বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম কিবরিয়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯৭১ সালের মার্চে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হতে প্রচার হল আমি মেজর জিয়া বলছি। তার পরের দিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম মিলিটারির গাড়িবহর পটিয়া কলেজ মাঠ দখল করে ফেলেছে। পটিয়া কলেজের ছাত্ররা বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি গিয়ে আগত সেনা সদস্যদের জন্য কাপড়চোপর ও খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহে নেমে গেলাম।
দেখতে পেলাম মেজর জিয়া চিন্তাযুক্ত চেহারায় পটিয়াস্থ তৎকালীন থানার পুরাতন টিন ছাউনি ভবনের বারান্দায় পায়চারি করছেন। আমরা এক খাঁচা রসদ নিয়ে তার কাছে গিয়ে বল্লাম এই রসদগুলো আপনাদের জন্য সংগ্রহ করেছি, এগুলো কোথায় জমা দেবো? তখন তিনি বলে উঠলেন, দেখুন, আমরা সেনাবাহিনীর লোক। আমাদের সাত দিন পর্যন্ত না খেয়ে থাকার অভ্যাস আছে।
মুক্তিযুদ্ধ পুরোপুরি শুরু হয়ে গেছে, আমাদের সাহায্যের জন্য আপনাদের মত যুবকের দরকার, যান আপনাদের ট্রেনিং এর জন্য ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সড়কে এসে মেজর জিয়া সাতকানিয়া অভিমুখি একটি ট্রাককে দাঁড় করান। ট্রাকটির ড্রাইভারকে বলে দিলেন- এদের তোমাকে রামগড় পৌঁছে দিতে হবে। দায়িত্ব দেয়া হল রুমি, কালাম ও আমাকে। আমরা সাথে নিয়েছিলাম তৎকালীন ছাত্রনেতা শামশুদ্দিন, মতিন, অব্দুল লতিফ বেট্টা, মনসার ইউছুপ (আমেরিকা প্রবাসী) রুমী (মৃত), কালাম (মৃত), বাহুলীর মাহাবু (মৃত), কচুয়াইর এস,এম নূরুল আলম (মৃত), হাবিলাসদ্বীপের আসলাম (মৃত), রফিক (মৃত), শাহগদি মার্কেটের আবুতৈয়ব, গোবিন্দরখিলের আবুছিদ্দিককে (মৃত) প্রমুখ।
ট্রাক ড্রাইভার চালাকি করে ট্রাক খারাপ হয়েছে বলে আমাদের কালুরঘাটের পর আর যায়নি। কাপ্তাই রাস্তা ধরে হেঁটে বর্তমান চুয়েট হয়ে নাজিরহাট কলেজে পৌঁছলে আমাদের সাথে প্রফেসর সামশুল ইসলামের দেখা হলে তিনিও রামগড় গেলেন, রামগড় থানায় নাম লিখিয়ে ছড়ার পানি না থাকায় হেঁটে সাব্রæম পৌঁছলাম। মেজর জিয়া সাহেবের কথাই সত্য হলো, সাব্রুমে ভারতীয় বিএসএফদের ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, আমরা সকলেই একে একে ট্রাকে উঠে পরলাম। পাহাড়ের এক সমতল জায়গায় সকলকে নামানো হলো, শুনলাম সেটি একটি বি.এস.এফ ক্যাম্প। যার নাম ছিলো বগাফা ট্রেনিং ক্যাম্প, সম্ভবত ত্রিপুরা রাজ্যে এটির অবস্থান।
আমাদের প্রশিক্ষণ ছিলো থ্রি নট থ্রি রাইফেল. এল.এম.জি, স্টেনগান, গ্রেনেড ছোড়া ইত্যাদি। আমাদের সেই প্রশিক্ষণের পর কাজের নাম ছিলো ‘হিট এন্ড রান’ তথা গেরিলা যুদ্ধ। পক্ষান্তরে আমাকে, শহীদুল হক সৈয়দ ও মনসার ইউছুপকে অতিরিক্ত ২’ মর্টার ও ৩’ মর্টার এবং এমএমজি প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং কমন্ডার হিসাবে প্রফেসর সামশুল ইসলামকে নিযুক্ত করা হয়।
স্মরণীয় হলো রাজস্থলী বাজারে বর্তমানে রাজস্থলী উপজেলা সেখানে পাক সেনাদের সাথে যুদ্ধে সম্মুখিন হওয়া, সেখানে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আমিসহ অন্যরা সকলেই ধরা পড়ে যাই। আব্দুল মান্নান, আব্দুল লতিফ ভেট্টা ও আমাকে রাঙ্গামাটিস্থ পাক সেনাদের সাবসেক্টারের কোয়ার্টার গার্ডে রাখা হয়। ২০ দিনের মাথায় আমাদের এক মুরুব্বি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সদস্য পাক সেনাদের সাথে দেনদরবার করে মুচলেকা দিয়ে ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের সাধারণ ক্ষমায় ছাড়া পাই।
সেই শহীদ রফিকের কবর রাজস্থলী উপজেলাস্থ কবরস্থানে কি অবস্থায় আছে তা জানা নেই। পাক সেনাদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আমি চট্টগ্রাম শহরস্থ বীর মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক দানু ভাইদের সাথে কাজ করতে শুরু করি।
পূর্বকোণ/ইব