৭ অক্টোবর ২০২৩। হামাস গাজা সীমান্তের বেড়া ভেঙে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে আক্রমণ করলো। ইসরায়েল সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা জবাব দিলো। যা এখন ইতিহাসের পাতায় ‘প্রতিক্রিয়া’ নয়, বরং পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ হিসেবে লেখা থাকবে। বিস্ময়করভাবে এই ঘটনার পর বিশ্ব বুঝতে শুরু করলো, যখন বেড়া ভাঙলো তখনই মুখোশ খুলে গেলো।
ইসরায়েল গাজার উপর এমন ধ্বংস নামিয়ে আনলো যা কেবল রণনীতি নয়, ছিল প্রতিশোধপ্রবণ নির্মমতা। পুরো শহর, শরণার্থী শিবির, হাসপাতাল, মসজিদ, এমনকি ইউনিসেফ পরিচালিত স্কুল সব একে একে ধ্বংস হয়ে গেলো। জাতিসংঘের হিসেব মতে, এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হন, যার এক-তৃতীয়াংশ শিশু। ইউনিসেফ প্রধান ক্যাথরিন রাসেল স্বীকার করেছেন, ‘গাজা এখন শিশুদের জন্য কবরস্থান হয়ে উঠেছে।’
এদিকে, পশ্চিমা নেতারা, যারা সাধারণত মানবাধিকারের বেদিতে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেন, এবার অস্পষ্ট বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইলেন। ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার’ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া শিশুদের কান্না হয়তো তাদের কানে পৌছায়নি। ঠিক এই সুযোগেই ইসরায়েল তার দৃষ্টিপাত করলো পূর্বে ইরানের দিকে।
গাজায় আগুন জ্বলছে; অথচ ইসরায়েল ইতোমধ্যে ইরানকে ঘিরে নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইরান ও তার সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করে সিরিয়া ও লেবাননের ভেতরে একের পর এক হামলা চালানো হচ্ছে। মোসাদ অভিযানে ব্যস্ত। নেতানিয়াহু বলছেন, ‘ইরানই সর্বনাশের মূল উৎস।’ এ যেন এক নতুন অধ্যায়; গাজায় যুদ্ধ চলাকালীনই ‘দ্য পার্সিয়ান থ্রেট’ নামক নাটকের মহড়া শুরু।
এটা আর আত্মরক্ষার গল্প নয়, এটা এক রাষ্ট্রের নব্য ঔপনিবেশিক জায়গা দখলের গল্প; যাকে আন্তর্জাতিক নীতির ছত্রছায়ায় জায়েজ করার চেষ্টা চলছে। যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) গাজায় যুদ্ধাপরাধ নিয়ে তদন্তের কথা বলে, তখন ইসরায়েল পাল্টা হুমকি দেয় তাদের বিচার করলে ‘গুরুতর কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া’ হবে।
তবু বাস্তবতাটা স্পষ্ট। বহু দশক ধরে ‘মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতন্ত্র’ সাজার নাটক করে ইসরায়েল যে সুবিধা ভোগ করেছে, তা আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের লাইভস্ট্রিম, ধ্বংসস্তূপের ছবি, নিহত শিশুর মুখ, মায়ের চিৎকার এই সবকিছুর সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই মুখোশ আর ধরা যাবে না। কারণ যে জিনিস ভাঙে, তা আবার গাঁথা যায়। কিন্তু মুখোশ যখন একবার গুঁড়িয়ে যায়, তখন আসল চেহারাটা চোখে পড়েই যায়। বিশ্ববাসী দীর্ঘকাল ধরে ইসরায়েলকে সামরিক শক্তিধর দেশ হিসেবে মনে করলেও ইরানের সঙ্গে চলমান হামলা- পাল্টা হামলায় ইসরায়েলের মুখোশ খুলে গেছে।
সূত্র ও প্রাসঙ্গিক নথিপত্র:
UN OCHA Situation Reports on Gaza, ডিসেম্বর ২০২৩-মে ২০২৪
UNICEF প্রধান ক্যাথরিন রাসেলের বিবৃতি, নভেম্বর ২০২৩ ও ফেব্রুয়ারি ২০২৪
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ICC) প্রধান প্রসিকিউটর কারিম খানের বিবৃতি, মে ২০২৪
ফিল্ড রিপোর্ট: আল-জাজিরা, বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস (অক্টোবর ২০২৩-মে ২০২৪)
পূর্বকোণ/ইবনুর