চট্টগ্রাম রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

হিমোফিলিয়া : শনাক্তের বাইরে ৭০% রোগী

১৭ এপ্রিল, ২০২২ | ১১:২৫ পূর্বাহ্ণ

ইমাম হোসাইন রাজু 

আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগের কথা। সাইফুল ইসলামের মাত্র দশ মাস বয়সী ছেলের হঠাৎ হাত, পা-সহ শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রক্তজমাট বেঁধে ফুলে যায়। যা নিয়ে দুশ্চিন্তা চট্টগ্রামের আনোয়ারার এ বাসিন্দার। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরেও যখন রক্তজমাট বাঁধা ও ফুলে যাওয়ার কারণ চিহ্নিত করতে পারেননি, তখন পাড়ি দেন বিদেশে। আর সেখানেই বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানতে পারেন তার একমাত্র শিশু সন্তানটি হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত।

হিমোফিলিয়া সোসাইটির তথ্য বলছে, সাইফুল ইসলামের ছেলে মতো রক্তজনিত এমন রোগী চট্টগ্রাম বিভাগে আছেন ৭২৫ জন। যারা বিভিন্নভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে শনাক্তের আওতায় আসলেও প্রায় ৭০ শতাংশ রোগী এখনও শনাক্তের বাইরে রয়েছেন। তবে দেশে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা নিয়ে সরকারি কোন তথ্য উপাত্ত না থাকলেও সোসাইটির হিসেবে দেশজুড়ে প্রায় ১৭ হাজার থেকে ২০ হাজার রোগী আছে। তবে তাতেও প্রায় ১০ থেকে ১৫ গুণের বেশি রোগী শনাক্ত হয়নি বলে ধারণা চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের। রোগী শনাক্তের বাইরে থাকার কারণ হিসেবে রোগ নির্ণয় না হওয়া এবং প্রচার প্রচারণা কম থাকার কারণ দেখছেন চিকিৎসসহ সংশ্লিষ্টজন।

এমন বাস্তবতার মধ্যেই আজ দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘চিকিৎসা সকলের অধিকার’ ‘অংশীদারিত্ব, নীতি, অগ্রগতি’। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে আজ রবিবার সকাল ৯টায় হিমোফিলিয়া সোসাইটি অব বাংলাদেশ চট্টগ্রাম শাখা, চমেক হাসপাতালের হেমোটলজি বিভাগ ও মেডিকেল কলেজের উদ্যোগে সাইন্টিফিক সেমিনার, আলোচনা সভা ও র‌্যালির আয়োজন করা হয়েছে।

হিমোফিলিয়া সোসাইটি অব বাংলাদেশ চট্টগ্রাম শাখার তথ্য অনুসারে, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলায় ৭২৫ জন রোগী আছে। যারমধ্যে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম জেলাতেই আছে প্রায় ১৭০ জন। এসব রোগী পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শনাক্ত হয় তারা হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত। সোসাইটির ধারণা, এসব রোগী শনাক্ত হয়েছেন, যা মোট রোগীর ৩০ শতাংশ মাত্র। অর্থাৎ এখনও শনাক্তের বাইরে প্রায় আরও ৭০ রোগী রয়ে গেছেন। এ জন্য প্রচার প্রচারণা ও স্থানীয় পর্যায়ে রোগ নির্ণয় না করতে পারাকে দায়ী করছেন তারা। অবশ্যই এ জন্য জেলা পর্যায়ে হিমোফিলিয়া ক্লিনিক চালু করার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সোসাইটির সংশ্লিষ্টরা।

হিমোফিলিয়া সোসাইটি অব বাংলাদেশ চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এখন শনাক্তের বাইরে প্রায় ৭০ শতাংশ রোগী আছেন। এসব রোগী যদি শনাক্ত না হয়, তাহলে তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই বিড়ম্বনায় পড়তে হবে। এ জন্যই আমরা সবসময় সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন আয়োজন করে থাকি। তারমধ্যে দিবসটিও একটি উল্লেখযোগ্য।’

রোগী শনাক্ত না হওয়ার পেছনে স্থানীয় পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দুর্বল ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে সোসাইটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিভাগে সরকারি পর্যায়ে রোগটি নির্ণয়ে পূর্ণাঙ্গ কোন ব্যবস্থাই নেই। বেসরকারিতে থাকলেও তাতেও ভুল রিপোর্ট পাওয়া যায়। যার কারণে রোগীদের ঢাকাতেই দারস্থ হতে হয়।’

সোসাইটির সভাপতির মতো মত প্রকাশ করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী। তিনি বলেন, ‘কয়েকটি পরীক্ষা করে বুঝা যায় ওই রোগী হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। পূর্ণাঙ্গ রোগ নির্ণয় করতে হলে রোগীদের ঢাকামুখী হতে হয়। এ জন্য বিভাগের এ হাসপাতালে যদি পূর্ণাঙ্গ রোগ নির্ণয়ের কেন্দ্র করা যায়, তাহলে এ অঞ্চলের রোগীদের সেবা গ্রহণে আরও সহজ হয়ে ওঠবে। আমাদের চিকিৎসক আছেন, কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বল হওয়ায় তা মানুষের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। তাই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসা উচিত বলেও মত এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের।’

হিমোফিলিয়া কী এবং কেন হয় :
রোগটি সম্পর্কে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গোলাম রাব্বানী বলেন, হিমোফিলিয়া রোগটি একটি বংশগত রোগ এবং রোগীকে জীবনব্যাপী চিকিৎসার আওতায় থাকতে হয়। হিমোফিলিয়া দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি হিমোফিলিয়া ‘এ’ অন্যটি হিমোফিলিয়া ‘বি’। রক্ত জমাট বাঁধার উপকরণ ফ্যাক্টর এইটের ঘাটতির জন্য হিমোফিলিয়া ‘এ’ এবং ফ্যাক্টর নাইনের ঘাটতির জন্য হিমোফিলিয়া ‘বি’ হয়। এটি বোঝা যায়, যখন কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে রক্তক্ষরণ, শরীরের কোথাও আঘাত লাগলে সেই জায়গটি নীলচে হয়ে ফুলে যায় অর্থ্যাৎ রক্তের নিচে রক্তক্ষরণ, মাংসপেশিতে এবং অস্তিসন্ধিতে রক্তক্ষরণ, হাঁটু, কনুই এবং অন্যান্য স্থানে ফুলে যাওয়া কিংবা রক্তক্ষরণ হওয়ার পর দীর্ঘসময়েও বন্ধ না হওয়া এবং শিশু হামাগুড়ি দেওয়ার সময় হাঁটুতে কালচে দাগসহ আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে লালচে ভাব থাকাটাই হচ্ছে এ রোগের লক্ষণ। তবে এ রোগ পুরোপুরি নির্মূল সম্ভব না হলেও সচেতন হলে স্বাভাবিকভাবে বাঁচা সম্ভব বলেও মত এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের।

পূর্বকোণ/এস

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট