২৩ বছরের টগবগে তরুণ-ফয়েজ উদ্দিন। বেড়ে ওঠা পাহাড় আর লেকের অপরূপ শহর রাঙামাটিতে। শৈশবের প্রতিটি দিন তাই কেটেছে প্রকৃতির নিঃশব্দ কোলাহলে। হয়তো তাই স্বপ্নটাও গড়েছেন পাহাড়ের মতো বিশাল আর লেকের মতো প্রশান্ত। সেই স্বপ্নই এই তরুণকে পৌঁছে দিচ্ছে ‘হাজার দ্বীপের দেশ’খ্যাত ইন্দোনেশিয়ায়। যেখানে তিনি কথা বলবেন পাহাড়ের হয়ে, বাংলাদেশের হয়ে। বিশ্বের নানা দেশের তরুণদের নিয়ে আগামী ১৩ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় বসছে ‘স্কিল টু সাক্সেড (এস টু এস) গ্লোবাল ইয়ুথ সামিট-২০২৫’। এই আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবেন চট্টগ্রামের ফয়েজ। কনফারেন্সে যোগ দিতে আগামী ১২ জুলাই জাকার্তার বিমান ধরবেন এই তরুণ।
ছোট থেকেই স্কাউটের প্রতি ঝোঁক ছিল ফয়েজের। সেই দুর্দমনীয় ইচ্ছে থেকেই ২০১৫ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কাউট আন্দোলনে যুক্ত হন তিনি। পাহাড়ের মানুষের জন্য কাজ করার সেই শুরু। ২০১৭ সালে পার্বত্য অঞ্চলের সেই ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধসের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফয়েজ রাতদিন কাজ করেছেন বিপন্ন মানুষদের উদ্ধারে। এরপর পড়াশোনার জন্য ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন ফয়েজ। শহরে এসেই সামাজিক ও মানবিক কাজ চালিয়ে নিতে যুক্ত হন ‘লাল সবুজ সোসাইটি’ নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে। কাজ করতে গিয়ে একসময় পরিচয় ঘটে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব থিয়েটার আর্টসের (বিটা) সঙ্গে। ২০২৪ সালে সেখানে ইয়ুথ অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে যুক্ত হওয়ার পর তার কাজ আরও বিস্তৃত হয়। সেখানে বেকার যুবদকের প্রশিক্ষণ, চাকরির সুযোগ, জলবায়ু সচেতনতা কার্যক্রম, উদ্যোক্তা তৈরি, বাল্যবিবাহ, সমাজ উন্নয়নসহ নানা বিষয়ে কাজ করেন তিনি।
বিটার মাধ্যমেই সেভ দ্য চিলড্রেনের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হন ফয়েজ। সেখানে নিজেকে প্রমাণ করে এবার অর্জন করলেন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নেওয়ার সোনালি টিকিট। পূর্বকোণের কাছে কনফারেন্সে সুযোগ পাওয়ার সেই গল্প শোনান ফয়েজ। বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২০০ জন ইয়ুথ এডভাইজারি কাউন্সিলের সদস্যের মধ্যে থেকে বিভিন্ন মানদণ্ডের ভিত্তিতে ছয় জেলার ছয়জনকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করা হয়। আমরা ছয়জন টানা ৫ মাস ধরে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। এই সময়ে আমরা জেলা পর্যায়ে নানা সামাজিক ও উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। প্রতিটি কার্যক্রম শেষে আমাদের তৈরি করা প্রতিবেদন উপস্থাপনা এবং বিভিন্ন দায়িত্বশীল কাজের ভিত্তিতে সেভ দ্য চিলড্রেন আমাদের কাজের অগ্রগতি ও প্রভাব বিশ্লেষণ করে। এই ৫ মাসের নিরলস পরিশ্রম ও পর্যালোচনার পর গত ২৬ এপ্রিল আমাদের চূড়ান্ত মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সবকিছু বিবেচনার পর আমি ও সাতক্ষীরার রিজমাকে স্কিল টু সাক্সেড (এস টু এস) গ্লোবাল ইয়ুথ সামিট-২০২৫ এর-গ্লোবাল অ্যাম্বাসেডর হিসেবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়।’
সম্মেলনের মঞ্চে কী বলবেন, জিজ্ঞেস করতেই ফয়েজের চোখে আগুনের দীপ্তি। বললেন, ‘বাংলাদেশের তরুণদের স্বপ্ন, চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা তুলে ধরবো। আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, শান্তি ও সহিষ্ণুতার বার্তা পৌঁছে দিতে চাই বিশ্বমঞ্চে।’
পাহাড় থেকে উঠে এসে ফয়েজের স্বপ্ন ছোঁয়ার এই দীর্ঘ সফর সহজ ছিল না। নিজের কঠোর পরিশ্রম আর চূড়ান্ত ধৈর্য্য তো ছিলই; ফয়েজের সঙ্গে ছিল অনেকের সহযোগিতা-অনুপ্রেরণা-ভালোবাসা। ফয়েজ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন সেই সব মানুষদের।
একটা স্বপ্ন ছোঁয়ার পর ফয়েজ এখন চোখ ফেলেছেন নতুন স্বপ্নের পৃথিবীতে। গড়তে চান একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। যেটি কথা বলবে তরুণদের হয়ে, জলবায়ু সমস্যার সমাধানে আর শান্তি প্রতিষ্ঠায়।
১০ বছর আগে পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা স্বপ্নের বীজ রোপিত হয়েছিল। ফয়েজের সেই স্বপ্ন আজ ছড়িয়ে পড়ছে হাজার দ্বীপের দেশে-বাংলাদেশের মুখ হয়ে। মানুষের জন্য কাজ করে গেলে, একদিন হয়তো এভাবেই হয় স্বপ্নপূরণ!
পূর্বকোণ/ইবনুর