চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আদালতে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন

পলাশ একাই বিমান ছিনতাই করেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

২৪ জানুয়ারি, ২০২০ | ৮:২৫ পূর্বাহ্ণ

একটি খেলনা পিস্তল ও বোমা সদৃশ বস্তু নিয়ে একাই আস্ত একটি বিমান ছিনতাই করতে চেয়েছিলো পলাশ আহমেদ। ঢাকা থেকে রওনা হয়ে মাঝ আকাশে বিমান ছিনতাইচেষ্টার মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) আদালতে জমা দিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের প্রসিকিউশন শাখায় গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে অভিযোগপত্রটি জমা দেওয়া হয়। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও নিহত পলাশ আহমেদ ছাড়া আর কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তাই এ মামলা নিষ্পত্তির জন্য চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তা সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক রাজেশ বড়–য়া। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাইগামী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বোয়িং-৭৩৭ উড়োজাহাজ ময়ূরপঙ্খী মাঝআকাশে ছিনতাইয়ের চেষ্টা হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা টানটান উত্তেজনার পর চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণের পর কমান্ডো অভিযানে নিহত হন ‘পিস্তলধারী’ এক যুবক। পরে জানা যায়, ওই যুবকের নাম পলাশ আহমেদ, তিনি চিত্রনায়িকা

শিমলার সাবেক স্বামী। এই মামলার তদন্তে শিমলাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল পুলিশ। তদন্ত কর্মকর্তা রাজেশ চক্রবর্তী বলেন, পাইলট, কেবিন ক্রু, বিমানযাত্রী, আসামি পলাশের স্বজন, বন্ধু, অভিযান পরিচালনাকারী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীসহ মোট ৭৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করে ৩০৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি তিনি আদালতে জমা দিয়েছেন।

প্রতিবেদনের সঙ্গে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবেশসহ পলাশের গতিবিধির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে পাইলটের কথোপকথনের অডিও এবং ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা বুলেটের খোসাও জমা দেওয়া হয়। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ঘটনার দিন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো টিম বিমানের অভ্যন্তরে অভিযান শুরুর আগে টিমের সদস্যরা একাধিকবার বিমানের বাইরে থেকে মাইকে আসামিকে আত্মসমর্পণ করার অনুরোধ জানান। তাতেও আসামি কোনো ধরনের সাড়া না দেওয়ায় সেনাবাহিনী কমান্ডো টিম সন্ধ্যা ৭টা ১৭ মিনিটে বিমানের ভেতরে প্রবেশ করে অভিযান শুরু করে এবং ৭টা ২৫ মিনিটে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আসামিকে বিমানের বাইরে নামিয়ে আনেন এবং সে মারা যায়’। তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, আসামি পলাশ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলা বারুদ বিস্ফোরণের ভয় দেখিয়ে বিমানের অভ্যন্তরে ত্রাস সৃষ্টি করে যাত্রী, পাইলট, কেবিন ক্রুদের আতঙ্কিত করে বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা করায় তার বিরুদ্ধে করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬ এবং ১৯৯৭ সালের বিমান-নিরাপত্তাবিরোধী অপরাধ দমন আইনের ১১ (২) ও ১৩ (২) ধারায় অপরাধের প্রাথমিকভাবে সত্যতা পাওয়া যায়।

‘তবে পলাশ ছাড়া এই ঘটনার সাথে অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। যেহেতু আসামি প্যারা কমান্ডো অভিযানে নিহত হয়েছে, তাই মামলা নিষ্পত্তির জন্য চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে’।

সিআইডির ফরেনসিক প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, আসামি পলাশের সঙ্গে থাকা পিস্তলটি প্লাস্টিকের তৈরি খেলনা অস্ত্র।
‘বিস্ফোরক পদার্থ জ্বালানোর কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এটি আগ্নেয়াস্ত্র নয়। তবে এ ধরনের খেলনা পিস্তলে রবারের গোলাকার বল নিক্ষেপ করা যায় এবং এ সময় মৃদুু শব্দ হয়। এ পিস্তলে কোনো কার্তুজ স্থাপন করে গুলি করা সম্ভব নয়’। এছাড়াও ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা স্কচটেপ মোড়ানো সাতটি প্লাস্টিকের পাইপ, ২৪টি এলইডি বাল্ব, সার্কিট, ব্যাটারি একত্র করে ‘বোমা’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। তবে সেখানেও কোনো বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ ছিল না বলে বোমা বিশেষজ্ঞ হিসেবেও মতামত দিয়েছেন এই তদন্ত কর্মকর্তা। বিমানে পলাশ পটকা ফুটিয়েছিল বলে উদ্ধার করা আলামত ও প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি থেকে উল্লেখ করা হয়। ওই ঘটনায় পলাশসহ কয়েকজনকে আসামি করে পতেঙ্গা থানায় ২৫ ফেব্রুয়ারি মামলা করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।

চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আসামি পলাশের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনেরও বেশ কিছু ঘটনা তুলে ধরা হয়। বিমানে অভিযানের পরে আঙ্গুলের ছাপ মিলিয়ে জানা গিয়েছিল নিহত যুবক নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের দুধঘাটা এলাকার পিয়ার জাহান সরদারের ছেলে পলাশ আহমেদ।
পলাশ ২০১২ সালে তাহেরপুর ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করেন। পরবর্তীতে ২০১২-’১৩ শিক্ষাবর্ষে সোনারগাঁ সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছিলের। শিক্ষা সনদে পলাশের নাম মো. সাকিব হোসাইন উল্লেখ ছিল।

২০১৪ সালে পলাশ বাবা-মার অমতে এক নারীকে বিয়ে করে বাড়ি এনেছিলেন। স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে তিনি কয়েকবার নেপাল ও ভুটানে গিয়েছিলেন। তার একটি সন্তানও ছিল। নির্যাতনের কারণে ওই স্ত্রী পলাশকে তালাক দিয়ে চলে যান। ২০১৬ সালে পলাশকে তার পরিবার চাকরির জন্য মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দিলেও এক মাসের মধ্যে তিনি ফিরে আসেন এবং ঢাকায় অবস্থান করলেও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না।

চূড়ান্ত প্রতিবেদনে চিত্রনায়িকা শিমলার সঙ্গে পলাশের পরিচয় থেকে শুরু করে বিচ্ছেদের বিষয়গুলোও উল্লেখ করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর চিত্রনায়িকা সিমলা পলাশকে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়ে মুম্বাই চলে যান। শিমলার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে না পেরে ২৬ নভেম্বর পলাশ ভারতে যান। কিন্তু যোগাযোগ করতে না পেরে দুদিন পর পলাশ দেশে ফিরে এলেও পাওনাদারদের ভয়ে আত্মগোপন করেন। দুই মাস পর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পলাশ গ্রামের বাড়ি যান। তবে আগে বাড়ি যাওয়ার সময় তার ব্যাগে বিভিন্ন ধরনের দামি জিনিসপত্র থাকলেও সেবার কিছুই ছিল না বলে পরিবারের সদস্যরা তদন্ত কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন।

২২ ফেব্রুয়ারি পলাশ তার ছোট বোনের সিম নিয়ে দুবাই যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি চট্টগ্রামের বিমান টিকিট কাটেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি সাড়ে ৪টায় বিমানটি ঢাকা থেকে ছাড়ার কথা থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর চট্টগ্রাম সফরের কারণে ৫টা ১৩মিনিটে ৫৮ জন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের যাত্রী (ডমেস্টিক), ৮৫ জন দুবাইগামী যাত্রী নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা করে।
তদন্ত কর্মকর্তা রাজেশ শিমলা ছাড়াও পলাশের বাবা, মা, স্বজন, বন্ধুসহ ১৯ জন, বিমানের পাইলট, কেবিন ক্রুসহ সাতজন, বিমান কর্মকর্তা, অভিযানে অংশ নেয়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ ২৬ জন এবং বিমানের ২২ জন যাত্রীর সাক্ষ্য নেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট