মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলীপ দাশ ত্রিদিব পূর্বকোণকে বলেন, গ্রামের গৌবিন্দ্র জলদাশসহ রাঙামাটি হয়ে দেমাগ্রী সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য যাই। দেমাগ্রী এক নম্বর সেক্টরে যুক্ত হয়ে এক মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এরপর আমাকে একটি রাইফেল দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, প্রশিক্ষণ শেষে ভারতের এক কোম্পানি মিত্রবাহিনীর সঙ্গে আমিসহ ১০-১২ জন মুক্তিযোদ্ধা রাঙামাটির কাচলং খালের পাশে মারিশ্যা বাজারে আসি। তখন স্কুলে পাঞ্জাবি, মিজু এবং রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। ভোররাতে সেই ক্যাম্পে আমরা আক্রমণ করি। এরপর তারা বিতাড়িত হলে স্কুলে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপন করি। ৪-৫ দিন পর দীঘিনালার বোয়ালখালী থেকে হানাদার বাহিনীর আরেকটি গ্রুপ এসে আমাদের পাশের একটি খিয়াংয়ে (বৌদ্ধ বিহার) ঘাঁটি করেন।
একদিন দুপুরে আমরা খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, হঠাৎ হানাদার বাহিনী অনবরত গুলিবর্ষণ করতে থাকে। তাৎক্ষণিক আমিসহ মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তুলি। দু’পক্ষের মধ্যে প্রায় তিন ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে মিত্র বাহিনীর একজন নেপালি সৈন্যের মাথায় পাকবাহিনীর ছোড়া রকেট সেল লেগে মৃত্যুবরণ করেন। তবে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর তীব্র প্রতিরোধের মুখে হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর সিদ্ধান্ত হয় আমাদের ক্যাম্প থেকে সাড়ে তিন মাইল পশ্চিমে এবং পাক বাহিনীর ক্যাম্পের খুবই কাছে থাকা চলাচলের রাস্তায় একটি কাঠের ব্রিজ ধ্বংস করে দেওয়ার। যাতে হানাদার বাহিনীর জিপ গাড়ি নিয়ে আসতে না পারে।
দিলীপ দাশ জানান, আমিসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্রবাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় পাহাড়ি আধিবাসীদের সহায়তায় রাতের আঁধারে কাঠের ব্রিজটির নিচে শুকনো জ্বালানি কাঠ নিয়ে স্তুপ করে রাখি। অপারেশনে যাওয়া সবাই ব্রিজের আশপাশেই পজিশন নেয়। জীবনের ঝুঁকি জেনেও আমি একজন সহযোগীকে নিয়ে দুটি জার ভর্তি কেরোসিন তেল ব্রিজের মাঝখানে ঢেলে দিয়ে আগুনে ধরিয়ে দিয়েই অবস্থানে চলে আসি। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলে পাশের পাক হানাদার ক্যাম্প থেকে আমাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। তখন আমরাও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলি। প্রায় দেড় ঘণ্টা সম্মুখ যুদ্ধ হয় সেদিন।
ব্রিজের নিচে শুকনো জ্বালানি কাঠের স্তুপ থাকায় আগুনের তীব্রতা দ্রুত বেড়ে গিয়ে কাঠের ব্রিজটি সম্পূর্ণ পুড়ে ভেঙে নিচে পড়ে যায়। এতে হানাদারদের চলাচলের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে তারা আগুন নেভাতে পারেনি। আমাদের তীব্র পতিরোধের মুখে সেই ক্যাম্প থেকেও পাকবাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এর মধ্য দিয়ে মারিশ্যা বাজার নিয়ে বিশাল এলাকাজুড়ে মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। হানাদারমুক্ত হয় গ্রামটি।
এরপর বাঘাইছড়ি স্কুল ক্যাম্প ছেড়ে আমরা ১৪ মাইল দূরের আমতলী চলে আসি। দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে একটি গ্রুপ রাঙাপাহাড় এফআইডিসি অফিসে, আমিসহ অন্য গ্রুপটি একজন শিখ মেজরের নেতৃত্বে আমতলী নদীর পাড়ের ফরেস্ট অফিসে ক্যাম্প গড়ে তুলি। সেখান থেকে রাতে বিভিন্ন জায়গায় হানাদার বাহিনীর ওপর অপারেশন চালানো হতো। ক্যাম্পে হেলিকপ্টারে খাবার এবং প্রয়োজনীয় রসদ যোগান দেওয়া হতো। হেলিকপ্টার নামার জন্য গাছের আগায় কাপড় দিয়ে চিহ্ন রাখা হতো। এভাবে সেই ক্যাম্পে থাকা অবস্থায়ই দেশ স্বাধীন হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলীপ দাশ রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার দক্ষিণ ঘাটচেক ইছামতী পাড়ের বাসিন্দা মৃত প্রসন্ন কুমার দাশের ছেলে।
পূর্বকোণ/ইব