ফিলিস্তিনের গাজা এখন মৃত্যু উপত্যকা। দখলদার ইজরায়েলি বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চলকে পরিণত করেছে ধ্বংসস্তুপে। সেই ধ্বংসপুরীর বিবরণ কোন ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে ইজরায়েলি বাহিনী গাজার সবকিছু ধ্বংস করেছে।
শরণার্থী শিবির হিসেবে ব্যবহৃত স্কুল, নিরাপদ বাড়ি, বাজার, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, রুটি তৈরির মেশিন সবই। শেষ সচল হাসপাতালটিও হামলা চালিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছে। আহতরা যাতে চিকিৎসা না নিতে পারে সেই জন্য ধ্বংস করেছে ৩৫টি হাসপাতাল। ধ্বংসপুরীর নিচে চাপা পড়েছে হাজার হাজার বনি আদমের মরদেহ। তাদের উদ্ধার করে দাফনতো দূরের কথা, বেঁচে থাকা সবাই পালাচ্ছে প্রাণ ভয়ে। তাদের উপর চলছে বিরামহীন বোমাবর্ষণ।
গাজাবাসী যুদ্ধে অভ্যস্ত। এমনকি কোনটা মিলিশিয়া রকেট, কোনটা ইসরায়েলি রকেট আকাশে থাকতেই তারা চেনে। যেন একেকজন সামরিক বিশেষজ্ঞ। কিন্তু আপনি যতই যুদ্ধ-অভিজ্ঞ হোন, কখনো নির্ভরযোগ্য নিরাপদ স্থান আন্দাজ করতে পারবেন না। ২০ লাখ মানুষ যাদের প্রায় অর্ধেক উত্তর থেকে দক্ষিণে পালিয়ে গিয়েছিল। সেখানেও মৃত্যু এসেছে। তারা জানে না কোথায় গিয়ে বাঁচতে পারবে? যে শিশুরা এখন পরিবারের হত্যার দৃশ্য দেখছে, তারা চিরকাল শিশু থাকবে না। একসময় তারা প্রতিবাদ করতে শিখবে। তাই ইজরায়েল এখন জোর দিয়েছে শিশু হত্যায়।
ধ্বংসস্তুপের নিচে থাকা জীবিতরা ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে। আহতরা একটু একটু করে দম হারাচ্ছে। তারা রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে রক্ত ঝরছে। একসময় তারা শেষ নিশ্বাস ছাড়ছে। যুদ্ধের প্রথম শহীদরা এখন কংকাল আর খুলি হেয়ে গেছে। এই যুদ্ধ দেখাচ্ছে শত বছরের ভয়। বিদ্যুত নেই। হাসপাতালে বোমা। শত শত মানুষ রাস্তায়। প্রবল বর্ষণে রক্ত ঝরছে। শিশু নারী-পুরুষ বৃদ্ধরা তাদের শীতকালীন সস্তা কাপড়ে মাটিতে পড়ে আছেন। পাশে সাদা কাপনে মোড়ানে কিছু মানুষ মরে আছে। তাদের পচে যাওয়া মরদেহ গাজার আকাশে ভাসছে। একদিন যেখানে ছিল মিষ্টি কমলার সুভাস। লেবুর মনমাতানো ঘ্রাণ। এখন শুধু চারদিকে লাশের দুর্গন্ধ।
গাজা এখন পৃথিবীর বৃহত্তম গোরস্থানে পরিণত হয়েছে। দখলদার বাহিনী তাদের দাফন করতে বাধা দেয়। মানুষ জানতেই পরে না তাদের প্রিয়জন মারা গেছে। মৃতেদহ গলে গেছে। একটা পা, একটা হাত, একটা মাথা-এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে থাকতে মিশে যাচ্ছে মাটিতে। এমনকি জন্ম নেয়া নবজাতক শ্বাস নিতে নিতে মারা যাচ্ছে। তারা জন্মদান কক্ষ ও হৃদযন্ত্রের কক্ষগুলো ধ্বংস করেছে। চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ধ্বংস করেছে হাসাপাতালও। এই অবস্থায় সেখানে বসবাসের সাধ্য কার?
অথচ আজ থেকে ৭৭ বছর আগে ইসরায়েল নামে কোন রাষ্ট্র ছিলো না পৃথিবীতে। পশ্চিমাদের সহযোগিতায় তারা ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ফিলিস্তিন দখলে নিয়ে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করে। সেই থেকে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনিরা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের জাতিগত নির্মূল অভিযানের কথা উল্লেখ করে ‘আল নাকব’ বা বিপর্যয় পালন করে। এটি ফিলিস্তিনের কমপক্ষে সাড়ে সাত লাখ আরবের গণহত্যাকে বোঝায়। যদিও বেশিরভাগই বিশ্বাস করেন যে এই ঘটনাটি ১৯৪৮ সালে শুরু হয়েছিল। বাস্তবে আল নাকবা কয়েক দশক আগে শুরু হয়েছিল এবং এটি এখনও চলছে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত ইহুদিবাদী সরকার ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত নাকবা চলতে থাকবে। ইসরায়েল কেবল ১৯৪৮ সালে যুদ্ধাপরাধ করেনি, বরং আজও যুদ্ধাপরাধ করে চলেছে। মানুষকে তাদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করা এবং তাদের ফিরে আসতে বাধা দেওয়া যুদ্ধাপরাধ।
ফিলিস্তিনিদের এই মহাবিপর্যয় সৃষ্টির জন্য আরব দেশগুলোর দুর্বলতা ও ব্যর্থতাও কোনো অংশে কম দায়ী নয়। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে আরব লিগের সদস্য মিসর, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান ও ইরাকের সেনাবাহিনী ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে প্রবেশ করে এবং সদ্য ঘোষিত ইসরায়েল রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। প্রথম দিকে আরবরা কিছুটা সুবিধা করতে পারলেও দ্রুতই তারা পিছু হটতে থাকে। সামরিক শক্তির দিক থেকে আরব দেশগুলো ছিল দুর্বল, যদিও সংখ্যায় প্রথম দিকে তারা ছিল বেশি। তবে স্বাধীন রাষ্ট্র গড়া ও রক্ষার প্রত্যয়ে প্রবলভাবে উদ্দীপ্ত ইহুদি যোদ্ধাদের সামনে তারা ছিল দিগ্ভ্রান্ত ও লক্ষ্যহীন। তদুপরি নিজেদের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। ফলে ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে আরব দেশগুলো যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
গত ৭৭ বছরে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রতিটিতে আরবরা পরাজিত হয়েছে আর ফিলিস্তিনিরা নিজভূমে ক্রমে কোণঠাসা হয়েছে। তবে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল ৭৭ বছর ধরে বিকশিত হয়েছে। দেশটি বিশ্বের অন্যতম প্রধান সামরিক শক্তি, যার আছে পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার, আছে বিশ্বের দুর্ধর্ষতম গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ। উচ্চ প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনে নেতৃস্থানীয় দেশটির প্রতি ১০ হাজারে ১৩৫ জন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী। অধিবাসীদের গড় আয়ু বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ। ইসরায়েলের অর্জন আধুনিক বিশ্বের এক বিরাট বিস্ময় বললেও অত্যুক্তি হয় না, যার পেছনে পশ্চিমা বিশ্বের অকুণ্ঠ সমর্থনও ভূমিকা রেখেছে।
একই সঙ্গে এই সমর্থনের জোরে, বিশেষত যুগের পর যুগ যুক্তরাষ্ট্রের একচোখা মদদে ফিলিস্তিনিদের ভূমি-পানি-গাছপালা-ঘরবাড়ি সবই ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। ফিলিস্তিনিদের একাংশ জর্ডান সীমান্তঘেঁষা পশ্চিম তীরে ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত, আরেকাংশ মিসরের সিনাই সীমান্তঘেঁষা গাজায় ইসরায়েল আরোপিত অবরোধের মধ্যে জীবনযাপন করছে। ফিলিস্তিনিরা নিয়মিতই ইসরায়েলি হামলা-নির্যাতন-হত্যা-দখলদারির শিকার হচ্ছে। ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক নেতৃত্বও একাধারে দ্বিধাবিভক্ত, দিশাহীন ও দুর্নীতিপরায়ণ। আরব দেশগুলোর কাছ থেকে অর্থবহ ও কার্যকর সহযোগিতা অতীতেও মেলেনি, আজও মিলছে না। ফিলিস্তিনিরা টিকে আছে নিজস্ব প্রতিরোধ-সংগ্রাম আর কিছু সীমিত বৈশ্বিক সহায়তায়। শেষ হচ্ছে না তাদের নাকবার।
ফিলিস্তিনের গাজায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে নির্বিচার ও নৃশংস হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এতে এ পর্যন্ত প্রায় ৫১ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যাদের বেশির ভাগ শিশু ও নারী। ১৯৪৮ সালে যেভাবে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, এবারও ঠিক সেভাবে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র চলছে। তারা ফিলিস্তিনি ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি মুছে ফেলতে চাইছে। সামগ্রিক উদ্দেশ্য বিশ্ব মানচিত্র থেকে ফিলিস্তিনকে মুছে ফেলা। সেই লক্ষ্যে ইহুদিবাদীদের সহজ বার্তা: ভূমি ত্যাগ কর, না হয় মর।
ফিলিস্তিনি নাকবা ১৯৪৮ সালে শেষ হয়নি। ফিলিস্তিনের ইতিহাসে প্রতিটি দিনকে আল-নাকবা দিবস বলা যেতে পারে। ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের জাতিগত নির্মূল এখনও চলছে। আল-নাকবার মানসিক প্রভাব আজও অনুভূত হয়। কারণ ফিলিস্তিনিরা তাদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার এবং তাদের কাছ থেকে যা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তা পুনরুদ্ধারের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই লড়াইয়ে আরবসহ সারা বিশ্বের মুসলিমদের ভূমিকা দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
লেখক: ব্যুরো প্রধান- বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম।
পূর্বকোণ/জেইউ