চট্টগ্রাম সোমবার, ২৪ মার্চ, ২০২৫

সর্বশেষ:

“হানাদারদের সাথে সাঙ্গু নদীর এপার-ওপার ৩ দিন যুদ্ধ হয়”

নিজস্ব সংবাদদাতা, লোহাগাড়া

১৩ মার্চ, ২০২৫ | ১:৩৪ অপরাহ্ণ

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে বর্তমান লোহাগাড়া উপজেলা সদর বটতলী মোটর স্টেশনে বিমান হামলার পর তারা জনপদের বিভিন্ন এলাকায় ঢুকে পড়ে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর একের পর এক বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে নিরীহ লোকজনকে হত্যা করে এবং বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেয়। পরে লুটপাতের তাণ্ডব চালিয়ে মহিলাদের নির্যাতন করে। এমন ভয়াল মুহূর্তে দেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবনের মায়া ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম।

 

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে লোহাগাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফিজুর রহমান চৌধুরী এসব তথ্য তুলে ধরেন। তিনি এই উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের মল্লিক ছোয়াং চৌধুরী পাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের রণাঙ্গণে তিনি বান্দরবান, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

 

মোস্তফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, পাঁচজন সফরসঙ্গী নিয়ে রাতের অন্ধকারে পার্শ্ববর্তী চরম্বা ইউনিয়ন সংলগ্ন পার্বত্য জেলার রাজঘাটা এলাকা পেরিয়ে দুর্গম পাহাড়ি পথ দিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হই। পাঁচদিন হাঁটার পর ভারতের পারবা ক্যাম্পে উপস্থিত হই। ওখান থেকে ১নং সেক্টরের অধীনস্থ দেমাগ্রীতে প্রশিক্ষণে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে অশোক চাকমার নেতৃত্বে ১০১ জনের একটি দল তিন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ভারতের বড়পানছড়ি থেকে রোয়াংছড়ি উপজেলার কচ্ছপতলী হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। গ্রুপের সদস্য ছিল ৩৩ জন। ধোপাছড়ি পৌঁছে দেখতে পাই মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আগেভাগেই দখল করে নিয়েছে। আর মুক্তিযোদ্ধারা ওই ক্যাম্প ছেড়ে রাঙ্গুনিয়া থানার সীপছড়ি সংলগ্ন কমলাছড়ি এলাকায় অবস্থান নেন।

 

পরদিন ভোরে দেখতে পান তাদের দলে থাকা ৩৩ জনের মধ্যে ১৯ জন ছাড়া বাকিরা দলত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছেন। ওই অবস্থায় ১৯ জনকে নিয়ে গোয়ালিয়াখোলা এলাকায় একটি উঁচু পাহাড়ে আশ্রয় নেন তারা। পরদিন নৌকাযোগে সুয়ালক হয়ে উত্তর হাঙ্গর মৌজার হানিফার চরে চলে আসেন। ওই চরে বান্দরবান আর লোহাগাড়া সীমানা সংলগ্ন জনৈক শফি সওদাগরের খামারবাড়ি। তখন নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়। তারা হানিফার চরে একটি ক্যাম্প স্থাপন করেন। এই ক্যাম্প থেকেই রাজঘাটা, আমিরাবাদ, সাতকানিয়া, বান্দরবান এলাকার বিভিন্ন স্থানে অপারেশন চালানো হতো।

 

ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে শহিদুর রহমানসহ ৮-৯ জনের একটি বীর মুক্তিযোদ্ধা দল অস্ত্রসহ তাদের গ্রুপে যোগ দেয়। এতে মোস্তফিজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর দলটি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে তারা লোহাগাড়া টেলিফোন এক্সচেঞ্জে হামলা করে সকল যন্ত্রপাতি নিয়ে নেন। এতে পার্শ্ববর্তী এলাকায় অবস্থানরত পাক সেনাদের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় তৎকালীন এমএনএ আবু ছালেহ হেলিকপ্টারযোগে সঙ্গীয় ফোর্সসহ হানিফার চর ক্যাম্পে অবতরণ করেন এবং হেলিকপ্টারযোগে মিত্রবাহিনীর আরও কিছু ফোর্স আনার ব্যবস্থা করেন।

 

মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধির বিষয়টি টের পেয়ে পাক সেনাবাহিনীর মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে। পাক সেনারা লোহাগাড়া ছেড়ে দোহাজারী ব্রিজের একপ্রান্তে জমায়েত হতে থাকে। পাক সেনাদের পিছু পিছু মিত্রবাহিনীর একটি গ্রুপ কেরানীহাট গিয়ে অবস্থান নেয়। ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি আর্মি দোহাজারী ব্রিজ পাড়ি দেয়ার পর ব্রিজের একটি অংশ ভেঙে দেয়। এ অবস্থায় সাঙ্গু নদীর এপার-ওপার অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয়। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর তিন শতাধিক যোদ্ধা এ সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

 

তিনদিন ধরে বিরামহীনভাবে এ যুদ্ধ চলমান ছিল। এতে পাকবাহিনীর তিনজন নিহত হন। অবস্থা বেগতিক দেখে ধোপাছড়ি, বান্দরবান ও দোহাজারী ক্যাম্পে অবস্থানরত পাকবাহিনীর সবাই ওইসব এলাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে চলে যায়।

 

১৩ ডিসেম্বর তিনি সঙ্গীয় ৬০-৭০ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে বান্দরবানে যান। বান্দরবান তখন হানাদারমুক্ত। পাকবাহিনীর সদস্যরা দোহাজারী যুদ্ধের পর ধোপাছড়ি ত্যাগ করে পালিয়ে গিয়ে চট্টগ্রাম শহরে আশ্রয় নেয়। বান্দরবান অঞ্চল থেকে পাঞ্জাবিরা চলে যাবার পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউসটি শত্রুমুক্ত হলে তিনি সেই ক্যাম্পে অবস্থান নেন। তবে সড়ক ও জনপথ বিভাগের রেস্ট হাউস (বর্তমান সার্কিট হাউস) এলাকার পাহাড়ের উপর পাক সেনাদের আরেকটি ক্যাম্প ছিল। শত্রুমুক্ত হলেও পাকবাহিনীর দোসররা মুক্তিবাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে।

 

১৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাগণ বান্দরবানের চতুর্দিকের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে থাকেন এবং ব্যাপক অনুসন্ধান চালান। ১৫ ডিসেম্বর শান্তিকমিটির কয়েকজন সদস্যকে আটক করা হয়। ১৫ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর পক্ষের একটি গ্রুপ আত্মসমর্পণ করে।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট