চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

প্রবাসী শ্রমিকদের সংগ্রামী জীবন

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৯ অক্টোবর, ২০১৯ | ৭:৪২ অপরাহ্ণ

দেশের মায়া ছেড়ে একজন মানুষ যখন কাজের সন্ধানে বিদেশে যায়, তার চোখে মুখে থাকে অনেক স্বপ্ন। বুকভরা আশা নিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সে পাড়ি জমায় অজানা অচেনা দেশে। যেখানে তার থাকে না কোনো আপনজন। অপরিচিত জায়গায় স্থিতু হবার পথে একজন শ্রমিককে যেতে হয় নানা রকম অসহায়ত্বের মাঝ দিয়ে। অনেক সময়েই যে বেতনের কথা শুনে দেশের মায়া ছেড়ে আসে শ্রমিকরা, কর্ম ক্ষেত্রে যোগ দিয়ে দেখে তার চেয়ে অনেক কম বেতন। আবাসনের কথা বলা হলেও অনেকের বেলাতেই মেলে না আবাসন সুবিধা। বড় একটি ঘরে একসঙ্গে অনেককে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, বসবাসের ন্যূনতম সুবিধাবিহীন জায়গায় থেকেই একজন শ্রমিককে দেশে থাকা স্বজনদের জন্য উপার্জন করতে হয়। কর্মস্থলের পরিশ্রমের সঙ্গে তার জীবনে যোগ হয়, নিজের রান্না, কাপড় পরিষ্কারসহ সব কাজই। আর সঙ্গে তো কর্মস্থলের কর্মঘণ্টা রয়েছেই। বাড়তি কয়েকটি টাকার জন্য অনেক শ্রমিকই নির্ধারিত সময়ের পরে বাড়তি কাজ করে।

অমানবিক পরিশ্রম করে ঘরে ফিরে অনেকেরই থাকে না সামান্য বিশ্রামের সুযোগ। আবার এই শ্রমিকদের অনেকেই যখন কাজের জন্য দেশের মায়া ছাড়ে, তাদের অনেককেই দীর্ঘসময় পালিয়ে থাকতে হয়। প্রয়োজনীয় ওয়ার্ক পারমিট মেলে না অনেকের। আর যারা দালালদের খপ্পরে পড়ে, তাদের দুর্দশার কথা তো অবর্ণনীয়। প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে প্রবাসে কাজের জন্য যাওয়া শ্রমিকদের যারা দালালের খপ্পরে পড়েছে, তাদের অমানবিক কষ্টের কথা উঠে আসে। অথৈ সাগরে ছোট্ট একটি নৌকায় অসংখ্য মানুষকে গাদাগাদি করে তুলে ভাসিয়ে দেয়া, তাদের জীবনকে বিপন্ন করে তোলার খবর প্রায়ই প্রকাশ পায় সংবাদমাধ্যমে।

 কয়েক বছর আগে তো মালয়েশিয়ায় পাঠানোর নামে নিয়ে যাওয়া শ্রমিকদের গণকবরও পাওয়া গেছে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে। এই শ্রমিকরাই যখন কোনো না কোনোভাবে  দেশে পৌঁছে, তখনও তাদের ওপর চালানো হয় নানা রকম নির্যাতন। কাজ পেলেও ন্যায্য মজুরি পায় না তারা। তারপরও থাকে প্রতিনিয়ত পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আতঙ্ক। পালিয়ে বেড়ানোর কষ্ট। আবার অনেক মালিকও শ্রমিকদের সঙ্গে দাসসুলভ আচরণ করে। সামান্য কারণে শ্রমিকদের ওপরে চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন।

আমরা সবাই জানি, সস্তায় শ্রম বিক্রি করতে যারা দেশের বাইরে যান, তাদের অধিকাংশেরই ভালো কাজ জোটে না। তবে যাদের প্রশিক্ষণ থাকে, দক্ষতা থাকে, সঙ্গে থাকে সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা সম্পর্কে জানাশোনা, তাদের ভাগ্য কিছুটা ভালো হয়। তারা তুলনামূলক একটু ভালো কাজের সুযোগ পায়। প্রবাসজীবনের নানা দুর্দশার মাঝেই শ্রমিকরা যে টাকা উপার্জন করে, তা থেকেই দেশে মা-বাবার জন্য টাকা পাঠায়। পরিবারের অন্যদের জন্য টাকা পাঠায়, যাতে করে দেশে সবাই ভালো থাকতে পারে। ভাইবোন লেখাপড়া করতে পারে।
সবাই একটু ভালো অবস্থানে যেতে পারে। ভাগ্যবানরা দুই-তিন বছর পর ছুটি পেয়ে দেশে আসে আপনজনের কাছে। দুই-তিন মাসের ছুটি কাটিয়ে আবারও সেই দূর প্রবাসে। সব স্মৃতি বুকের ভেতরে চাপা দিয়ে আবার কাজ শুরু করে। মাঝে কেটে যায়, বিশ-পঁচিশ বছর। শরীর যখন একেবারেই বিশ্রাম চায়, তখন দেশে ফিরে আসে শ্রমিকরা। দেশে আসার পর চলে আসে জীবনের আরও একটি কঠিন সময়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় উদয়াস্ত পরিশ্রম করে যে টাকা শ্রমিকরা উপার্জন করে, সেই টাকায় দেশে আত্মীয়-স্বজন ভালো থাকলেও, তার জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। কষ্টার্জিত টাকায় কেনা জমি-বাড়িও অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসীর নামে থাকে না। দেশে ফিরে নতুন কাজেরও সুযোগ থাকে না। ফলে প্রবাস জীবনে যেমন দুর্বিসহ কষ্ট ভোগ করতে হয়, রাত-দিন টানা পরিশ্রমের মাঝে মেলেনি সামান্য বিশ্রাম, শান্তি। তেমনি দেশে ফিরেও অনেকের জীবনের থাকে না শান্তির ছোঁয়া।

যাদের শ্রমে-ঘামে আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে, প্রতিনিয়ত বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তাদের প্রতি আমাদের সবারই দৃষ্টি দেয়া উচিত। প্রবাসীরা যেন কোনোভাবেই দেশের বাইরে ন্যূনতম ভোগান্তির শিকার না হয়, তাদের প্রতি সব অন্যায়ের প্রতিকারে আমাদের দূতাবাসগুলোকে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। প্রবাসীদের সুখে-দুঃখে তাদের পাশে আন্তরিকভাবে দাঁড়ানো প্রয়োজন যেমন আমাদের দূতাবাসগুলোর, তেমনিভাবে প্রবাসীরা যখন কাজের জন্য বিদেশে যায়, তখন সরকারকেও সতর্ক হতে হবে যেন তারা কোনোভাবেই বিদেশে প্রতারিত না হয়। আর প্রবাসীদের পরিবারদেরও দায়িত্ব রয়েছে, দেশে ফেরার পর তাদের পাশে দাঁড়ানোর। তাদের সুখ-দুঃখের সাথী হবার।

পূর্বকোণ-রাশেদ

 

শেয়ার করুন