চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫

কিডনি ডায়ালাইসিস থেকে ছড়াচ্ছে হেপাটাইটিস
ফাইল ছবি

কিডনি ডায়ালাইসিস থেকে ছড়াচ্ছে হেপাটাইটিস

ইমাম হোসাইন রাজু

২৬ মে, ২০২৫ | ১০:৫৮ পূর্বাহ্ণ

‘কিছুই বুঝি নাই, তবু হেপাটাইটিস হয়ে গেলো!’: পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা মফিজুল আলম পেশায় একজন বাবুর্চি। বয়স মাত্র ৪৫ বছর। দুই বছর আগে তার কিডনির সমস্যা ধরা পড়ে। বেঁচে থাকার জন্য তিনি চট্টগ্রামের স্যান্ডোর ডায়ালাইসিস সেন্টার ও আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ডায়ালাইসিস সেন্টারে কিডনি ডায়ালাইসিস শুরু করেন। এতে সাময়িকভাবে শরীরের ভারসাম্য কিছুটা ঠিক থাকলেও বছর না ঘুরতেই ধরা পড়ে নতুন এক আপদ- হেপাটাইটিস-বি। নতুন রোগ ধরা পড়ার পর থেকে মফিজুলের শারীরিক জটিলতা আরও বৃদ্ধি পায়। দুর্বলতা, জ্বর, হজমের সমস্যা, লিভারের জটিলতা- সবমিলিয়ে প্রতিদিনই যেন নতুন এক যুদ্ধ! চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার শরীর এখন আরও বেশি সংবেদনশীল; যেকোন সংক্রমণ সহজেই কাবু করে ফেলতে পারে মফিজুলকে।

 

কথার মাঝেই দুশ্চিন্তায় থাকা মফিজুল জানালেন, ‘কিডনি রোগ এমনিতেই কষ্টের। তার ওপর হেপাটাইটিস হয়েছে। বুঝতে পারছি না কীভাবে হলো। আমার তো কোন খারাপ অভ্যাসও নেই। তাহলে কেন এমনটা হলো?’ মফিজুল সন্দেহ করছেন, ডায়ালাইসিস চলাকালেই হয়তো হেপাটাইটিস-বি তার শরীরে এসেছে।

 

‘বিদেশ থেকে ফিরে পেলাম নতুন এক রোগ’: দীর্ঘদিন বিদেশে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে কিছুদিনের জন্য দেশে এসেছিলেন নুর খান। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। দেশে এসেই হঠাৎ কিডনির সমস্যা ধরা পড়ে। দুই বছর চার মাস ধরে তাকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয়েছে। নগরীর আল আরাফাহ ডায়ালাইসিস সেন্টারে সপ্তাহে দু’বার ডায়ালাইসিস করাতেন তিনি। এরইমধ্যে তার শরীরে ধরা পড়ে নতুন এক রোগ- হেপাটাইটিস-বি।

 

হতভম্ব নুর খান বলছিলেন, ডায়ালাইসিস শুরু করার কিছুদিন পরই ডাক্তার জানালেন হেপাটাইটিস-বি হয়েছে। আমি বুঝতেই পারলাম না এটা কীভাবে আমার শরীরে এলো। তবে তিনি নিশ্চিত ছিলেন, ডায়ালাইসিস শুরুর বেশ কিছুদিন পর তার শরীরে দেখা দিয়েছে ভাইরাসটি।

 

‘কিডনিও গেলো, ভাইরাসও ছাড়লো না’: ২০২০ সালে কিডনির সমস্যা ধরা পড়ে মোহাম্মদ হাছানের। বয়স তখন চল্লিশও হয়নি। নিয়ম করে ডায়ালাইসিস করাতেন। প্রথমে শরীর ঠিক ছিল। কিন্তু কিছুদিন পর তার শরীরে দেখা গেলো হেপাটাইটিস-বি। ঢাকার স্যান্ডোর ডায়ালাইসিস সেন্টারে চিকিৎসা শুরু করেছিলেন। এরপর নিয়মিত চিকিৎসা নেন নিজ শহর চট্টগ্রামে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তার শরীরে ধরা পড়ে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস। চিকিৎসকদের পরামর্শে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিতে হয় তাকে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করান। এখন তিনি বেঁচে আছেন প্রতিস্থাপিত কিডনির ওপর নির্ভর করে। তবে ভাইরাসটি এখনও থেকে গেছে তার শরীরে। হাছানের বিশ্বাস, ভাইরাসটি তার শরীরে ঢুকেছে ডায়ালাইসিস চলাকালীন সময়ে। তিনি বলেন, ডায়ালাইসিস করাতে গিয়েই এমন হয়েছে। জীবন কীভাবে পার করছি একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন।

 

মফিজুল, নুর খান কিংবা হাছান- একই অভিজ্ঞতার কথা জানান তিনজনই। কারোরই জানা নেই ঠিক কীভাবে শরীরে ঢুকলো এই প্রাণঘাতী ভাইরাস। তবে তাদের ধারণা, ডায়ালাইসিসের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে ছিল সংক্রমণের উৎস। চিকিৎসকদেরও সন্দেহ, ডায়ালাইসিস নেয়ার সময় মেশিন জীবাণুমুক্ত না করায় এমন সংক্রমণ হতে পারে।

 

ডায়ালাইসিস সেন্টার থেকেই ছড়াচ্ছে প্রাণঘাতী ভাইরাস: এই তিনজন ব্যতিক্রম নন। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনেও ডায়ালাইসিস পরবর্তীতে হেপাটাইটিস পজিটিভ রোগী পাওয়া গেছে। সেখানে দেখা যায়, একটি হাসপাতালের ডায়ালাইসিস সেন্টারে ডায়ালাইসিস পরবর্তীতে ১১ শতাংশ রোগী হেপাটাইটিস পজিটিভ হয়েছেন। এছাড়া আরেকটিতে এ হার ১ শতাংশ।

 

মফিজুল-নুর খান-হাছানের মতো আরও অনেক রোগী আছেন, যারা ডায়ালাইসিসে অবহেলার জন্য একটার পর একটা নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছেন। অনুসন্ধানকালে এমন অন্তত অর্ধশত রোগীর সন্ধান মিলেছে যারা ডায়ালাইসিস নিতে গিয়ে নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

 

বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ডায়ালাইসিসে থাকা ৭০ শতাংশ রোগী হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। গবেষকদের মতে, সংক্রমণের প্রধান কারণ ছিল, সঠিক গাইডলাইন অনুসরণ না করে ডায়ালাইসিস করা এবং অনিরাপদ রক্ত সঞ্চালন।

 

বিশ্বমানের ডায়ালাইসিসে যা হয়: আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, ডায়ালাইসিসে ব্যবহৃত ডায়ালাইজার, ব্লাডলাইন সেট, সিরিঞ্জ, হেপারিন, সুঁজ, ক্যাপ, কানেক্টর, ডায়ালাইসিস প্রক্রিয়ার সময় ব্যবহার করা প্যাড, গ্লাভস, গজ, ড্রেসিংসহ প্রতিটি উপকরণ একবার ব্যবহার করেই ফেলে দিতে হবে। রক্ত পরীক্ষা ছাড়া ডায়ালাইসিস করা যাবে না।

 

কিডনি রোগ ছাড়া অন্য রোগে আক্রান্তদের আলাদা রুমে, আলাদা মেশিনে ডায়ালাইসিস করতে হবে। সব রোগীর তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে। থাকতে হবে ডাটাবেজ। কিন্তু দেশের অধিকাংশ সেন্টারেই তা মানা হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব অনিয়মের পেছনে যেমন সেন্টারগুলোর দায়িত্বহীনতা রয়েছে, তেমনি কিছু রোগীর তথ্য গোপনের প্রবণতাও সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

 

কীভাবে ছড়ায় হেপাটাইটিস: কিডনি বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, সঠিক গাইডলাইন অনুসরণ না করে ডায়ালাইসিস পরিচালনার কারণেই এক রোগী থেকে অন্য রোগীর দেহে দ্রæত হেপাটাইটিস ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের মতে, একজন রোগীর ডায়ালাইসিসের ক্ষেত্রে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অত্যাবশ্যক হলেও দেশের বেশিরভাগ সরকারি ও বেসরকারি সেন্টারে সেসব মানা হচ্ছে না। চট্টগ্রামের বিভিন্ন ডায়ালাইসিস সেন্টারে ডায়ালাইসিস করাতে গিয়ে হেপাটাইটিস-বি কিংবা সি বা অন্যান্য সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন এমন অর্ধশত রোগীর তথ্য পেয়েছি আমরা।

 

এক ডায়ালাইজার ব্যবহার করা হচ্ছে ৬-৮ বার, টাকা নেয়া হয় নতুনের: ডায়ালাইসিসের সময় রক্ত ছেঁকে পুনরায় তা শরীরে প্রবেশ করাতে ডায়ালাইজার ব্যবহার করা হয়। আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুযায়ী, ডায়ালাইজার একবারই ব্যবহার করতে হয়। তবে বেশিরভাগ ডায়ালাইসিস সেন্টারে এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। ডায়ালাইজার কখনও কখনও দুই-তিনবার ব্যবহার করার অনুমোদন থাকে। তবে শর্ত থাকে, তা শতভাগ জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্যান্ডোর ডায়ালাইসিস সেন্টার, চমেক হাসপাতালের ডায়ালাইসিস সেন্টারসহ অনেক সেন্টারে একই ডায়ালাইজার ৬ থেকে ৮ বার পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে, যা রোগীর জীবনকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। অথচ একটি ডায়ালাইজারের দাম মাত্র ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা। প্রতিবার ডায়ালাইসিসের জন্য রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে তিন হাজার টাকার বেশি। সেই অর্থে নতুন ডায়ালাইজারসহ সব উপকরণ একবার ব্যবহার করার সুযোগ থাকলেও বাস্তবে ব্যবহার করা হয় একাধিকবার।

 

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিচতলায় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে পরিচালিত বেসরকারি স্যান্ডোর ডায়ালাইসিস সেন্টারে এমন অনিয়মের অভিযোগ মিলেছে। নিয়মিত ডায়ালাইসিস করানো একাধিক রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা জানেনই না তাদের রক্ত ছাঁকার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রটি আগে কতবার ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ ডায়ালাইসিসের প্রতিটি তথ্য রেজিস্ট্রি করে রাখার নিয়ম। মোহাম্মদ হাছানের কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম, তার আগে একই উপকরণ অন্য কারও ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল কিনা। তিনি বললেন, সপ্তাহে দু’বার এসে শুয়ে পড়ি; জানি না যন্ত্রটা কতবার ব্যবহার করা হয়েছে।

 

ডায়ালাইসিস করাতে গিয়ে মৃত্যুর অভিযোগ: স্যান্ডোর ডায়ালাইসিস সেন্টারে চিকিৎসা নিতে গিয়ে এক রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। পরিবার দাবি করছে, ২০২২ সালে এই প্রতিষ্ঠানেই ডায়ালাইসিস করানোর সময় মারা যান সাফিয়া খানম নামে এক নারী। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।

 

সাফিয়ার ছেলে তানভীর চৌধুরী বলেন, ‘তাদের দায়িত্বে কী পরিমাণ অবহেলা হলে একজন সুস্থ মানুষ এভাবে মারা যায়! আমি এখনও মায়ের মুখ ভুলতে পারিনি।’ তানভীর জানান, ঘটনার তদন্ত হলেও সেন্টার কর্তৃপক্ষ কোন সিসিটিভি ফুটেজ দেয়নি। এমনকি আদালতের নির্দেশও তারা উপেক্ষা করেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

 

একাধিকবার ডায়ালাইজার ব্যবহারের বিষয়ে স্যান্ডোর ডায়ালাইসিস সেন্টারে দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার মো. তায়েফ রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ ব্যপারে কোন কথা বলতে রাজি হননি। হেপাটাইটিস আক্রান্ত রোগীদের তথ্য জানতে চাওয়া হলেও এড়িয়ে যান তিনি।

 

তবে ডায়ালাইজার একাধিকবার ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে স্যান্ডোর ডায়ালাইসিস সেন্টারের জেনারেল ম্যানেজার নাজমুল হাছান বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ডায়ালাইজার রিইউজ করার নিয়ম আছে, সেটি ৩ থেকে ৪ বার হতে পারে। অনেক সময় মেশিন আমাকে যতক্ষণ সাপোর্ট দেবে, ততক্ষণ ব্যবহার করা যাবে। রোগীর স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই এটি করা।

 

যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করতে অবহেলা, ঝুঁকিতে রোগীরা: নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি ডায়ালাইসিস শেষে মেশিন জীবাণুমুক্ত করতে হয় সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট দিয়ে। কিন্তু বেশিরভাগ সেন্টারেই এ প্রক্রিয়া সঠিকভাবে মানা হয় না। অন্তত তিনটি সেন্টারে সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অনেক নার্স ও টেকনিশিয়ান এ পদ্ধতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখেন না। ১৮ মে দুপুর ১২টা ১৫ মিনিট। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের ডায়ালাইসিস সেন্টারে আমরা ঘণ্টা খানেক দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করি কী করেন সেবাদানকারীরা। এ সময় নজর রাখি সেন্টারটির ১ ও ২ নম্বর শয্যার মাঝে থাকা একটি ডায়ালাইসিস মেশিনের দিকে। এক নার্স ডায়ালাইজার, স্যালাইন সেটসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম ঠিকঠাক করছিলেন।

 

এদিকে, শয্যায় তখনও শুয়ে ছিলেন সদ্য ডায়ালাইসিস শেষ করা এক রোগী। দুই মিনিটের মধ্যেই তিনি উঠে পড়লে অপেক্ষমাণ আরেক রোগীকে এনে ওই একই বেডে শোয়ানো হয়। পুরো প্রক্রিয়া- একজনের ডায়ালাইসিস শেষ, শয্যা খালি হওয়া এবং নতুন রোগীকে প্রস্তুত করতে মোটামুটি ২০ মিনিট সময় নেয়া হয়। তবে এ সময়ের মধ্যে মেশিন যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে কিনা সেটি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি।

 

নতুন রোগীর শরীরে স্যালাইন লাইন সংযুক্ত করে ডায়ালাইসিস মেশিন চালুর সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যায়, মেশিনে লাল সংকেত বাতি জ্বলে উঠছে। কয়েক মুহূর্ত পর আরেকজন স্টাফ এসে ডায়ালাইজার এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশ নাড়াচাড়া করে সেটি ঠিক করার চেষ্টা করেন। তবে সব ঠিকঠাক করার মাত্র ২৫ মিনিটের মাথায় আবারও সংকেত দেখা দেয়। এ সময় পরিস্থিতি সামাল দিতে একাধিকবার হাত দিয়ে ডায়ালাইজারের উপর ‘থাপ্পড়’ মারতেও দেখা যায় সংশ্লিষ্ট কর্মীকে।

 

চমেক হাসপাতালের কিডনি ডায়ালাইসিস ওয়ার্ডে গিয়েও একই চিত্রের মুখোমুখি হই আমরা। যেখানে সযত্নে জীবাণুমুক্ত থাকার কথা, সেখানে চলছে চরম অব্যবস্থাপনা। রোগীদের ব্যবহৃত ডায়ালাইজার ও স্যালাইন সেটগুলো একটি সাধারণ বেসিনেই ধুয়ে ফেলা হচ্ছে। শুধু পানি দিয়ে সেসব পরিষ্কার করার দৃশ্য চোখে পড়ে। অথচ সেই জায়গাটির চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা ময়লা আবর্জনা। আর এসব সরঞ্জামই পরবর্তীতে ব্যবহৃত হচ্ছে অন্য রোগীদের শরীরে। ওয়ার্ডটিতে রোগীরা অবাধে চলাফেরা করছিলেন। কারও মুখে মাস্ক ছিল না, স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। যে যেখানে পারছে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে সময় কাটাচ্ছে। স্পর্শকাতর এই ওয়ার্ডে এক শয্যার পাশে তিন-চারজন স্বজনের ভিড় লেগেই আছে। শয্যার উপর শুয়ে-বসেও সময় কাটাতে দেখা যায় তিন-চারজনকে। অনেকে আবার শয্যার পাশেই আবর্জনা ফেলে রাখছে। নেই কোন ধরনের তদারকি, নেই নিয়ম মানার প্রবণতাও।

 

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ও গবেষক ডা. রজত শংকর রায় বিশ্বাসের সাথে এ নিয়ে কথা বললে তিনি জানান, ডায়ালাইসিস মেশিন যদি শতভাগ জীবাণুমুক্ত না করা হয় তাহলে হেপাটাইটিস ছড়ানো রোধ করা সম্ভব নয়। একটি ফোঁটা রক্ত থেকেও ভাইরাস ছড়াতে পারে।

 

গাইডলাইন অনুসরণে অনীহা কেন: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, গরিব দেশ হিসেবে আমরা চেষ্টা করছি ঠিকই; তবে শতভাগ গাইডলাইন মানা সম্ভব নয়। কারণ এতে খরচ অনেক বেড়ে যাবে।

 

হেপাটাইটিস নির্মূলে চিকিৎসক-সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের হেপাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ। কিডনি ডায়ালাইসিস রোগীদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, বহু রোগী পাচ্ছি, যারা ডায়ালাইসিস পরবর্তীতে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এজন্য নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ও সঠিক গাইডলাইন মেনে ডায়ালাইসিস করতে হবে। তা নাহলে কোনভাবেই এ রোগ ছড়ানো থেকে বাঁচা সম্ভব হবে না।

 

রোগীর মানসিকতা ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা: চিকিৎসকদের মতে, অনেক রোগী নিজের হেপাটাইটিস সংক্রমণের তথ্য গোপন করেন। আবার অনেক সেন্টার নিয়ম অনুযায়ী রক্ত পরীক্ষা ছাড়াই ডায়ালাইসিস করছে। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে রোগীরাও নিরাপদ ডায়ালাইসিসের জন্য অতিরিক্ত খরচ বহন করতে পারেন না। ফলে চাইলেও অনেক কিছু করা সম্ভব হয় না।

 

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের কিডনি রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. নুরুল হুদা বলেন, অনেক রোগী ভাবেন, সংক্রমণের কথা জানালে হয়তো চিকিৎসা পেতে সমস্যায় পড়বেন বা আলাদা করে রাখা হবে। আবার আর্থিক চাপের কথাও ভাবেন। ফলে অনেক সময় তারা ইচ্ছে করেই তথ্য গোপন করেন। এতে নিজের জীবন যেমন ঝুঁকির মুখে পড়ে, তেমনি একই সেশনের অন্য রোগীদেরও আক্রান্ত হওয়ার ভয় থেকে যায়।

 

অবহেলা এবং প্রশিক্ষণের ঘাটতি, বাড়ছে ঝুঁকি: ডায়ালাইসিস সেন্টারগুলোর একটা বড় সংকট প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব। বিশেষ করে নার্স ও টেকনিশিয়ানদের অনেকে সংক্রমণ প্রতিরোধ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পান না। ফলে অনেক সময় তারা ভুল পদ্ধতিতে যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করেন বা সঠিকভাবে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করেন না।

 

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ইমরান বিন ইউনুস বলেন, ডায়ালাইসিস সেন্টারগুলোতে দায়িত্বে থাকা টেকনোলজিস্ট বা টেকনিশিয়ানরা অনেক সময় দায়িত্বে চরম অবহেলা করেন। এই অবহেলা ও ঘাটতির ফলেই একজন রোগী থেকে আরেকজনের শরীরে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। তার মতে, দিন শেষে সুস্থ হওয়ার চেয়ে অসুস্থতাই যেন বাড়ছে এসব রোগীর।

 

কারও কাছেই নেই সঠিক তথ্য: চট্টগ্রামে কতজন রোগী ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন বা কতটি সেন্টার আছে- এর কোনও নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই স্বাস্থ্য বিভাগ বা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কাছে। পূর্বকোণের অনুসন্ধানে শুধুমাত্র মহানগরেই ২১টি সেন্টারের তথ্য পাওয়া গেছে। অথচ সিভিল সার্জন কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে পাওয়া গেছে মাত্র ৯টি সেন্টারের নাম।

 

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, নগরীর ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ ডায়ালাইসিস সেন্টারেই হেপাটাইটিস পজিটিভ রোগীর ডায়ালাইসিস করা হয়। ৭টি প্রতিষ্ঠানে হেপাটাইটিস আক্রান্ত রোগীর হার সর্বনিম্ন ৪ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১৬ দশমিক ২১ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া দুটি সেন্টারে ডায়ালাইসিস নেওয়ার পর রোগীর হেপাটাইটিস পজিটিভ ধরা পড়ার ঘটনাও রয়েছে। ওই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটিতে এ হার ১১ শতাংশ এবং অন্যটিতে ১ শতাংশ।

 

কোন ডায়ালাইসিস সেন্টারেই রোগীদের সংক্রামক রোগসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয় না, যা রোগীদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও এ খাতে নজরদারি ও তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। অধ্যাপক ডা. নুরুল হুদা বলেন, হাসপাতালে রোগীদের উপর একটি গবেষণা চালানো হয়। তাতে প্রায় ৭০ শতাংশ রোগীর হেপাটাইটিস পজিটিভ পাওয়া যায়।

 

দায় কার, কর্মীদের না কর্তৃপক্ষের: খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ ডায়ালাইসিস সেন্টারে তদারকি খুবই সীমিত বা নেই বললেই চলে। ফলে গাইডলাইন না মানার প্রবণতা বাড়ছে দিন দিন। সরকারি নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর মনিটরিং ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এই অবস্থা আরও গুরুতর হয়েছে।

 

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা নিয়মিতই পরিদর্শন করছি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জনবল সংকটের কারণে মনিটরিং কিছুটা ব্যাহত হলেও তদারকি অব্যাহত আছে। পরিস্থিতি আরও ভালো করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।

 

উপায় কী: সব ডায়ালাইসিস সেন্টারে রুটিন মনিটরিং বাধ্যতামূলক করা, হেপাটাইটিস আক্রান্তদের জন্য আলাদা ইউনিট মেশিন ও ডায়ালাইজারের রেকর্ড বাধ্যতামূলক করা, রোগীর রক্ত পরীক্ষা, ফলাফল সংরক্ষণ ও মনিটরিং করা, আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করে যন্ত্রাংশ জীবাণুমুক্ত করা, নিয়মিত পরিদর্শন ও শাস্তির ব্যবস্থা চালু করা দরকার।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবশ্যই অবশ্যই সকল সরকারি-বেসরকারি ডায়ালাইসিস সেন্টারে রুটিন মনিটরিং বাধ্যতামূলক করতে হবে। হেপাটাইটিস আক্রান্তদের জন্য আলাদা ইউনিট রাখতে হবে। প্রতিটি মেশিন ও ডায়ালাইজার ব্যবহারের রেকর্ড বাধ্যতামূলক করতে হবে। নিয়মিত সেবা নেয়া রোগীর রক্ত পরীক্ষা, ফলাফল সংরক্ষণ ও মনিটরিং করতে হবে। আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে হবে যন্ত্রাংশ জীবাণুমুক্তকরণে। আর নিয়মিত পরিদর্শন, লাইসেন্স বাতিল এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে অব্যবস্থাপনার এ ধারা চলতেই থাকবে।

 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ডায়ালাইসিস সেন্টার পরিচালনায় নিয়মিত মনিটরিং, জরুরি ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার তৈরি এবং স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। নাহলে ডায়ালাইসিস রোগীদের সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, যা নগরজুড়ে জনস্বাস্থ্য সংকট তৈরি করবে।

 

রোগীদের মাঝে ভয়: হেপাটাইটিস ধরা পড়ার পর নুর খান ও মফিজুল আলম দু’জনই এখন ডায়ালাইসিসের পাশাপাশি নিয়মিত এন্টিভাইরাল ওষুধ খাচ্ছেন। তাদের জীবনধারায় এসেছে পরিবর্তন, ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। কিন্তু স্বাস্থ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে তারা এখনও সন্দিহান।

 

মফিজুলের পরিবারের আর্থিক অবস্থা আগে থেকেই অসচ্ছল ছিল, এখন কিডনি রোগের ওপর আরেক অসুখের চিকিৎসা ব্যয় সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে তার জন্য। হতাশ হয়ে মফিজুল বলেন, জানি না, আর কতদিন চলতে পারবো এভাবে।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট