চট্টগ্রাম বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫

বাংলাদেশ-চীন

মতামত-২

বাংলাদেশ-চীন শিল্প অংশীদারিত্ব: শুধু কারখানা নয়, ভবিষ্যৎ নির্মাণ

 ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী, সম্পাদক

৩ জুন, ২০২৫ | ৬:৩৫ পূর্বাহ্ণ

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকায় চীন থেকে আগত একদল বেসরকারি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যদিও তাদের সংলাপটি বিনিয়োগ সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল, তা দ্রুত রূপ নেয় আরও গভীর এক আলোচনায়; পারস্পরিক রূপান্তরের একটি দৃষ্টিভঙ্গিতে। চীনের জন্য বাংলাদেশ একটি নতুন সম্ভাবনার ভূখণ্ড, যেখানে শ্রম ব্যয় বাড়ছে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চাপে রয়েছে। অপরদিকে, বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তটি উচ্চ প্রত্যাশা নিয়ে হাজির হয়েছে।

কেন চীনা শিল্পের জন্য বাংলাদেশ উপযুক্ত
বাংলাদেশের ১৭ কোটি ৩৮ লাখ মানুষের মধ্যে ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষের বয়স ২৬ বছরের নিচে। এ বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী দেশটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ জনমিতিক সুবিধা দিয়েছে। এই কর্মশক্তি কেবল তরুণ এবং প্রচুর নয়, বরং ক্রমাগত শহরকেন্দ্রিক, প্রশিক্ষণযোগ্য এবং প্রযুক্তি-সচেতন হয়ে উঠছে। ফলে যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান শ্রমনির্ভর উৎপাদন সম্প্রসারণ করতে চায়, যেমন- পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, ইলেকট্রনিক্স ও হালকা প্রকৌশল, তাদের জন্য এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ।
বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান ভারতের সীমান্তে এবং বঙ্গোপসাগরে সরাসরি প্রবেশাধিকারসহ এটি দক্ষিণ এশিয়া ও আসিয়ান বাজারের সন্নিকটে রেখেছে। চট্টগ্রাম বন্দর দ্রুত আধুনিকীকরণ এবং জাপানি বিনিয়োগে নির্মাণাধীন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর অঞ্চলকে একটি আঞ্চলিক লজিস্টিকস হাবে পরিণত করা হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশ বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ও দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য করিডোরের মধ্যে একটি সেতু হিসেবে আবিভর্‚ত হচ্ছে।
ড. ইউনূস এই সুবিধাগুলোর কথা তুলে ধরলেও তিনি একে একটি বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, আমরা শুধু কংক্রিট ও যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগ চাই না। আমরা চাই মানুষের উপর, ভাবনার উপর এবং মর্যাদার উপর বিনিয়োগ। চীনা বিনিয়োগকারীদের প্রতি তার আহবান ছিল সরল ও শক্তিশালী, ‘শুধু কারখানা গড়তে নয়, ভবিষ্যৎ গড়তে আসুন।’

চীনের পরিবর্তিত বাস্তবতা
চীনের শিল্পখাত এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। চীনের শিল্প অঞ্চলে গড় মাসিক মজুরি ৫০০ মার্কিন ডলারের উপরে এবং ক্রমবর্ধমান বার্ধক্যের ফলে শ্রমের সরবরাহ হ্রাস পাচ্ছে। এর পাশাপাশি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং ‘ডি-রিস্কিং’ (ঝুঁকি হ্রাস) উদ্যোগ চীনা ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তাদের কার্যক্রম বৈচিত্র্যময় করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এই ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ আজ অন্যতম আকর্ষণীয় বিকল্প হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য উপভোগ করছে নানা গুরুত্বপূর্ণ বাজারে অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার; যেমন- ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) স্কিম, বহু উন্নত দেশে ডিএফকিউএফ (ডিউটি ফ্রি কোটা ফ্রি) প্রবেশাধিকার, আসিয়ান ও ভারতের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের প্রচেষ্টা।

বাংলাদেশ কী প্রত্যাশা করে বিনিময়ে
ড. ইউনূস এবং বাংলাদেশের শীর্ষ নীতিনির্ধারকেরা বহুবার স্পষ্ট করেছেন, বিশেষ করে চীনের মতো অর্থনৈতিক শক্তির কাছ থেকে বাংলাদেশ কী ধরনের বিনিয়োগ প্রত্যাশা করে।

১. প্রযুক্তি হস্তান্তর ও দক্ষতা উন্নয়ন: বাংলাদেশ আর শুধু সস্তা শ্রমের গন্তব্য হিসেবে থাকতে চায় না। বাংলাদেশ চায় মূল্য শৃঙ্খলে উপরের দিকে অগ্রসর হতে; সাধারণ পোশাক থেকে শুরু করে উচ্চমানের পোশাক, ইলেকট্রনিক্স এবং এমনকি সেমিকন্ডাক্টর সংযোজন পর্যন্ত। চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে প্রত্যাশা শিল্প স্বয়ংক্রিয়তায়; যেমন- ডিজিটাল উৎপাদন, প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে প্রযুক্তিগত অংশীদারিত্ব।

২. টেকসই বিনিয়োগ ও নৈতিক ব্যবসা অনুশীলন: বাংলাদেশে এখন বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক ২০০টির বেশি এলইইডি সনদপ্রাপ্ত সবুজ কারখানা রয়েছে। ড. ইউনূস জোর দিয়ে বলেছেন, ভবিষ্যতের শিল্পায়ন হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব। চীনা কোম্পানিগুলোর প্রতি আহবান- বৈশ্বিক শ্রম ও পরিবেশ মান বজায় রাখা, পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণ, স্থানীয় সামাজিক উদ্যোগগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব।

৩. কৌশলগত অবকাঠামো উন্নয়ন: বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল এবং নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বেশকিছু মেগা প্রকল্প নির্মাণ করেছে। তবে এখনও প্রয়োজন- শিল্পপার্ক, লজিস্টিকস হাব, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও পানি ব্যবস্থাপনা অবকাঠামো। এ প্রয়াসকে সহায়তা করছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নতুন ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ প্ল্যাটফর্ম, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য অনুমোদন, জমি বরাদ্দ ও নিয়ন্ত্রক ছাড়পত্রের প্রক্রিয়া সহজ করছে।

৪. ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) সমর্থন: বেপজা ও বিডা’র মাধ্যমে সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, বিদেশি কোম্পানিগুলোর উচিত তাদের সরবরাহ শৃঙ্খলে স্থানীয় এসএমইদের অন্তর্ভুক্ত করা। লক্ষ্য হলো একটি সম্পূর্ণ দেশীয় শিল্প-ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা।

৫. দীর্ঘমেয়াদি, কৌশলগত অংশীদারিত্ব: বাংলাদেশ শুধু খরচ সংবেদনশীল বিনিয়োগকারী চায় না, বাংলাদেশ চায় যৌথ উদ্যোগ, গবেষণা ও উন্নয়ন সহযোগিতা, বিশ্ববাজারে যৌথভাবে ব্র্যান্ডিং করা, রপ্তানি পণ্যের বাজার ঠিক রাখা।

দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার নতুন অধ্যায়
এই মুহূর্তটি একটি বিরল কৌশলগত সম্ভাবনার সংমিশ্রণ। চীন বাইরে তাকাচ্ছে। বাংলাদেশ উপরের দিকে উঠছে। তাদের স্বার্থ এখন মিলছে। কিন্তু তা সফল হবে তখনই, যখন দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদ্দেশ্যমূলক নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত হবে।
ড. ইউনূস তার সমাপনী বক্তব্যে আবেগঘনভাবে বলেছিলেন, ‘আমাদের আছে তারুণ্য, শক্তি এবং আকাক্সক্ষা। আপনারা যদি প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে আসেন, আমরা এমন এক শিল্প ইতিহাস গড়তে পারি, যেটি সমৃদ্ধি সৃষ্টি করবে, কিন্তু মানবতাকে হারাবে না।’ এখন চীনা বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের দায়িত্ব এই ডাকে সাড়া দেওয়া। শুধু সম্ভাবনার জন্য নয়, উত্তরাধিকার গড়ার জন্য।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট