সবুজে আচ্ছাদিত নয়নাভিরাম বিশালাকার মাঠ। মাঠের পরেই পরিখার গা ঘেঁষেই সুরক্ষিত-শক্তিশালী ও সুরম্য দেয়াল। নিরাপত্তাচৌকিতে তীর-ধনুক, বন্দুক ও গোলা-বারুদে সজ্জিত হয়ে দুর্গ পাহারায় চৌকস সৈন্য-সামন্তের প্রতিকৃতি। যেন সোয়া চারশ বছরের জীবন্ত ইতিহাস।
বই-পুস্তকে পড়ানো হয় শের-ই-মহীশূর টিপু সুলতানের বীরত্বগাথা উজ্জ্বল ইতিহাস। নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে প্রচারিত ‘দ্য সোর্ড অফ টিপু সুলতান’ ড্রামা সিরিজের বদৌলতে বাংলাদেশের মানুষের কাছে টিপু সুলতান জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতের তামিলনাড়– রাজ্যে যান। এই রাজ্যকে চিকিৎসার রাজ্য বলা হয়। ভেলোরে ১৯০০ সালে গড়ে তোলা হয় সিএমসি (ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ) হাসপাতাল। এখানে চিকিৎসার ফাঁকে ঘুরে আসতে পারেন টিপু সুলতানের দুর্গে। প্রাচীন বৃক্ষরাজির ছায়াতলে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন ক্ষণিকের জন্য। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝিতে বিজয়নগর রাজবংশের সদাশিব রায়ের অধস্তন চিন্না বোম্মি নায়ক জলঘেরা এ দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তোলেন। ১৭৯৯ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে টিপু সুলতান নিহত হন। এরপর তার পরিবারকে দুর্গে বন্দী করে রাখা হয়। সেই থেকে দুর্গটি টিপু সুলতানের দুর্গ নামে পরিচিতি পায়। এটিকে ভেলোর পোর্টও বলা হয়। আনুমানিক সোয়া চারশ বছর আগে নির্মিত সুরক্ষিত ও শক্তিশালী দুর্গ বা প্রাসাদ প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবেসংরক্ষণ করেছে ভারত সরকার। দুর্গের চারদিকে লেক (পরিখা-শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রতিরক্ষামূলক সুড়ঙ্গ) ঘেরা। যাতে শত্রুপক্ষ দুর্গে প্রবেশের আগে বাধার মুখে পড়ে। কথিত রয়েছে, একসময়ে এ পরিখা-লেকে কুমিরের বসবাস ছিল। দুর্গে অবস্থিত সুড়ঙ্গ হয়ে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে বীরঞ্জিপুরামে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল।
সদর দরজা দিয়ে দুর্গে ঢুকতেই চোখে পড়ে ভেলোর পোর্টের সংক্ষিপ্ত ইতিকথা। হিন্দি, ইংরেজি ও তামিল-তিন ভাষায় লেখা ইতিহাস। তাতে লেখা রয়েছে, ‘দুর্গটি গভীর ও প্রশস্ত হ্রদ দিয়ে সুরক্ষিত। পরিধি দুই দশমিক ৬৫ কিমি। প্রাচীরটি গ্রানাইট কাটা পাথরের তৈরি। সর্বনি¤œ প্রস্থ ৬০ ও সর্বোচ্চ ১২০ মিটার। বিভিন্ন স্থানে অর্ধবৃত্তাকার বুরুজ ও বন্দুকের ছিদ্রসহ রয়েছে।’ ১৩৩ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ দুর্গ। আনুমানিক ৪২৫ বছর আগে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক অনন্য স্থাপনা। নির্মাণশৈলী বিস্মিত করার মতো।
টিপু সুলতানের মূল প্রাসাদ বেঙ্গালুরুর মহীশূরে। বর্তমানে সেই গ্রামের নাম শ্রীরঙ্গপত্তনম। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের মান্ডিয়া জেলায়।
জাদুঘর : দুর্গের বাইরের সৌন্দর্য নয়, দুর্গের ভেতরে আছে অসাধারণ এক জাদুঘর। এ জাদুঘরে সুরক্ষিত রয়েছে টিপু সুলতানের ব্যবহৃত তলোয়ার ও নানা উপকরণ। অসাধারণ এক জাদুঘর। কী নেই এই জাদুঘরে! তাতে রয়েছে ৯০০-১৪০০ বছর আগের বিভিন্ন ধরনের পুরাকীর্তি। ১০ রুপি দিয়ে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে হয়। তবে মোবাইল বা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা যাবে না। ছবি তুলতে হলে গুনতে হবে ১০০ রুপি। জাদুঘরের প্রবেশমুখে রয়েছে ১৩-১৪শ শতকের পুরাকীর্তি। পাথরের গায়ে খোদাই করা সৈনিক ও দেব-দেবীর অনেক মূর্তি-ভাস্কর্য। নবম ও দশক শতকের খোদাই করা পাথরের স্তম্ভ এবং শিলালিপি সংরক্ষণ করা হয়েছে। রয়েছে ভেলোর রাজ্যের বিভিন্ন রাজা-বাদশার ভাস্কর্য এবং ১৭-১৮ শতকের বিভিন্ন সমরাস্ত্র।
জাদুঘরের ভেতরে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন প্রাণী ও দেব-দেবীর অবয়ব; দেশি-বিদেশি মুদ্রা, পোশাক-পরিচ্ছেদ, জাদুঘরের আরও অনেক দর্শনীয় বস্তু। তবে চোখ আটকে যায় টিপু সুলতানের ব্যবহৃত যুদ্ধাস্ত্র ও তলোয়ারে।
জাদুঘরের অপরদিকে রয়েছে জালকান্তেশ^রের মন্দির; স্থাপত্যশিল্পের আরেক অনুপম নিদর্শন। এছাড়াও রয়েছে মসজিদ ও গীর্জা। রয়েছে টিপু মহল, হায়দার মহল, ক্যান্ডি মহল। আছে পুলিশ স্কুল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
পূর্বকোণ/পিআর