চট্টগ্রাম বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

‘অনেককে কমিটিতে বিভিন্ন পদে আসীন করা হয়েছে, যাদের দলে কোন জনভিত্তি নেই’

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগে অসন্তোষ

‘ত্যাগী নেতাদেরই কমিটিতে স্থান দেয়া হয়েছে। কাউকে অবমূল্যায়ন করা হয়নি’

নিজস্ব প্রতিবেদক

২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ | ৫:০৪ অপরাহ্ণ

আওয়ামী লীগের জেলা কমিটিগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বী সব পক্ষের নেতাদের স্থান দিতে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনার পর চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে ত্যাগি নেতাদের মূল্যায়ন হয়নি মর্মে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

অসন্তুষ্ট কয়েকজন নেতা পূর্বকোণকে তাদের ক্ষোভের কথাও জানান। তাতে জানা গেছে, চলতি মাসের ১৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সভায় দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের পর উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের পদবঞ্চিত ত্যাগি নেতারা বর্তমান নেতৃত্বের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করে দলীয় হাইকমান্ডের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

তারা বলেছেন, যারা কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না এমন ব্যক্তিদের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের ব্যক্তিগত পছন্দের কারণে প্রস্তাবিত কমিটিতে প্রতিদ্বন্দ্বী ও ত্যাগী নেতাদের বাদ দেয়া হয়েছে।

সূত্রমতে, সেদিন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত সভাপতিমণ্ডলীর সভায় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের জেলা কমিটিগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বী সব পক্ষের নেতাদের স্থান দিতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ‘যেসব জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে শুধু নিজেদের পছন্দমতো লোক রাখবেন, যারা প্রতিদ্বন্দ্বীদের কমিটি থেকে বাদ দেবেন তাদের কমিটি অনুমোদন করা হবে না। যারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী ছিলেন, তাদেরও কমিটিতে মূল্যায়ন করতে হবে। যারা প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাদ দেবেন, দরকার হলে তাদের কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি করে দেব’।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সভায় উপস্থিত একজন নেতা বলেন, বিভিন্ন জেলা ও মহানগর কমিটিগুলোর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করছেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা। সেখানে যারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হয়েছিলেন কিন্তু পদ পাননি, তাদের কমিটিতে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। অতীতে বিভিন্ন সময় যারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হতেন তারা কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতেন। এতে দল শক্তিশালী হতো। সবাইকে নিয়েই কমিটিগুলো পরিচালিত হতো। কিন্তু সস্প্রতি দেখা যাচ্ছে, যারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন, তারা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের কোণঠাসা করতে কমিটি থেকে বাদ দিচ্ছেন কিংবা বড়জোর সদস্য পদে রাখছেন। জেলা ও মহানগর কমিটি গঠনের এমন সংবাদ শুনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান শেখ হাসিনা। তিনি কমিটিগুলোতে পদবঞ্চিতদের মূল্যায়ন করার কঠোর নির্দেশনা দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৭ ডিসেম্বর উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে দুটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। একটি প্যানেলে ছিলেন বর্তমান কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ সালাম ও সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান। অন্য প্যানেলে ছিলেন সভাপতি পদপ্রাথী রাউজান থেকে নির্বাচিত সাংসদ ও আগের কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এ.বি.এম ফজলে করিম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক পদপ্রাথী পূর্বের কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মিরসরাই উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এক সময়ের তুখোর ছাত্রনেতা মো. গিয়াস উদ্দীন। কিন্তু প্রস্তাবিত কমিটিতে গিয়াস উদ্দীনকে সদস্য পদে রাখা হয়েছে। এভাবে আগের কমিটিতে বিভিন্ন পদে থাকা দীর্ঘদিনের ত্যাগি নেতা ও সংগঠক ইউনুচ গণি চৌধুরী, নুরুল হুদা, শাহনেওয়াজকে সদস্য পদে রাখা হয়েছে।

অন্যদিকে মনজুরুল আলাম মনজু, মোঃ বাকের, আবু তৈযুব, তৌহিদ বাবু, সিরাজ উদ দোলা, শাহজাহান চৌধুরী, এডভোকেট ভবতোষ এর মতো দক্ষ সংগঠকদের কে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে কমিটির বাইরে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনের ব্যক্তিগত স্টাফ নূর খান, রাউজান উপজেলা নির্বাচনে তিনবারের পরাজিত চেয়ারম্যান প্রাথী আবুল কালামসহ অনেককে কমিটিতে বিভিন্ন পদে আসীন করা হয়েছে যাদের দলে কোন জনভিত্তি নেই।

এ প্রসঙ্গে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি ও রাউজান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এহসানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাদেরকে কোণঠাসা করে রাখার জন্য কমিটিতে ত্যাগি নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। এ জন্য দলের মধ্যে দীর্ঘদিনের ত্যাগি নেতাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। নুরুল হুদা, মনজুরুল আলম মনজু, মোঃ বাকের, আবু তৈযুব, তৌহিদ বাবু, সিরাজ উদ দোলার মতো দলের নিবেদিত ত্যাগি ও দক্ষ সংগঠকদেরকে কমিটিতে রাখা হয়নি। তারা আগের কমিটিতে সবাই বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করে দলকে সামনে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

তিনি বলেন, প্রয়োজনে আমাকে বাদ দিয়ে হলেও বাদ পড়া ত্যাগী নেতাদের অর্ন্তভুক্ত করে মূল্যায়ন করার দাবি জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রাথী মো. গিয়াস উদ্দীন পূর্বকোণকে বলেন, ‘৭৫ পরবর্তী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জীবনবাজি রেখে দলকে সংগঠিত করেছি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে থেকেছি। বার বার গ্রেপ্তার হয়ে কারা ভোগ করেছি। ওয়ান ইলেভেন ও খালেদা জিয়ার আপারেশন ক্লিন হার্টের সময়ও গ্রেপ্তার হয়েছি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি বলে। ২০০৯ সালে মিরসরাই উপজেলা নির্বাচনে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে সাবেক মন্ত্রী মোশারফ হোসেনের বিরোধিতার মুখে আমাকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। কমিটি গঠনে বিদায়ী কমিটির নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করার নৈতিকতা থাকলেও তাও মানা হয়নি। আজকে দলের ভেতর আমার মতো অনেক ত্যাগি নেতাদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। তাতে দল সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্য শেখ হাসিনার কাছে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগকে রক্ষায় হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

সাবেক কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদাক মনজুরুল আলম মনজু বলেন, এরশাদ ও খালেদা জিয়া বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে থেকে দলের পক্ষে কাজ করেছি। সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মো. গিয়াস উদ্দীনের পক্ষ নেয়ায় আমাকে কমিটির কোন পদে তো দূরে থাক সদস্যও করা হয়নি। অথচ সাবেক মন্ত্রী মোশারফ হোসেনের ব্যক্তিগত কর্মচারী নূর খানকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। যার কোন অবদান নেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বদ্বিতা করা সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো গিয়াস উদ্দীনকে করা হয়েছে সদস্য। এ কেমন মূল্যায়ন ?

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ সালাম পূর্বকোণকে বলেন, দলের ত্যাগি নেতাদেরই কমিটিতে স্থান দেয়া হয়েছে। কাউকে অবমূল্যায়ন করা হয়নি। কেউ যদি মনে করে মূল্যায়ন সঠিক হয়নি তারা কেন্দ্রে অভিযোগ দিতে পারেন। আমরা প্রস্তাবিত কমিটি সম্মেলনের পর পর কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিয়েছি। কেন্দ্র থেকে যদি আমাদের কোন নির্দেশনা দেয়া হয় প্রয়োজনে সেই আলোকে সব কিছু হবে। দল কারো একার নয়। দল জনগণের। সবার মতামত, অভিযোগ দেয়ার অধিকার আছে। তাতে আমরা নাখোশ নই। এ ব্যাপারে কারো উপর আমাদের কোন অভিযোগও নেই।

তিনি আরো বলেন, সম্মেলনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তাদেরকেও কমিটিতে রাখা হয়েছে। কমিটিতে থাকার মতো অনেক যোগ্য নেতা রয়েছেন। কিন্তু কমিটির সদস্য সংখ্যা নির্দিষ্ট বিধায় ইচ্ছে থাকলেও সবাইকে কমিটিতে রাখা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, মাননীয় সংসদ সদস্য এ.বি.এম ফজলে করিম চৌধুরী জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন বিধায় উনাকে সহ-সভাপতি পদে রাখাটা সমীচিন নয়। যে কারণে উনাকে এক নম্বার সদস্য রাখা হয়েছে।

 

 

 

 

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট