চট্টগ্রাম বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

সর্বশেষ:

মন্তব্য প্রতিবেদন

প্রোটিন খাদ্য উৎপাদনে চাই সরকারি নীতি সহায়তা

ডা. মো. সাজেদুল হাসান

৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ | ৭:৫৩ পূর্বাহ্ণ

প্রধানমন্ত্রী চাল, চিনি, ভোজ্যতেল ও খেজুরের উপর আমদানি শুল্ক হ্রাসের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেকে নির্দেশ দিয়েছেন। রমজান মাস সামনে রেখে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য সাধারণের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখার জন্য এরূপ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তাঁর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
রাজস্ব বোর্ড এখন পণ্য শুল্ক নির্ধারণ করবে। দেখা যাক তারা কি ভূমিকা গ্রহণ করে। তবে জনগণের অভিজ্ঞতা হচ্ছে সরকারের সদিচ্ছাগুলো মাঠ পর্যায়ে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয় না। তার কারণ দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখা বা বাজার নিয়ন্ত্রণে শুল্কহ্রাস একমাত্র নিয়ামক নয়। পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয়, নিয়মিত বাজার মনিটরিংসহ নানাবিধ ফ্যাক্টরও এখানে ক্রিয়াশীল। সেই সাথে রয়েছে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অদৃশ্য কালো হাত। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ এই সমস্ত বিষয় নিয়ন্ত্রণে তৎপর হলে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা ফলদায়ক হবে।
রমজান মাসে উল্লিখিত চারটি খাদ্যপণ্যের চাহিদা বহুগুণ বৃদ্ধি পায় এবং দিনে দিনে এটি বাড়ছে। সরবরাহ পর্যাপ্ত নাহলে বাজার আগুন হয়ে উঠে, মানুষও একপ্রকার দিশাহারা হন্য হয়ে পডে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এই প্রবণতা দেখে আসছি। জানিনা হাজার বছর ধরে এই দেশে কি ধরনের খাদ্য সংস্কৃতির প্রচলন ছিলো।
চাল, তেল, চিনি, খেজুর মূলত কার্বোহাউড্রেট ও ফ্যাট জাতীয় খাবার। যার অতিরিক্ত গ্রহণ জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। শুল্ক কমানোর ফলে মূল্যহ্রাসের সুযোগে মানুষ যেন এগুলোর ভোগসীমা অতিক্রম না করে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মনে হতে পারে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এটি তেমন কোনো সমস্যা নয়। তাদের এমনিতেই যথেষ্ঠ খাবারের সংস্থান নেই। কিন্তু শহরাঞ্চলের মত গ্রামাঞ্চল ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসারের মত রোগের প্রাদুর্ভাবও ইদানিং কম নয়। তার অন্যতম কারণ হতে পারে খাদ্যাভাস। আমরা ভাতের সাথে আলুভর্তা খাই, কিংবা সকালের নাস্তায় রুটি আর আলুভাজি; আমাদের প্রিয় খাবার যার প্রায় পুরোটাই কার্বোহাইড্রেট তথা সুগারের ডিপো। যা থেকে জন্ম নেয় ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এমনকি ক্যান্সার।
অথচ আমাদের বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষের প্রয়োজন প্রোটিন। সাধারণভাবে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক প্রোটিন চাহিদা ৮০ থেকে ১০০ গ্রাম। যার প্রধান উৎস মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ও ডাল। এক টুকরা মাংস, এক টুকরা মাছ, একটি ডিম ও এক গøাস দুধে এই পরিমাণ প্রোটিন বিদ্যমান। আমাদের অধিকাংশের জন্যই তা যোগাড় করা সম্ভব হয়না। বর্তমানে মৎস্য এ পশুখাদ্যের অত্যাধিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রোটিনের এই উৎসগুলির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। মৎস্য ও পশুখাদ্যের অন্যতম উপাদান হচ্ছে সয়াবিন, খৈল ও ফিসমিল যার বিশাল অংশ আমদানি নির্ভর। উচ্চ খাদ্যমূল্যের কারণে অনেক খামারি ব্যবসা পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছেন উৎপাদনও হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। আমদানি নির্ভর উপাদানগুলোর শুল্ক কমালে মৎস্য ও পশুখাদ্যের মূল্য হ্রাস পেতে পারে। এতে প্রান্তিক খামারিরা উপকৃত হতো, তাদের উৎসাহ বৃদ্ধি পেতো, সৃষ্টি হতো নতুন উদ্যোক্তা তৈরির সম্ভাবনা। ব্যবসায়ে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেলে মাছ, মাংস, ডিমের দাম অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই কমে যাওয়া সম্ভব।
সুষম খাদ্যের জন্য কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, প্রোটিনের মধ্যে ভারসাম্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র কার্বহাইড্রেট খেয়ে পেট ভরালে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবেনা। এই দেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রোটিন চাহিদা মেটায় ডিম, ব্রয়লার মুরগি, তেলাপিয়া আর পাংগাস। একদা সুলভ প্রোটিনের এই উৎসগুলির বাজারও বর্তমানে আক্রান্ত। ফলে প্রান্তিক মানুষের ভোগ কমেছে, কিন্তু প্রোটিনের প্রাপ্যতা বাড়াতে পাংগাস, তেলাপিয়া আর ব্রয়লারের বিকল্প আপাতত নেই।
সিয়াম সাধনার মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ সমাজে স্বস্তি বয়ে আনবে। তাই প্রধানমন্ত্রীর শুল্কহ্রাসের সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী। পাশাপাশি পুষ্টিকে সামষ্টিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করাও সময়ের দাবি। পুষ্টিবিজ্ঞানের জ্ঞান থেকে জানি এইখাতে এক টাকা বিনিয়োগ করলে তা ১৬ টাকার ফলদান করে। তাই সামগ্রিক পরিকল্পনায় এই খাতে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। সারা বছরই মানুষ যাতে সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে পারে সেজন্য কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাটের পাশাপাশি প্রোটিনের প্রাপ্যতাও যেন সহজ সুলভ হয়। প্রোটিন গ্রহণ বৃদ্ধি পেলে মেহনতি মানুষের পেশি সবল হবে, কর্মশক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি হবে। সেই সাথে বাড়বে দেশজ উৎপাদন। শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে আন্তর্জাতিকভাবে শ্রমবাজার, খেলাধুলাসহ অনেক ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে পড়ি। এই দেশের কিশোর, তরুণ, যুবকের পেশি আরও দীর্ঘ সবল হোক। তাদের শারীরিক গঠন আরও মজবুত হোক। সেই অঙ্গীকারে প্রোটিনের উৎস বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ বাড়ানো, উদ্যোক্তা সহায়তা, উৎপাদনের উপকরণে শুল্ক হ্রাস এগুলোই রাজনৈতিক নেতৃত্ব, অর্থনীতি ও পরিকল্পনাবিদদের চিন্তার খোরাক হোক। আমাদের চাই কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাটের সাথে প্রোটিন, প্রোটিন এবং আরও প্রোটিন।

লেখক : বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট