চট্টগ্রাম বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

‘লকডাউনের’ চেহারা পাল্টাতে হবে

ইফতেখারুল ইসলাম

৩০ জুন, ২০২১ | ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ

আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে সারাদেশে কঠোর লকডাউন শুরু হচ্ছে। দেশে করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে দেশব্যাপী এবং এলাকাভিত্তিক লকডাউন ঘোষণা করা হলেও তা পালন হয়েছে অনেকটা ঢিলেঢালাভাবে। যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়ায় লকডাউন শব্দটি নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সলিড লকডাউনের মাধ্যমে ভারত সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। আমাদেরও সে পথে হাঁটতে হবে। অকারণে বের হলেই বড় অংকের স্পট জরিমানা এবং প্রয়োজনে জেলে পাঠাতে হবে। জীবিকার তাগিদে যারা বের হয় তাদেরকে ঘরে রাখার জন্য সরকারকে পর্যাপ্ত সাহায্যের ব্যবস্থা করতে হবে। তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক, সামাজিক সংগঠনকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। দলীয় মনোভাব পরিহার করে সবাইকে নিয়ে এই যুদ্ধে জয়ী হতে হবে।

 

জীবিকার তাগিদে বাইরে বের হওয়া লোকদের সাহায্যে হাত বাড়াতে হবে 

প্রফেসর সিকান্দার খান

সনাক, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দর খান বলেন, যাদের চলাফেরা আমরা সীমিত করতে চাইছি তাদেরকে পক্ষে নিতে হবে। সবচেয়ে ভাল হতো তাদেরকে সচেতন করা যেত। নিজের স্বার্থেই এটা মানতে হবে। এটা করা গেলে অর্ধেক যুদ্ধ জয় করা যেত। যারা লকডাউন কার্যকর করার দায়িত্বে থাকেন। তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি আছেন এই ধরনের পরিস্থিতিকে অর্থ আয়ের উৎস হিসেবে গ্রহণ করে। প্রশাসনকে এই জায়গায় শক্ত হতে হবে। তাদের মোটিভেট করতে হবে। করোনাকে আর হেলাফেলার সুযোগ নেই। এসব সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে সমস্যা সমাধান করতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, যারা জীবিকার তাগিদে বের হচ্ছেন সরকারের উচিত তাদেরকে সামর্থ্যমত সাহায্য করা। নি¤œ আয়ের লোকদের সাহায্য করার জন্য সরকারকে সবখান থেকে স্বেচ্ছাসেবক নিতে হবে। দলীয় মনোভাব পরিহার করে সবাইকে নিয়ে যুদ্ধে নামতে হবে। সাহায্য দেয়ার সময় দলীয় পরিচয় বিবেচনা করা যাবে না। সংকট পার না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে নিয়েই কাজ করতে হবে। এই পরিস্থিতি সরকারকেই সৃষ্টি করতে হবে। এক মানুষ আরেক মানুষের ভাই এই বোধটা সবার মাঝে জাগাতে হবে। কারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়েই এই সংকট মোকাবেলা করতে হবে। তাই মানুষকে সঙ্গে নেয়ার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সাধারণ মানুষকে আস্থায় আনতে না পারলে সফলতা আসা কঠিন।

 

লকডাউন সফল করতে হলে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে 

ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির

স্বাস্থ্য দপ্তর, চট্টগ্রাম বিভাগের পরিচালক, ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির বলেন, প্রথমেই মানুষকে বুঝতে হবে লকডাউন কি। সাধারণ মানুষ তা না বুঝলে জোর করে লকডাউন সফল হবে না। লকডাউন কি? এই ধারণা সৃষ্টি করতে হলে এই কাজের সাথে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এখানে জনপ্রতিনিধি বলতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর, মহল্লার সর্দার এদেরকেই সম্পৃক্ত করতে হবে। মহল্লায় মহল্লায় মানুষকে বুঝাতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে চিকিৎসক, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক নেতা আছেন। স্বাভাবিক সময়ে তারা নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। কিন্তু লকডাউন সফল করার জন্য তাদের কোন সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে তাদেরকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। গ্রাম পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পর্যায়ে কাজ করতে হবে। কারণ এই স্তরে কাজ করলে সবচেয়ে বেশি সুফল মিলবে। আগে মেম্বারদের বুঝাতে হবে লকডাউন কি এবং কেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যনরা তাদেরকে বুঝাতে পারেন। জুম কনফারেন্সের মাধ্যমেও একাজ করতে পারেন। তারা সক্রিয়ভাবে লকডাউন বাস্তবায়নে কাজ করলে সবচেয়ে বেশি সুফল মিলবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত হবে সরকারের কঠোর নির্দেশনা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা। কোন অবস্থাতেই ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া সিটি কর্পোরেশন, স্বাস্থ্য বিভাগসহ প্রতিটি সেক্টরকে কাজ করতে হবে।
জরুরি পরিষেবা চালু রাখার ক্ষেত্রে একে অপরের প্রতি সহানুভূতির সাথে কাজ করতে হবে। যেমন চিকিৎসকদের যদি কর্মস্থলে যেতে অসুবিধা হয়, যানবাহনের সংকট হয় তাহলে সেখানে পুলিশকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদেরকে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

 

যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করে গার্মেন্টস কারখানা চালু রাখা সম্ভব 

রকিবুল আলম চৌধুরী

বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি, রকিবুল আলম চৌধুরী কঠোর লকডাউনে পোশাক কারখানা খোলা রাখা প্রসঙ্গে বলেন, একটি পোশাক কারখানায় কয়েক হাজার কর্মী কাজ করেন। তাদের সবার জন্য আবাসিক ব্যবস্থা করা কোন কারখানার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রতিটি কারখানার ৮০ ভাগ পোশাক কর্মী সাধারণত কারখানার আশেপাশেই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। কারখানা খোলা রাখলে তাদের চাকরিতে আসতে সমস্যা হবে না। এর বাইরে পোশাক কারখানায় প্রশাসনিক অল্পসংখ্যক কর্মকর্তা কাজ করেন যারা অফিস থেকে দূরে বাসা নিয়ে থাকেন। ওইসব কর্মকর্তা অফিসের গাড়িতেই যাতায়াত করেন। তাদের জন্য বিশেষ পাসের ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা চলছে। আশা করি, সরকার বিশেষ পাসের ব্যবস্থা করবে। করোনার গত প্রায় ১৬ মাসের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কঠোর লকডাউনেও পোশাক কারখানা খোলা রাখলে স্বাস্থ্যবিধি ও যাতায়াতে কোন সমস্যা হয়নি। সড়কে শুধু পোশাক কর্মীদের হয়রানির না করলেই হলো। বন্দর-কাস্টমস যেভাবে খোলা রাখা হচ্ছে, আমরাও সেভাবে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা খোলা রাখবো।
সাধারণ মানুষ মনে করেন, কঠোর লকডাউনে গার্মেন্টস খোলা রাখা হলে কঠোর লকডাউনের সুফল পাওয়া যাবে না।
এ প্রসঙ্গে রকিবুল আলম বলেন, কারখানা খোলা না রাখা হলে পোশাক কর্মীরা বাড়ি যাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বে। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে নানা পরিবহন ব্যবহার করে গ্রামে যাবে। আবার বেতন নেওয়ার সময় গ্রাম থেকে শহরে আসবে। এতে করোনা শহর থেকে গ্রামে ও গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আরো বেশি থাকে। এরচেয়ে কারখানা খোলা রাখাই অধিকতর নিরাপদ। কারণ প্রতিটি কারখানায় কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করেই খোলা রাখা হয়। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গার্মেন্টস খোলা রাখা না হলে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়ার মত খুব বেশি পণ্য নেই। আর গার্মেন্টস খোলা রাখা না হলে বন্দর-কাস্টমস খোলা রাখারও যৌক্তিকতা নেই।

 

প্রয়োজনে জেল ও জরিমানার ব্যবস্থা রাখতে হবে 

ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলেন, লকডাউন সফল করার জন্য প্রথম ভূমিকা রাখতে হবে সাধারণ জনগণকে। তারা যেন অকারণে ঘর থেকে বের না হয়। জরুরি কাজে বের হলেও তা যেন স্বল্প সময়ের জন্য হয়। দ্বিতীয়ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত মনিটরিং এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জরুরি পরিষেবাসমূহ লকডাউনের আওতায় নেই।
অতীতে দেখা গেছে, অনেকেই জরুরি পরিষেবার নাম করে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছে। এটা বন্ধ করতে হবে। এমনকি কোন চিকিৎসকের গাড়িতে শুধুমাত্র স্টিকার দিয়ে চলতে দেয়া উচিত হবে না। গাড়ির ভিতরে যিনি থাকবেন, তার আইডি কার্ড সঙ্গে রাখা উচিত হবে। অর্থাৎ চিকিৎসক বা অন্যকোন জরুরি পরিষেবার স্টিকার ব্যবহার করে যাতে অন্য কেউ রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রয়োজনে স্পট জরিমানা এবং এক-দুই দিনের জেলও দিতে হবে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার যে হারে বেড়েছিল সলিড লকডাউনের মাধ্যমে তারা তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে।

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট