চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার করেরহাট বর্ডার দিয়ে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে নিজ এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলি। একদিন বাজার করতে গেলে আলু মাছ কিনে সেটি বাজারেই ফেলে আমাদের ক্যাম্পে গিয়ে সবাইকে খবর দিই এলাকায় হানাদার বাহিনী ঢুকেছে। সবাইকে নিয়ে আমরা অবস্থান নিলাম। সবাইকে বলে দিলাম আমি ফায়ার করবো। তোমরা কেউ ফায়ার করবা না। এই দিকনির্দেশনা দিলাম। আমরা দেখলাম সারিবদ্ধ অনেক আর্টিলারি গাড়ি। আমরা ফায়ার করলাম না। সাইডে চলে গেলাম। তবে সেখানে রয়ে গেছে নুরুল মোস্তফা। সে সাইডে না গিয়ে পিছু হটতে গিয়ে হাইস্কুলের পেছনের পুকুরের পাশে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ে যায়। সেখানেই তাদের গুলিতে নিহত হয় সে। ছাত্র হিসেবে ছিল সে অত্যন্ত মেধাবী।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এমন তথ্য দেন মিরসরাই উপজেলার মায়ানি ইউনিয়নের পশ্চিম মায়ানি গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন মাস্টার। তিনি আব্দুর জব্বার হাজি বাড়ির নুর আহম্মেদের সন্তান।
গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি তুলে ধরে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন মাস্টার বলেন, আমাদের গ্রুপে প্রথম শহীদ আমবাড়িয়ার নুরুল মোস্তফা। এরপর আমরা উত্তরদিকে ছড়িয়ে যাই। এদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমি পূর্বদিকে মোড় নিলে একা হয়ে যাই। আবুতোরাব এলাকায় রাত সাড়ে ১০টা থেকে প্রায় সাড়ে ৩টা পর্যন্ত কচুরিপানার ডোবায় ৫ ঘণ্টা ডুবে ছিলাম মুখ উপুড় করে। পাক বাহিনীর বুটের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো। পরবর্তীতে উঠে দেখি আমার শরীর একেবারে সাদা হয়ে আছে। আমার পুরো শরীরে শুধু শামুক আর শামুক।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন মাস্টার বলেন, পাকবাহিনী যখন বাজার ত্যাগ করে আমরা আবুতোরাব বাজারে গিয়ে শুনি মোস্তফা নেই। এটা আমাদের প্রথম ধাক্কা। আমরা মায়ানি হয়ে সাধুরবাজার যাই। বীর মুক্তিযোদ্ধা অহিদুল হক বাজারের উত্তর পশ্চিম পাশ থেকে, আমরা দক্ষিণপূর্ব পাশ থেকে একসাথে ফায়ার করলাম। পাক বাহিনীর অনেক সৈন্য এতে নিহত হয়। অইখান থেকে আবার মায়ানিতে আশ্রয় নিলাম। এরপর গেলাম ডোমখালী। খবর পাই বড় দারোগারহাট থেকে পাকবাহিনী আসতেছে। বিশাল অস্ত্রেসজ্জিত হয়ে আসতেছে। এদিকে আমাদের অস্ত্র স্বল্পতা। আমরা বুদ্ধি করে তাদের ডিস্টার্ব করে নিজে বাঁচা। এতে তারা যাতে আতঙ্কে থাকে। কারণ আমাদের অস্ত্র স্বল্পতা।
তিনি বলেন, বিজয়ের একমাস আগে আবুতোরাব বাজারের পূর্বপাশে পাক বাহিনীর সাথে আমাদের বড় আকারের যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধা শাহাব উদ্দিনের নেতৃৃত্বে একটা গ্রুপ ছিল। আমরাও সংযুক্ত হলাম। আমাদের সাথে তুমুল যুদ্ধ হয় পাকবাহিনীর। এতে তারা পরাস্ত হয়। এটাই আমাদের শেষ যুদ্ধ।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি আমরা যে দেশটা চেয়েছিলাম তেমন দেশ আসলে হয়নি। অন্ন,বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের স্বাধীনতা আজও পায়নি এদেশের মানুষ। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এসে বড় আফসোস হয়। কেন মুক্তিযুদ্ধ করলাম? মুক্তিযুদ্ধের যে উদ্দেশ্য সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশে যারা রাজনীতি করে তাদেরকে শুদ্ধাচারে ফিরতে হবে। দেশের সেবা করার মানসিকতায় স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে।
পূর্বকোণ/পিআর