চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

পুঁজি পাচার হচ্ছে কীভাবে

চিকিৎসা শ্রমিকের দিনলিপি

ডা. হাসান শহীদুল আলম

৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:০৮ পূর্বাহ্ণ

অগ্রহায়ণের প্রথম সপ্তাহ। ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। পটিয়াস্থ চেম্বার।
কুয়াশার চাদরে আবৃত ভোর। ঘন্টা দেড়েকের হাঁটা প্রতিদিনের অভ্যাস। সেটা সেরে লিখতে বসেছি।
নি¤েœর সংবাদচিত্র সমূহের প্রতি সম্মানিত পাঠকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি : ‘স্বর্ণ চোরাকারবারের ট্রানজিট চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। এই বন্দর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে অবাধে স্বর্ণ পাচার হচ্ছে। পাচারকারীদের সাথে বিমানবন্দর ও এয়ার ফ্রেইটের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এ পাচার কাজ। মাঝে মধ্যে ধরা পড়লেও তা পাচার হওয়া স্বর্ণের তুলনায় অতি নগণ্য। স্বর্ণ পাচারে বিমানের ক্লিনার, কর্মকর্তা, কর্মচারী জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে কর্তৃপক্ষের কাছে (চট্টগ্রাম প্রতিদিন, ৬/১১/১৯)।’ ২) ‘সম্প্রতি সুইস ব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশীদের সঞ্চয় ৫৩৫৩ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে বিশে^র অন্যান্য দেশে কমলেও বাংলাদেশীদের জমা বেড়েছে শেয়ারজি, ১১/৭/১৯)।” ৩) ‘সম্প্রতি কৌশলে অর্থ পাচারের বড় ধরনের ঘটনা ধরা পড়েছে দেশে। ঋণপত্র খোলা হয়েছিলো কাগজ আমদানীর। একটি চীনা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বন্দরে চালানটি পাঠায়ও। বন্দরে আসার পর চীনের প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার ডলার বা ১৩ লাখ ২ হাজার টাকা পরিশোধও করা হয়। তবে চালানটি খালাস করতে গিয়ে দেখা যায় চীনের রফতানীকারক প্রতিষ্ঠানটি কাগজ পাঠানোর কথা বলে কনটেইনারে পাঠিয়ে দিয়েছে ৪১০ বস্তা বালিমাটি (জনকণ্ঠ, ৯/৯/১৮)।” উল্লিখিত সংবাদচিত্র সমূহে যে সমস্ত তথ্যাদি উদঘাটিত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে : ১) পাচারকারীদের সাথে শুল্ক কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট বিমানের ছোট-বড় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ রয়েছে
২) সরকারী কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে সরকার রাজস্ব আয় হারাচ্ছে ৩) বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেহেতু বিগত দশ বছরে সুইস ব্যাংকে টাকা জমা দেবার কোন অনুমতি দিয়েছে বলে এ পর্যন্ত জানা যায়নি, অতএব সুইস ব্যাংকে জমাকৃত টাকা বাংলাদেশীরা পাচার করেছে ৪) কনটেইনারে কাগজের বদলে বালিমাটি আমদানীর ফলে রফতানীকারক চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠানো প্রায় সাড়ে পনের হাজার ডলার পাচার হয়ে গিয়েছে। আজকের লেখায় টাকা পাচার কি কি প্রক্রিয়ায় হচ্ছে সে ব্যাপারে আলোকপাত থাকবে।
টাকা পাচার কি?

যথাযথ কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে অর্থ বা পুঁজি এক দেশ থেকে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া।
কিভাবে পুঁজি পাচার করা হচ্ছে?
ক) আমদানীর ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং কিংবা ফেইক ইনভয়েসিং : ১) ধরা যাক একটি কোম্পানী বিদেশ থেকে মোবাইল সেট আমদানী করবে। প্রতিটি মোবাইল সেটের প্রকৃত মূল্য ধরা যাক ১০০ মার্কিন ডলার। এখানে ইনভয়েসে অতিমূল্যায়নের মাধ্যমে প্রতিটি মোবাইল সেটের দাম ২০০ ডলার দেখানো হলো। এভাবে ১ লাখ সেট আমদানী করা হলে বাংলাদেশ থেকে মোট ১ কোটি ডলার চলে যাবে। যিনি মোবাইল সেট আমদানী করলেন তিনি বিদেশী রফতানিকারকের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে পাচারকৃত ১ কোটি ডলার বিদেশের হিসাবে গ্রহণ করবেন ২) পণ্য আমদানীর এলসি খুলে বিদেশে অর্থ পাঠিয়ে দেয়ার পরও পণ্য দেশে না আনা। উপরের ৩ নং সংবাদচিত্রে বিবৃত ঘটনা এটির উদাহরণ। ৩)এলসিতে উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে কম পণ্য দেশে আনা ৪) বেশী দামের পণ্যের এলসি খুলে কম দামের পণ্য দেশে আনা ৫) আমদানীর ক্ষেত্রে ফেইক না জাল ইনভয়েসিং : বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে শিল্পের যন্ত্রপাতি ভর্তি কনটেইনারে পাওয়া গিয়েছে ছাই, ইট, বালি, পাথর ও সিমেন্টের ব্লক। শিল্পের কোন যন্ত্রপাতি পাওয়া যায় নি। শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্তে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে খালি কনটেইনার আমদানীর ঘটনাও ধরা পড়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, এলসি প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যাংকগুলো আমদানী পণ্যের ডকুমেন্ট ছাড়া কখনও ফিজিক্যালি পণ্য বা মালামাল দেখে না। এটিই নিয়ম। তাই নিয়ম অনুযায়ী যখন কেউ এলসি খোলেন তখন ওপেনিং ব্যাংক বিদেশের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক-এ এ সংক্রান্ত ডকুমেন্ট পাঠিয়ে থাকেন। সেখানকার নিগোশিয়েটিং ব্যাংক থেকে পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বা সংশ্লিষ্ট যে কেউ ডকুমেন্ট রিসিভ করেন। এরপর তিনি বিল অব লোডিং পেপার সহ পণ্য জাহাজীকরণের সব কাগজপত্র সংযুক্ত করে ঐ ব্যাংকে জমা করেন। কিন্তু এখানে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে যেটি করা হচ্ছে তা হলো ব্যাংকে জমা দেয়া এ সংক্রান্ত কাগজপত্র সবই জাল। আর এ কাজটি যারা করেন তাদের কাছে এটি তেমন কঠিন বিষয় নয়। বিশেষ করে দুবাই ও সিঙ্গাপুর সহ কয়েকটি দেশে এভাবে অর্থ পাচার করা খুবই সহজ। এ পন্থায় টাকা পাচারের সঙ্গে বাংলাদেশী বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপ সম্পৃক্ত। অভিযোগ রয়েছে যাদের কেউ কেউ ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করছে। জানা যায়, বিদেশের নিগোশিয়েটিং ও মেইন ব্যাংক থেকে আমদানী পণ্য জাহাজীকরণের ডকুমেন্ট পুনরায় বাংলাদেশের ওপেনিং ব্যাংকে আসার পর নিয়মানুযায়ী যিনি এলসি খুলেছেন, তিনি টাকা জমা দিয়ে পণ্য ছাড়ানোর ডকুমেন্ট নিয়ে যান। এখানে ব্যাংকের কোন দায় দায়িত্ব থাকে না। বিপরীতে বিদেশের নিগোশিয়েটিং ব্যাংক থেকে পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার দেশের মুদ্রায় অর্থ তুলে নেন। এদিকে এলসি যিনি খুলেছেন তিনি যেহেতু বিদেশে পুরো টাকাই বাল্ক আকারে পাচার করেছেন, তাই তিনি আর ডকুমেন্ট নিয়ে তার পণ্য ছাড়াতে কোন কাস্টমারকে জানান নি। আর বাস্তবে তো তিনি কোন দ্রব্য বা যন্ত্রাংশ আমদানীই করেন নি। এসব কারণে এ চক্রের হোতারা বছরের বেশীরভাগ সময় বিদেশে অবস্থান করেন। এভাবে কেউ টাকা পাচার করলেও ছয় মাস পর তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং এ ধরা পড়ে যাবেন। কেননা যিনি এলসি খুলে বিদেশ থেকে পণ্য বা যন্ত্রাংশ আমদানী করেন তাকে কাস্টমস থেকে পণ্য রিলিজ সংক্রান্ত বিল অব এক্সচেঞ্জ পেপারস বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় ছয় মাসের মধ্যে জমা দিতে হয়। সূত্র থেকে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট সবার সহায়তা নিয়ে এসব করা হচ্ছে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একজন ব্যাংক কর্মকর্তা জানান এলসি মনিটরিং এ বাংলাদেশ ব্যাংকে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তারা কিংবা তাদের কেউ কি সার্ভার থেকে এলসি ডকুমেন্ট ডিলিট বা গায়েব করে দিতে পারবেন? যদি এটি সম্ভব হয় তাহলে পণ্য না এনে পুরো টাকা বিদেশে এ পন্থায় পাচার করার মতো আর কোন সহজ পদ্ধতি থাকতে পারে না। আর এভাবে যেকোন অংকের অর্থ পাচার করা সম্ভব। ‘সিপিডি’-এর তথ্য সূত্র মতে মোট পাচার হওয়া অর্থের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশই হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে।

খ) রপ্তানীর ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানী আয় যথাযথভাবে জমা না দিয়ে বিদেশে রেখে দেয়া : ১) বেশী পণ্য রপ্তানী করে এলসিতে কম পরিমাণ দেখানো ২) মোট রপ্তানী মূল্যের চেয়ে কম মূল্য দেশে আনা ৩) বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে পণ্য রপ্তানী করা : ধরা যাক, বাংলাদেশী একটি প্রতিষ্ঠান বিদেশের একজন ক্রেতার কাছে এক লাখ সাইকেল বিক্রি করবে বা রপ্তানী করবে। প্রতিটি সাইকেলের প্রকৃত বিক্রয়মূল্য ধরা যাক ১০০ ডলার। এখানে ইনভয়েস অবমূল্যায়নের মাধ্যমে প্রতিটি সাইকেলের দাম দেখানো হলো ৫০ ডলার। তাহলে বিদেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতিটি সাইকেলের দাম বাবদ আসবে ৫০ ডলার। আর বাকী ৫০ ডলার বিদেশী আমদানীকারকের কাছ থেকে বিকল্প পথে বিদেশের হিসাবে গ্রহণ করার মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে পাচার হবে ৫০ লাখ ডলার। ৪) পণ্যের রফতানী মূল্যের পুরোটা দেশে না আনা : বিদেশে পণ্য রপ্তানীর ক্ষেত্রে রপ্তানীকারক যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানী করে তার মূল্যের পুরোটা দেশে আনে না। বাকী অংশ বিদেশী ব্যাংক আমদানীকারকের একাউন্টে স্থানান্তর করে দেয়। আমদানীকারক তা রপ্তানীকারকের বিদেশের ব্যাংকের কোন একাউন্টে স্থানান্তর করে দেয়। এ ক্ষেত্রে টাকা বা অর্থ পাচারে সহায়তা করছে দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। কেননা রফতানীর মূল্য ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে দেশে আনার কথা। কিন্তু ঐ সময়ের মধ্যে দেশে না আনলেই তা পাচার হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। ব্যাংকগুলো এ সব বিষয়গুলো তদারকি করে না বলে এ প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার হচ্চে। ৫) দেশ থেকে অপ্রচলিত পণ্য অস্বাভাবিক রকম অধিক মূল্যে বিদেশে বিক্রি করে সেই মূল্যের উপর নগদ ভতুর্কি আদায় করা হয় : ধরা যাক কোন প্রতিষ্ঠান প্রতি কেজি দুই হাজার টাকা দরে ভারতে সুপারী রপ্তানী করলো। এই রপ্তানী বাবদ পণ্য মূল্য এলো সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, বা মাধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশ থেকে। সরকারী তহবিল থেকে রপ্তানীকারী প্রতিষ্ঠানটি শতকরা ২৫ ভাগ হারে প্রতি কেজিতে ৫০০ টাকা হিসাবে ক্যাশ সাবসিডি পেয়ে গেলো। এখন এই রফতানীতে যথেষ্ট সন্দেহের প্রশ্ন উঠতে পারে। ভারত তাদের দেশে সুপারী উৎপন্ন হওয়া সত্ত্বেও দুই হাজার টাকা কেজি দরে তা কিনতে যাবে কেন? এখানে আদৌ সুপারী ভারতে পাঠানো হয়েছে কিনা তা কাস্টমস এর কাগজপত্র দেখলেই বুঝা যাবে। আর যেসব দেশে বাংলাদেশীরা থাকেন এবং দেশে টাকা পাঠন সেসব দেশ থেকে সুপারীর দাম আসছে কেন?
এটা কি হুন্ডির টাকা? এভাবে মিথ্যা রপ্তানী দেখিয়ে কি সরকারের ক্যাশ সাবসিডি নেয়া হচ্ছে?
গ) প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের মাধ্যমে টাকা পাচার ঘ) অনলাইন ব্যাংকিং ; ঙ) স্বর্ণ চোরাচালান; চ) ডিওআইপি ব্যবসা ছ) সরাসরি লাগেজের মাধ্যমে টাকা পাচার; জ) দেশের কিছু ব্যাংক ও মানি চেঞ্জার কোম্পানী কমিশন খেয়ে কালো টাকার মালিকদের অর্থ বিদেশে পাঠিয় দিতে সহযোগিতা করছে; ঝ) গুগল ফেসবুকের মাধ্যমে টাকা পাচার;

ঞ) ঋণের টাকা পাচার ঋণ খেলাপী কর্তৃক।
উপসংহার : এ পর্যন্ত যেটুকু আলোচনা হলো তাতে দেখা যাচ্ছে যে, একা শ্রেণীর দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় টাকা পাচার হচ্ছে। অর্থাৎ সর্ষেতেই ভূত। পরবর্তীতে টাকা পাচার সম্পর্কিত আরো তথ্যাদি, পাচার রোধে সরকারের ভ্রান্তি এবং করণীয় সম্পর্কে লেখার আশা রাখি।

ডা. হাসান শহীদুল আলম চর্মরোগ ও ডায়াবেটিস-এ ¯œাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট