‘বাবা কোন মার্কায় ভোট দেবেন?’ বাবার কাছে বার বার প্রশ্নটা করে যাচ্ছে ৭ বছর বয়সী ছেলে। কিন্তু বাবার মুখে কোন উত্তর মিলছে না।
পাশের সিটে মধ্যবয়সী দুই ব্যক্তিও ভোটের আলোচনায় সরব। ভোটের পরিবেশ, ভাঙচুর ও সহিংসতা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-বিশ্লেষণ। গতকাল শনিবার সকাল ১১টায় বাঁশখালী যাওয়ার পথে বাসে চলছিল এসব আলোচনা।
পাশাপাশি সিটে বসে দীর্ঘক্ষণ কথা হয় মাওলানা আবুল কাসেমের সঙ্গে। তিনি ফটিকছড়ির বিবিরহাট এলাকার একটি মসজিদে ইমামতি করেন। তিনি জানান, ভোট দিতে বাড়ি যাবেন না। ভোটের পরিবেশ বুঝে পরিবার-পরিজন ভোটকেন্দ্রে যাবে।
আনোয়ারা-বাঁশখালী তৈলারদ্বীপ সেতু পেরিয়ে বাঁশখালী ঢুকতেই ভোটের আমেজ দেখা যায়। রাস্তার দুই ধার ও গাছে গাছে ঝুলছে নির্বাচনী পোস্টার-ব্যানার। চানপুর বাজারে সড়ক ও উপসড়ক পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে গেছে। নৌকা, ঈগল, ট্রাকের পোস্টার-ব্যানারের ভিড়ে অন্য প্রার্থীদের পোস্টার-ব্যানার ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। চাঁদপুর বাজার থেকে বাঁশখালী উপজেলা সদর-থানা এলাকা ও জলদীর আশপাশে তিন প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প ও প্রচার দেখা যায়।
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, ভোটে ১০ জন প্রার্থী থাকলেও তিনজনের প্রচার-প্রচারণা ও গণসংযোগ চোখে পড়ার মতো। অন্য প্রার্থীদের পোস্টার-ব্যানার থাকলেও প্রচারে পিছিয়ে রয়েছেন। বিকেল ৩টা থেকে শুরু মাইকিং। নৌকা ও ঈগল প্রতীকের পক্ষে ব্যাপক মাইকিং শুরু হয়।
বিভিন্ন এলাকার ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রার্থী ১০ জন হলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও ঈগল প্রতীকের প্রার্থী মুজিবুর রহমান এবং নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের মধ্যে। দুই প্রার্থী প্রচার-প্রচারণা ও গণসংযোগে চষে বেড়াচ্ছেন। তাদের ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ভোটের মাঠ। এছাড়াও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল্লাহ কবির লিটনের (ট্রাক) প্রচারণাও চোখে পড়ার মতো।
তিন প্রার্থীকে ঘিরে ত্রিধারায় আ. লীগ :
আওয়ামী লীগ ঘরানার তিন প্রার্থীকে ঘিরে তিন ধারায় বিভক্ত দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা। অংশ নিচ্ছেন তিন প্রার্থীর প্রচারণায়। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মুজিবুর রহমানকে ঘিরে প্রচারে আছেন বেশিরভাগ নেতাকর্মী। তবে আবদুল্লাহ কবির লিটনের পক্ষে এক মন্ত্রী স্থানীয় নেতাকর্মী ও চেয়ারম্যানদের চাপ দিচ্ছেন বলে শোনা যায়। সেই হিসেবে আওয়ামী লীগের ভোট তিন ভাগে ভাগ হবে বলে জানান ভোটার ও বাসিন্দারা।
১৪ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে এ আসন গঠিত। ভোটের হিসাব-নিকাশে দল-ব্যক্তি চাপিয়ে আঞ্চলিকতা বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে বলে জানান স্থানীয়রা। সে হিসাবে দেখা যায়, এমপি মোস্তাফিজের বাড়ি মধ্য বাঁশখালীর সরল ইউনিয়নে। লিটনের বাড়ি উত্তরের পুকুরিয়ায়। আর মুজিবের বাড়ি দক্ষিণের পুঁইছড়িতে। বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে ভোটের হিসাবে আঞ্চলিকতা প্রাধান্য পেয়েছিল। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটবে না বলে জানান ভোটাররা।
আওয়ামী লীগের বিএনপি-জামায়াতপ্রীতি :
বাঁশখালীকে বিএনপি-জামায়াতের ঘাঁটি বলা হয়। জাতীয় ও উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি ঘরানার প্রার্থীরা বিভিন্ন নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। বাঁশখালীর দক্ষিণাংশে জামায়াত-বিএনপির শক্ত অবস্থান রয়েছে। আওয়ামী লীগের ভোট তিন ভাগে ভাগ হবে। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের ভোট যে প্রার্থী টানতে পারবেন, সে প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা বেশি। তাই বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের ভোট টানার চেষ্টা করছেন তিন প্রার্থী।
তবে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক ও ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয়-সন্দেহ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঘরানার একাধিক নেতা গতকাল বলেন, ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভাসহ বিভিন্ন নির্বাচনে এই ঘরানার ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যায়নি। এছাড়াও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন ও ভোটদানে বিরত থাকার জন্য ভোটারদের কাছে লিফলেট বিতরণ করছে বিএনপি ও জামায়াত। তবে আত্মীয়স্বজনদের টানে কিছু সমর্থক ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে বলে জানান তারা।
বিএনপি-জামায়াত ছাড়া এবার নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোটাররাও কিছুটা ফ্যাক্টর হবে। কারণ সংখ্যালঘু ভোটাররা আওয়ামী লীগের ভোট-ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এবার শক্তিশালী তিন প্রার্থীই আওয়ামী লীগ ঘরানার। তাই সংখ্যালঘুদের ভোটও তিন ভাগে ভাগ হবে।
ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাঁশখালীর প্রধান সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার দাবি দীর্ঘদিনের। এছাড়া উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাটের উন্নয়নের দাবি থাকলেও কাক্ষিত উন্নয়ন হয়নি বলে জানান ভোটাররা। ভোটের মাঠে এসব দাবি প্রাধান্য পাবে।
প্রার্থী ১০ জন :
এই আসনে মোট প্রার্থী ১০ জন। আওয়ামী লীগ ঘরানার তিন প্রার্থী ছাড়াও আছেন বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মহিউল আলম চৌধুরী (মোমবাতি), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের আব্দুল মালেক (চেয়ার), বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) আশীষ কুমার শীল (কুঁড়েঘর), বাংলাদেশ কংগ্রেসের এম জিল্লুর করিম শরীফি (ডাব), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) মামুন আবছার চৌধুরী (আম), ইসলামী ঐক্যজোটের শফকত হোসাইন চাটগামী (মিনার) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. খালেকুজ্জামান (বেঞ্চ)।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন কর্মকর্তাকে মারধর, কেন্দ্রীয় নেতাকে নিয়ে ‘অশালীন’ মন্তব্য, প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মিছিল ও মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করার ঘটনায় সমালোচিত হন তিনি। এবার আচরণবিধি লঙ্ঘন ও সাংবাদিককে মারধরের ঘটনায় মামলা করেছে নির্বাচন কমিশন।
আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মতবিনিময় :
গতকাল শনিবার বিকেলে প্রার্থীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মতবিনিময় সভা করেছেন জেলা পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ। সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, পেশাদারিত্ব বজায় রেখে ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন করতে হবে। বিন্দুমাত্র পক্ষপাতিত্বের সুযোগ নেই। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার সবাই মিলে আমরা নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও সুন্দর করার জন্য দায়িত্ব পালন করবো। কোন বিরূপ পরিবেশ তৈরি হবে না। ভোটাররা নিরাপদে, নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে আসবে। ভোটাররা যাকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করবেন তিনিই হবেন প্রকৃত জনপ্রতিনিধি।
পূর্বকোণ/জেইউ