চট্টগ্রাম বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাওয়া উচিৎ চট্টলদরদী ইউসুফ চৌধুরীর

পূর্বকোণ সেন্টারে আলোচনা সভায় বক্তাদের অভিমত

নিজস্ব প্রতিবেদক হ

৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:৩১ পূর্বাহ্ণ

চট্টলদরদী মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী ও তাঁর কর্মজীবন শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, কোনো দলীয় প্রোফাইলে না থেকেও তিনি চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। দার্শনিক চিন্তা-চেতনায় অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইউসুফ চৌধুরী ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব। ডেইরি আন্দোলন ও ভেটেরিনারি বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনীতিতে যেমন অবদান রেখেছেন, তেমনি বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমে চট্টগ্রামের পরিকল্পিত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তিনি। একটি শহরের বৈচিত্র বাড়ানো ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে দাবি আদায়ের জন্য চট্টগ্রামের আধুনিক প্রগতিশীল ও রাজনৈতিক সচেতন এই মানুষটির বড়ই প্রয়োজন ছিল। তিনি বেঁচে থাকলে আজ চট্টগ্রামে বিশৃঙ্খল উন্নয়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতেন। জীবদ্দশায় তিনি যা করে গেছেন তা চট্টগ্রাম থেকে করেছেন বলেই অতটা ফোকাস হয়নি। ঢাকায় বসে করলে তিনি স্বাধীনতা পদকসহ যেকোনো রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক পেতেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে সম্মান জানানো এখন সময়ের দাবি। গতকাল পূর্বকোণ সেন্টারে মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী কনফারেন্স হলে চিটাগং ডেইরি ফার্ম এসোসিয়েশনের উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন।

আইল্যা- সিকিউরিটিজ লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন দি পূর্বকোণ লিমিটেডের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন চৌধুরী। আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নুরুদ্দিন চৌধুরী, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এমএ মালেক, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দর খান, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এ- এনিমেল সাইন্সেস বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. নীতিশ চন্দ্র দেবনাথ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, বাংলাদেশ বিজ্ঞান জাদুঘরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব থিয়েটার আর্টসের (বিটা) নির্বাহী পরিচালক শিশির দত্ত, দৈনিক পূর্বকোণের সাবেক বার্তা সম্পাদক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, দৈনিক প্রথম আলোর বার্তা সম্পাদক ওমর কায়সার, চিটাগং ডেইরি ফার্ম এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি মাওলানা ওমর ফারুক এবং বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির মহাসচিব মুজিবুল হক শুক্কুর। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন দৈনিক পূর্বকোণ সম্পাদক ডা. ম রমিজউদ্দিন চৌধুরী।

চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নুরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন গুণে গুণান্বিত ইউসুফ চৌধুরী একদিকে শিল্পোদ্যাক্ত অন্যদিকে সমাজসেবক ছিলেন। শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল তাঁর। চট্টগ্রামকে সত্যিকার অর্থে একটা বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যেসমস্ত সুযোগ সুবিধার প্রয়োজন তা গড়ে তোলার জন্য তিনি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি বিশ^াস করতেন, ডেইরি শিল্পকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারলে গবাদি পশু এবং দুগ্ধ শিল্পে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবো। চট্টগ্রামের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতেন। অন্যদের সাথে আলোচনা করে স্বচ্ছ ধারণা নিয়েই কর্মকা- পরিচালনা করতেন। আমাদের সমাজে এই ধরনের গুণী ব্যক্তির সমাহার যত বেশি হবে, আমরা তত এগিয়ে যাব। ভেজালসহ নানা সমস্যা আছে। টাকা থাকলেও নির্ভেজাল পণ্য পাচ্ছি না। এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন হওয়া দরকার। দেশের উন্নয়নে আমরা অনেক অর্থ ব্যয় করছি। কিন্তু তার পুরো সুফল আমরা পাচ্ছি না। একটা অংশ বিভিন্নভাবে চলে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের অনেক কিছু করার আছে। ইউসুফ চৌধুরীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাইকে কাজ করার আহবান জানান তিনি।
দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এমএ মালেক বলেন, ইউসুফ চৌধুরী ওয়ারেন বাফেট পত্রিকা বিক্রি করে জীবন শুরু করেছিলেন। আমরা হয়তো তার মতো হতে পারবো না। তবে আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি। ইউসুফ চৌধুরী জীবনটা শুরু করেছিলেন পত্রিকা দিয়ে। আমি তাকে দেখেছি। তিনি একজন স্বপ্নবাজ ছিলেন। একজন সংবাদপত্র বিক্রেতা থেকে শুরু করে, খামারি, দুগ্ধশিল্প, ওষুধশিল্প, পত্রিকার মালিক, পশুপ্রেমী, সর্বোপরি একজন মানবদরদী ছিলেন। ইউসুফ শব্দের অর্থ আল্লাহ্র অনুগ্রহপ্রাপ্ত। মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী আল্লাহ এর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন সেল্ফ মেড একজন মানুষ। তার মৃত্যুটাও হয়েছে মক্কা শরিফে।

প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দার খান বলেন ইউসুফ চৌধুরীর কারণে দুটি জিনিসের বিকাশ হয়েছে। পত্রিকা এবং ডেইরি শিল্প। আধুনিক যে সকল বিষয়ে চিন্তাধারা হয়েছে সব কিছুর নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। চট্টগ্রামে সংস্কৃতির যে পরিবর্তন হয়েছে এবং চট্টগ্রামের প্রতি মানুষের যে আকর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে ইউসুফ চৌধুরীর অবদান আছে। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো আমরা উদ্দেশ্যহারা উন্নয়ন পেতাম না।
নীতিশ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, দেশে বিশ^বিদ্যালয় অনেক আছে। কিন্তু চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ^বিদ্যালয়ের বিশেষত্ব আছে। কারণ এটি সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এর স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী। বিশ^বিদ্যালয়ের একেবারে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি গাইড করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সঠিক অভিভাবক। সবার জন্য গ্রহণযোগ্য ছিলেন বলেই তিনি সবার সহযোগিতায় এই বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত নেতা এবং অভিভাবক। তিনি তরুণদের বেশি গুরুত্ব দিতেন। তাঁর কাছ থেকে কর্মজীবনে অনেক কিছু শিখেছেন উল্লেখ করে বলেন, চৌধুরী সাহেবের জীবনে মার্টিন লুথার কিং এর জীবনের একটা রিফ্লেকশন ছিল। একটি বিশ^বিদ্যালয় মানবসভ্যতা ও মানবসম্পদ তৈরিতে হাজার বছর ধরে অবদান রাখে।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, চট্টলদরদী শব্দটা আমার কাছে ক্ষুদ্র বিশেষণ মনে হয়। কারণ তাঁর যে সমাজদর্শন, যে শিক্ষাদর্শন, তাঁর যে অবদান তাঁকে অবশ্যই রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানানো উচিত ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁকে রাষ্ট্রীয় কোন সম্মাননা জানানো হয়নি। বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে পদক পাচ্ছেন। একুশে বলেন কিংবা স্বাধীনতা পদক। কৃষি অর্থনীতির মতো বড় একটি কাজ তাঁর হাত দিয়ে হয়েছে। কিন্তু তিনি এখন পর্যন্ত পদক পেলেন না এটা আমার জন্য একটি বড় দুঃখ। ডেইরি ফার্মের পেছনে তাঁর যে শ্রম মেধা একটি বিশাল দর্শন কাজ করেছিলো বলে এই গ্রাম থেকে ওঠে আসা লোক এত বড় কিছু করতে পেরেছেন। তিনি দার্শনিক চিন্তা চেতনায় অত্যান্ত সমৃদ্ধ ছিলেন। তাঁর যে সমাজ দর্শন, রাজনৈতিক দশর্ন, অর্থ দশর্ন ছিল। প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন দার্শনিক ছিলেন। দার্শনিক ছিলেন বলেই গতানুগতিক ধারণার বাইরে এসে ভেটেরিনারি বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় যখন অভিযান চালাতাম ইউসুফ চৌধুরী তখন সাপোর্ট দিতেন। একদিন তিনি বললেন, ‘এভাবে অভিযান চালাচ্ছেন, অবৈধ দখলদাররা তো আপনাকে মেরে ফেলবে।’ ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণের বিষয়েও তিনি কথা বলেছিলেন। চট্টগ্রামের সব ধরনের সমস্যা নিয়ে ভাবতেন আমাদের মহানায়ক মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী।

শিশির দত্ত বলেন, আপাদমস্তক একজন আধুনিক মানুষ ছিলেন ইউসুফ চৌধুরী। সমস্ত আধুনিকতাকে তিনি গ্রহণ করেছেন এবং সমস্ত কুসংস্কার পরিহার করেছেন। এই শিক্ষাটাকে তিনি চট্টগ্রামের পূর্বকোণ পত্রিকার মাধ্যমে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি তরুণদের মতামতকে সর্বাগ্রে গ্রহণ করতেন এবং মর্যাদা দিতেন। তিনি চট্টগ্রামের শিল্প, সংস্কৃতি, রাজনীতি সবকিছু কাজ করেছেন এবং তিনি সফল হয়েছিলেন।
নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, মরহুম ইউসুফ চৌধুরী দুইটি জিনিস করে গেছেন। একটি হচ্ছে নিজউ ফ্রন্ট, অন্যটি পূর্বকোণ। প্রথমে অনেকে বলেছেল, পূর্বকোণ এটি কি নাম। তরুণ প্রজন্ম পূর্বকোণকে লুফে নিয়েছিল। ব্রিটিশরা চট্টগ্রামে অনেক ফ্যাক্টরি করেছিল কিন্তু সবগুলো ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে। এটা নিয়ে তিনি খুব আফসোস করতেন। তিনি আমাকে প্রায় বলতেন, ‘চিটাগংত্তুন বিয়া¹িন যারগই’। চট্টগ্রামের মেরিন একাডেমি চলে যাচ্ছিল বলে তিনি খুব আফসোস করেছেন। চট্টলদরদী শব্দটি ইউসুফ চৌধুরীর জন্য শতভাগ প্রযোজ্য। চট্টগ্রামের যে কোন সমস্যায় তিনি চিন্তত হয়ে পড়তেন এবং আমাদের বলতেন সে বিষয়ে লেখার জন্য।

ওমর কায়সার বলেন, একটি শহরের বৈচিত্র্য বাড়ানোর এবং উন্নয়নের জন্য একজন ইউসুফ চৌধুরীর জন্মটা অনিবার্য ছিল। তিনি সবসময় চট্টগ্রামের উন্নয়নের কথা বলতেন। তিনি একবার কথা প্রসঙ্গে বলেন, বটতলী স্টেশন থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত একটা রেল লাইন আমরা স্থাপন করতে পারি না? এখন তো আছে, যেটা দিয়ে বন্দরে মালামাল যায়। ওটাকে সামান্য পরিবর্তন বা সংস্কার করে আমরা একটা যাত্রীবাহী ট্রেন চালু করতে পারি। তিনি একজন মৌলিক চিন্তার মানুষ ছিলেন।
মাওলানা ওমর ফারুক বলেন, এলিট বা শিক্ষিত সমাজকে গরু পালন করা শিখিয়েছেন ইউসুফ চৌধুরী। তিনি না হলে ডেইরি সেক্টর এত অগ্রসর হতে পারতো না।

সভাপতির বক্তব্যে মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এফসিএমএ বলেন, তিনি বহু গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর গুনগুলি ধারণ করে আমরা সমাজের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে পারি। রাজনৈতিক দলের পক্ষে-বিপক্ষে না থেকে তিনি অসংখ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার পেতে হলে ঢাকায় কাজ করতে হবে, এমন প্রথা ভাঙতে হবে। বর্তমান সমাজে যারা ব্যবসা বাণিজ্য করে তারা টাকা পেলেই লুফে নেন। সিগন্যাট প্রেস করার পর ব্যাংকের লোক তাকে টাকা দেয়ার জন্য তার পিছু নিয়েছিল। কিন্তু তিনি ব্যাংকের লোকদের জবাব দিলেন, টাকা নিয়ে আমি কি করবো। তাছাড়া টাকা নিলে তো তা ফেরত দিতে হবে। এরকম নির্লোভ ব্যক্তি সমাজে বিরল। দেশের উন্নয়ন করতে হলে চট্টগ্রামের উন্নয়ন লাগবে। বিষয়টি চট্টগ্রামের উন্নয়ন না বলে দেশের উন্নয়ন বলতে হবে। চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। ইউসুফ চৌধুরী আমৃত্যু সেই সংগ্রাম করে গেছেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট