চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০২৫

সর্বশেষ:

কর্ণফুলী নদীতে বালু লুটে আ. লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের ‘বিরল’ জোট

নিজস্ব প্রতিবেদক

২ মার্চ, ২০২৫ | ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ

বোয়ালখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রাজা, তার তিন ভাই। খরণদ্বীপ ইউনিয়ন আ. লীগ সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন খোকন, তার ভাই ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি মো. ইউসুফ। যুবলীগ আহ্বায়ক শাহাদাৎ হোসেনসহ আওয়ামী লীগ-যুবলীগের ডজনখানেক নেতা দীর্ঘদিন ধরে কর্ণফুলীর অবৈধ বালু-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। সাবেক এক মন্ত্রীর প্রভাবে ১৭ বছর ধরে তারা রাজত্ব করেছিল। প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল বালুখেকোরা।

 

এই চিত্র বোয়ালখালীর শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নের। এটি রাঙ্গুনিয়া সংসদীয় আসনের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও উপজেলার কধুরখীল, চরণদ্বীপ ও কালুরঘাটসহ বিভিন্ন এলাকার বালুমহাল দখল এবং বালু বেচাকেনার নিয়ন্ত্রক ছিল আওয়ামী লীগ-যুবলীগ। ক্ষমতার পট-পরিবর্তনের পর তা নিয়ন্ত্রণে নেয় বিএনপি-জামায়াত। এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে চলছে অবৈধ বালু বাণিজ্য।

 

সম্প্রতি কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট থেকে খরণদ্বীপ, শ্রীপুর-খরণদ্বীপ, চিরিয়া অংশ ঘুরে দেখা যায়, কালুরঘাট থেকে কধুরখীল, চরণদ্বীপ ও খরণদ্বীপ-জ্যৈষ্ঠপুরা এলাকা পর্যন্ত নদীর ধারে ৩০-৩৫টি বালু বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। নতুন করে আরও কয়েকটি নির্মাণ করা হচ্ছে। বালু বেচাকেনার বড় স্পট দেখা যায় কালুরঘাট, চৌধুরীহাট, ফখিরাখালীঘাট, চৌধুরী খালের মুখ এলাকায়। নদীর বিভিন্ন অংশ থেকে ড্রেজার-ভলগেট দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।

 

দেখা যায়, বালু উত্তোলন ও বাণিজ্যের অন্যতম বড় স্থান হচ্ছে শ্রীপুর-খরণদ্বীপ। দীর্ঘদিন ধরে আ. লীগের লোকজন ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বালু বাণিজ্যে করে আসছিল। সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যায় বালুখেকোরা। দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল অবৈধ বালু বাণিজ্য। সম্প্রতি বিএনপির দুই গ্রুপ ও জামায়াতের নেতারা আওয়ামী লীগের বালুখেকোদের ভলগেট-ড্রেজার সহায়তা নিয়ে ফের শুরু হয়েছে রমরমা বালু-বাণিজ্য।

 

আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের পদধারী একাধিক বালু ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়। তারা বললেন, বালুমহাল ও বিক্রয়কেন্দ্রগুলো বিএনপি-জামায়াতের নেতারা দখল করে নিয়েছে। তবে তাদের ড্রেজার-ভলগেট নেই। সমঝোতার ভিত্তিতে ড্রেজার-ভলগেটে বালু উত্তোলন করে তাদের বিক্রয়কেন্দ্রে দেওয়া হচ্ছে।

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ও জ্যৈষ্ঠপুরা এলাকায় বালু উত্তোলনে উপজেলা বিএনপির সাবেক এক শীর্ষ নেতা, ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. ওয়াহিদসহ অর্ধ ডজন নেতাদের নাম এসেছে। এ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ নেতাদের অন্তত ১৪টি ড্রেজার-ভলগেট রয়েছে। বালু তোলার সব সরঞ্জাম এখন বিএনপি নেতাদের অধীনে চালু করা হয়েছে।

 

এ বিষয়ে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও চেয়ারম্যান হামিদুল হক মান্নান বলেন, এ বিষয়ে আমি জড়িত নই। দলের একটি অংশ আমাকে শেয়ার দেওয়া কথা বলেছে। তবে কোনো টাকা-পয়সা পাইনি।

 

বোয়ালখালীতে বৈধ কোনো বালুমহাল নেই বলে জানান উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কানিজ ফাতেমা। তিনি বলেন, জেলা রাজস্ব সভায় জেলা প্রশাসক মহোদয় হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করে বালুমহালের প্রস্তাবনা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। জরিপের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রস্তাব দেওয়া হবে।

 

বাদ যাচ্ছে না পাহাড়ি ছড়াও :

কর্ণফুলী নদী ছাড়াও জ্যৈষ্ঠপুরা ভাণ্ডালজুড়ি খাল ও পাহাড়ি ছড়া থেকে ট্যাক্টর দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ইমাম উদ্দিন এয়াছিন, ইউনিয়ন জামায়াতের আমির খোরশেদ আলম, হোসেন মেম্বার এবং বিএনপির মাহবুব, মো. ফারুক, জাফর ও কালু অবৈধ বালু উত্তোলনে জড়িত বলে জানান স্থানীয়রা।

 

জামায়াত নেতা ইমাম উদ্দিন এয়াছিন পূর্বকোণকে বলেন, খালের ওপরে (ছড়া) চর জেগেছে। যাদের পৈত্রিক সম্পত্তি আছে, তারা সেখান থেকে বালু তুলছে। আমিও পৈত্রিক সম্পত্তিতে জেগে ওঠা চর থেকে বালু তুলছি।

 

চর খাজনার নামে চাঁদাবাজি :

ওয়াসার ভাণ্ডালজুড়ি প্রকল্প এলাকার উজানে বোয়ালখালী-রাঙ্গুনিয়ার সীমান্তবর্তী চিরিয়া অংশ থেকে ৮-১০ হাজার ঘনফুট ধারণক্ষমতার বড় বোটে দিনে ৮০-৯০ হাজার ফুট বালু কাটা হয়। সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিতি সালাউদ্দিন তা নিয়ন্ত্রণ করে বলে জানান বালু ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে বিএনপি কেন্দ্রীয় এক নেতার নাম ভাঙিয়ে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন।

 

শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ও জ্যৈষ্ঠপুরায় দিনে অন্তত ২০টি ড্রেজারে দিনে ৬০-৮০ হাজার ফুট বালু তোলা হয়। টাকা তুলে যুবদল নেতা শহীদ, রুকসার, নান্নাসহ কয়েকজন বিএনপি-যুবদল নেতাকর্মী। চর খাজনার নামে প্রতিফুটে এক টাকা হারে চাঁদা আদায় করা হয়। চিরিয়া এবং খরণদ্বীপ-জ্যৈষ্ঠপুরা থেকে চর খাজনার নামে দিনে দেড় লাখ টাকার চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। যা মাসে ৪৫ লাখ টাকা।

 

সরেজমিন দেখা যায়, কধুরখীল, চৌধুরীহাট, চরণদ্বীপ, ফখিরাখালী ঘাট, পূর্ব চরণদ্বীপ, চৌধুরী খালের মুখ, খরণদ্বীপসহ কর্ণফুলীর বিভিন্ন অংশ থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। কধুরখীল, ফখিরাখালী, খেলাঘাট এলাকা থেকে বালু উত্তোলনে সাবেক যুবদল নেতা মো. আলম ও আওয়ামী লীগ নেতা মনছুর আলম পাপ্পীর লোকজন জড়িত।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পূর্ব চরণদ্বীপ মসজিদ ঘাট এলাকায় ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আক্কাস খান, জানে আলম, আলম, মিশেল, বড়ুয়াপাড়া এলাকায় জিন্নাত আলী, বেলাল, মহিউদ্দিন, আক্কাস খান মেম্বার, আবু আলম মেম্বারের নাম এসেছে।

 

ভাগাভাগি ৬০-৪০ শতাংশ :

চৌধুরীহাট ও জামতল এলাকায় আওয়ামী লীগ ঘরানার ব্যবসায়ী মো. বাবুল দীর্ঘদিন ধরে বালু উত্তোলন-বেচাকেনা করে আসছে। সরকার পরিবর্তনের পর তার নিয়ন্ত্রণে থাকা সবকটি বিক্রয়কেন্দ্র হয়ে যায়। বর্তমানে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে চালু করা হয়েছে। ড্রেজার ও বিক্রয়কেন্দ্র থাকা বাবুল ৪০ শতাংশ এবং বিএনপি-জামায়াতের নেতারা ৬০ শতাংশ হিসেবে সমঝোতা হয়েছে বলে সূত্র জানায়। বাবুলের সঙ্গে আছেন জামায়াতের নেজাম উদ্দিন, ওসমান গণি, সামশু, আজিজ ভাণ্ডারী। জামতল এলাকায় আছেন পৌরসভা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আবদুল করিম, যুবদল নেতা মো. ইলিয়াছ, ইদ্রিচ বিশু, সরোয়ার।

 

তবে বিএনপি নেতা আবদুল করিম বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা বাবুল জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করে আগের মতো দাপটের সঙ্গে বালু ব্যবসা করে যাচ্ছে। আমরা বিএনপির ঘরানার লোকদের নিয়ে আলাদা ব্যবসা করছি।

 

আওয়ামী লীগ নেতা মো. সোহেল (বাবুল) পূর্বকোণকে বলেন, ড্রেজার ও বালু বিক্রয়কেন্দ্র অনেকটা হাতছাড়া। এখন নেজাম ও ওসমান ভাইদের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা শুরু করার সমঝোতা হয়েছে।

 

জামায়াত নেতা ওসমান গণির মোবাইলে দুই দফায় একাধিক কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

 

জেলা প্রশাসনের বালু মহাল ইজারার ২০২৩ সালের তালিকায় কর্ণফুলী নদীর বোয়ালখালী উপজেলায় কোনো বালু মহাল নেই। অথচ ২০-২৫ বছর ধরে চলে আসছে অবৈধ বালু উত্তোলন ও বাণিজ্য। এখান থেকে কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না সরকার।

 

বোয়ালখালীর সদ্য বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিমাদ্রী খীসা বলেছিলেন, বোয়ালখালী অংশে অনুমোদিত কোনো বালুমহাল নেই। বালু উত্তোলনে কোনো প্রকার অনুমোদনও দেওয়া হয়নি।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট