিক ব্যবসার কারণে সংকটে পড়েছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। ২০১৫ সাল থেকে চামড়া ব্যবসার আকাশে কালো মেঘ দেখা দেয়। ২০১৫-১৮ সাল পর্যন্ত ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে প্রায় ২৫ কোটি টাকার বকেয়া আটকে রয়েছে। পুঁজি হারিয়ে অনেক ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছেন।
দেউলিয়া হয়ে পড়া এক ব্যবসায়ী হলেন বোয়ালখালীর মো. সামশুল আলম। বাবা আহমদ হোসেন ৪৯ বছর ধরে এ ব্যবসা করেছিলেন। ২০২০ সালে মারা যান তার বাবা। গতকাল সামশুল আলম বলেন, ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকার বকেয়া পাচ্ছেন না আট বছর ধরে। এছাড়া ২০২২ সালে ৩৮ লাখ টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। সবমিলে ধার-দেনা ও ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে আর দাঁড়াতে পারিনি। পুঁজি হারিয়ে তার মতো অন্তত দুই শতাধিক ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
আড়তদার সমিতির সভাপতি মুসলিম উদ্দিন বলেন, ২৫০-৩০০ আড়তদার-ব্যবসায়ী থেকে কমে এখন ২৫-৩০ জনে ঠেকেছে। অন্যরা পুঁজি হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছেন।
পূর্বকোণ/ইব