চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

উন্নতজাতের ঘাসে এক তৃতীয়াংশ কমবে গরুর মাংসের দাম

আরাফাত বিন হাসান

২৭ এপ্রিল, ২০২৪ | ১১:৫৭ পূর্বাহ্ণ

বছর দশেক আগেও সাড়ে তিনশ থেকে চারশ টাকায় মিলতো গরুর মাংস। সেসময় গরুর মাংসের কিছুটা আমদানি নির্ভরতা থাকলেও এখন মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। এর মধ্যেও গেলো এক দশকে দেশে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে একশ শতাংশের বেশি। দেশীয় বাজারে এই মাংস সাড়ে সাতশ থেকে নয়শ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে এখন।

মাংসের দাম বাড়ল কেন :

এক দশকের ব্যবধানে গরুর মাংসের দাম দ্বিগুণ হওয়ার কারণ হিসেবে পশুখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কথা বলছেন খামারিরা। খামারিরা জানান, সাধারণত কাঁচামাল কিনে একসঙ্গে মিশিয়ে খাবার তৈরি করেন তারা। কাঁচামালের মধ্যে রয়েছে- সয়াবিন, ভুট্টা, গমের ভুসি, কুঁড়া, মসুরসহ নানা উপাদান। এর মধ্যে ১০ বছর আগে ৪৮ কেজি ওজনের এক বস্তা ভুট্টা কিনতে খামারিদের খরচ হতো আটশ থেকে নয়শ টাকা। এখন একই পরিমাণ ভুট্টা কিনতে তাদের গুনতে হচ্ছে সাড়ে ১৭শ টাকা।

 

আগে ৩৫ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা গমের ভুসি সাড়ে সাতশ থেকে আটশ টাকায় মিললেও এখন একই পরিমাণ গমের ভুসির দাম এক হাজার ৭শ ২০ টাকা। অর্থাৎ, পশুখাদ্যের এই দুটি উপাদানের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে দশ বছরে। দাম বৃদ্ধির এই তালিকায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে সয়াবিন। ২০১৩-২০১৪ সালের দিকে ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা সয়াবিন দেড় হাজার থেকে ১৬শ টাকায় পাওয়া গেলেও এখন ৪ হাজার ২শ থেকে ৪ হাজার ৩শ টাকা গুনতে হচ্ছে খামারিদের। অর্থাৎ, গেলো ১০ বছরে পশুখাদ্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই উপাদানটির দাম বেড়েছে প্রায় ২শ শতাংশ। আর তাতেই বাড়ছে গরুর মাংসের দাম। এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. ফরহাদ হোসেন বলেন, গেলো কয়েকবছরে পশুখাদ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে খামারিদের টিকে থাকাই দায়। পশুখাদ্যের সবগুলো উপদানের দামই দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এখন খামারিরা ক্রসব্রিডের গরুগুলো লালনপালন করছে বলেই তারা টিকে থাকতে পারছে, নয়তো পশু লালনপালনে লাভের অংশটা কমে গেছে। খমারিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যদি খাবারে ঘাস, খড় এসবের দিকে গুরুত্ব দিয়ে দানাদার খাবার কমানো যায়, তাহলেও খামারিরা লাভবান হতে পারে।

 

দাম কমাতে নানা নিষ্ফল উদ্যোগ :

দেশে হু হু করে বাড়তে থাকা গরুর মাংসের দাম কমাতে গেলো কয়েকবছরে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান। তবে এর সবকটিই ব্যর্থ হয়েছে। গেলো বছর দাম কমাতে গরুর মাংসকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করতে এনআরবির দ্বারস্থ হয় প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের পর ডেইরি খাতের ব্যবসায়ীদের আগাম আয়কর ৭ শতাংশ থেকে কমে ২ শতাংশে নেমে আসে। এতে উৎপাদন খরচ কিছুটা কমলেও তা নগণ্য। তবে তার কোন সুফল মেলেনি মাঠপর্যায়ে, কমেনি মাংসের দাম।

 

সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের কর্তারা মাংসের দাম কমাতে বিভিন্ন সময় আমদানির কথা বললেও দেশীয় খামারিদের রক্ষায় সেদিকে পা বাড়ায়নি সরকার। এর মধ্যে কোন কোন খামারি উন্নত জাতের ব্রাহমা গরু লালনপালনের চেষ্টা করলেও তাতে বাধ সাধে সরকার। প্রাপ্তবয়স্ক ব্রাহমা গরুর ওজন গড়ে ৮শ থেকে হাজার কেজি পর্যন্ত হওয়ায় এই জাতের গরুর মাংস তুলনামূলক বেশি পাওয়া যায়। তবে ব্রাহমা গরু আকৃতির চেয়ে দুধ কম দেয় বলে দেশে ব্যাপকভাবে এই জাতের গরু লালনপালন করলে দুধের উৎপাদন কমে যাওয়ার শঙ্কায় লালনপালন নিষিদ্ধ করে সরকার। এর বাইরেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গরুর মাংসের দাম কমাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। সেসবের কোনটিই আশানুরূপ ফল দেয়নি। ফলে বাড়তিই থেকে গেছে গরুর মাংসের দাম।

 

দাম কমাবে উন্নত জাতের ঘাস :

মাংসের দাম কমাতে সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর গরুর উৎপাদন খরচ কমানোর চেষ্টা হিসেবে দানাদার খাবারের পরিবর্তে ঘাসের দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, গরুর খাবার হিসেবে ঘাস নিশ্চিত করা গেলে উৎপাদন ব্যয় কমার পাশাপাশি মাংসের মান ও দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

 

চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. নজরুল ইসলাম জানান, গরুর উৎপাদন খরচ কমাতে হলে ঘাস চাষে জোর দিতে হবে। কারণ প্রতিকেজি দানাদার খাবারের দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা, সেখানে প্রতিকেজি ঘাসের উৎপাদন খরচ তিন থেকে চার টাকা। কেবল ঘাসের মাধ্যমে দেশীয় গরু লালনপালন করে প্রস্তুত করা যায়। আর যেসব গরু মোটাতাজাকরণ করা হয়, অর্থাৎ, মাংসের জন্য তৈরি করা হয়, সেগুলোর দানাদার খাবার কমিয়ে ঘাস খাওয়ানো যায়। যেসব গরুকে ঘাস খাওয়ানো হয়, সেগুলোর মাংসের মান তুলনামূলক ভালো। আবার ঘাস খাওয়া গরু দুধও বেশি দেয়। পশুখাদ্যের ক্ষেত্রে আমরা সবসময় দেখি যে প্রোটিন আর এনার্জি সোর্স রয়েছে কিনা। ঘাসে কার্বোহাইড্রেটসহ সবধরনের পুষ্টি উপাদান তো রয়েছেই, প্রতিকেজিতে ২০ গ্রাম করে প্রোটিনও রয়েছে। দুধের গরুর ক্ষেত্রে প্রোটিন বেশি জরুরি হলেও মাংসের জন্য প্রস্তুত করা গরুর ক্ষেত্রে প্রোটিন জরুরি না। শুধুমাত্র ঘাসের ওপর নির্ভর করেও গরু প্রস্তুত করা যাবে। আবার মোটাতাজা গরুর ক্ষেত্রে যেসব গরুর ওজন ৫০০-৬০০ বা এর চেয়েও বেশি, সেগুলোকে ঘাস খাইয়ে পেট ভরানোর পর প্রতি একশ কেজি ওজনের জন্য এক কেজি হারে দানাদার খাবার বা সয়াবিন-ভুট্টা দিতে হবে। এতে বৃদ্ধিটা ভালো হবে, প্রয়োজনীয় প্রোটিনের চাহিদা বাড়বে। খরচও কমবে।

 

খামারিদের ঘাস চাষে উৎসাহিত করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান এই কর্মকতা। প্রশিক্ষণের পর গেলো অর্থবছরে ১৫১ দশমিক ৪৬ একর জমিতে ঘাস চাষ হয়েছে চট্টগ্রামে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ পেয়ে ঘাস চাষ করছেন কর্ণফুলী এলাকার খামারি সায়ীদ রহমান। খামারে মাংসের জন্য প্রস্তুত করা গরুকে দানাদার খাবার কমিয়ে ঘাস খাওয়ানোর কারণে ৩৩ শতাংশ খরচ কমে গেছে বলে জানান তিনি।

 

সায়ীদ রহমান পূর্বকোণকে বলেন, আগে প্রতিটি গরুর জন্য মাসে ১৫ হাজার টাকা খরচ হতো আমার। এখন সেই খরচটা ১০ হাজারে নেমেছে। খাবারের খরচটা অনেক কমেছে। তবে ওষুধ, বিদ্যুৎসহ সবকিছুর দাম বাড়তি।

 

ঘাস চাষ খামারের জন্য লাভজনক হলেও জমির সংকটের কথা বলছেন খামারিরা। সায়ীদ রহমান বলেন, প্রতিদিন আমার ১২শ কেজি ঘাস প্রয়োজন। সেই হিসেবে মাসে ৩৬ হাজার কেজি ঘাস দরকার। কিন্তু এত ঘাস পাবো কই? জমি নেই। আমরা যদি জমি লিজ পাই, সেক্ষেত্রে আমাদের জন্য ঘাস চাষ সহজ হবে।

 

গরুকে ঘাস খাওয়ানো শুরুর পর থেকে দুধ উৎপাদন বেড়েছে বলে জানান কর্ণফুলী এলাকার আরেক খামারি ডা. মো. ফোরকান। তিনি বলেন, আমি ঘাস চাষ শুরুর পর গরুকে ঘাস খাওয়ানো শুরু করি। ঘাস খাওয়ানো শুরুর পর দুধের পরিমাণ কয়েক লিটার করে বেড়ে গেছে, খাবারের খরচও কমছে।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট