চট্টগ্রাম শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

সর্বশেষ:

উখিয়া-টেকনাফ : ৮ বছরে ২৯৪ জন অপহৃত
কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প

উখিয়া-টেকনাফ : ৮ বছরে ২৯৪ জন অপহৃত

কায়সার হামিদ মানিক, উখিয়া

১৫ জুন, ২০২৫ | ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

গত আট বছর ধরে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৩ টি ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শুধু রাষ্ট্রহীনতায় নয়, অপহরণ আতঙ্কেও দিন পার করছে। স্থানীয় বাসিন্দারাও বাদ যাচ্ছেন না অপহরণকারী দুর্বৃত্তচক্রের থাবা থেকে। ২০১৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা ও স্থানীয়রা মিলে অন্তত ২৯৪ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। যাদের অনেকেই আজও নিখোঁজ, অনেকের লাশ ফিরেছে পরিবারের কাছে।

 

জানা গেছে, ২০১৭ সালে ১৫ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে ১২ জন রোহিঙ্গা ও ৩ জন স্থানীয়। এদের মধ্যে জীবিত উদ্ধার হয়েছেন ১১ জন, নিহত হয়েছেন দু’জন এবং নিখোঁজ রয়েছেন দু’জন। ২০১৮ সালে অপহরণের শিকার হন ২৫ জন। তাদের মধ্যে রোহিঙ্গা ১৮ জন ও স্থানীয় সাতজন। এদের মধ্যে জীবিত উদ্ধার হয়েছেন ২১ জন, মারা গেছেন তিনজন ও নিখোঁজ রয়েছেন একজন। ২০১৯ সালে অপহৃত হয়েছেন ৩১ জন। এদের মধ্যে রোহিঙ্গা ২২ জন ও স্থানীয় ৯ জন। এর মধ্যে জীবিত উদ্ধার হয়েছেন ২৫ জন, নিহত হয়েছেন পাঁচজন এবং খোঁজ মেলেনি একজনের। ২০২০ সালে অপহরণের শিকার ৫০ জন। এরমধ্যে রোহিঙ্গা ৩৮ জন ও স্থানীয় ১২ জন। এদের মধ্যে জীবিত উদ্ধার হয়েছেন ৪০ জন, নিহত সাতজন এবং নিখোঁজ তিনজন।

 

২০২১ সালে অপহরণ হয় ৫৩ জন। তারমধ্যে রোহিঙ্গা ৪০ জন ও স্থানীয় ১৩ জন। এদের মধ্যে জীবিত উদ্ধার ৪২ জন, নিহত রয়েছেন আটজন, নিখোঁজ তিনজন। ২০২২ সালে অপহৃত ৫৮ জন। তার মধ্যে রোহিঙ্গা ৪৩ জন ও স্থানীয় ১৫ জন। জীবিত উদ্ধার হয়েছে ৪৮ জন। নিহত হয়েছেন সাতজন ও নিখোঁজ তিনজন।

 

২০২৩ সালে অপহরণের শিকার ৪৫ জন। তারমধ্যে রোহিঙ্গা ৩৫ জন ও স্থানীয় ১০ জন। এদের মধ্যে জীবিত উদ্ধার হয়েছেন ৩৬ জন, নিহত হয়েছেন ছয়জন ও নিখোঁজ রয়েছে তিনজন। ২০২৪ সাল থেকে চলতি বছরের ১২ জুন পর্যন্ত মোট অপহরণের শিকার ১৭ জন। এদেরমধ্যে রোহিঙ্গা রয়েছে ১০ জন ও স্থানীয় সাতজন। এরমধ্যে জীবিত উদ্ধার হন ১৫ জন ও নিহত হয়েছেন দু’জন।

 

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিগত আট বছরে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় মিলে মোট ২৯৪ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে রোহিঙ্গা ২১৭ ও স্থানীয় ৭৬ জন। এদের মধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় জীবিত উদ্ধার হতে সক্ষম হয়েছেন ২৩৮ জন। মুক্তিপণ না পাওয়ায় হত্যা করা হয়েছে ৪০ জনকে। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ১৬ জন।

 

সর্বশেষ গত বুধবার (১১ জুন) কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অপহরণের শিকার হয় চার বছরের নুর শেহেরা নামের এক রোহিঙ্গা শিশু। পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে একই ক্যাম্প এলাকা থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক এডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ সিরাজ আমীন। অপহৃত শিশুটি লম্বাশিয়া ১ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা মাহমুদুল হাসানের মেয়ে।

 

সিরাজ আমীন বলেন, শিশুটি পাশের দাদার বাড়িতে যাওয়ার পথে অপহরণকারী চক্র তাকে অপহরণ করে। পরে অপহরণকারীরা পরিবারের কাছে একটি ফোন নম্বর থেকে যোগাযোগ করে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে এবং প্রশাসনের সহায়তা নিলে শিশুটিকে হত্যা করবে বলে হুমকি দেয়। বিষয়টি জানার পর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়। তিনি আরো বলেন, অভিযানের চাপে অপহরণকারীরা শিশুটিকে কুতুপালং ক্যাম্প এলাকায় ফেলে পালিয়ে যায়।

 

অপহরণে সক্রিয় গ্রুপ ও তাদের কার্যক্রম: (১) আরসা নামে একটি রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠন, যা শুরুতে মিয়ানমারে রাজনৈতিক দাবি নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে মাদক, চাঁদাবাজি ও অপহরণে জড়িত। ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে নিয়মিত আতঙ্ক সৃষ্টি করে। (২) ইসলামী মাহাজ, আরসার ভাঙন থেকে তৈরি এক কট্টরপন্থী রোহিঙ্গা দল। অপহরণ ও চাঁদাবাজিতে এদের ভূমিকা মারাত্মক। এদের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালে অন্তত ৬টি অভিযানে ১৭ জন সদস্য গ্রেপ্তার হয়। (৩) জালিম গ্রুপ: এই গোষ্ঠী মূলত অস্ত্র ব্যবসায়ী ও মাদকপাচারকারীদের নিরাপত্তা দেয়। টেকনাফের হ্নীলা ও পাহাড়ি এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে। অপহরণের মাধ্যমে তারা মুক্তিপণ আদায় করে। (৪) স্থানীয় পাহাড়ি ডাকাত ও দালাল চক্র: মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সীমান্তে পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত কিছু সশস্ত্র দল রোহিঙ্গাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। অপহরণের পর টাকা ভাগাভাগি করে নেয়।

 

নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান: ২০২৩-২৪ সালে চালানো বড় ৫টি অভিযান: অপারেশন ব্লঅযাক ডন’ (নভেম্বর ২০২৩) : পালংখালী পাহাড়ে আরসা ঘাঁটি উচ্ছেদ, ছয়জন নিহত। কুতুপালংয়ে অভিযান (মার্চ ২০২৪) : অপহৃত শিশু উদ্ধার, ৩ অপহরণকারী গ্রেপ্তার। টেকনাফ ‘কোডনেম স্পাইডার’ ( মে ২০২৩): জালিম গ্রুপের আট সদস্য আটক। হ্নীলা অভিযান (জুলাই ২০২২), ১২ অপহৃত উদ্ধার। বালুখালী সাঁড়াশি অভিযান (ডিসেম্বর ২০২১) : ইসলামী মাহাজের চার সন্ত্রাসী নিহত।

 

এদিকে অপহরণের বিষয়ে রোহিঙ্গা নেতা হাফেজ আহমদ বলেন, সন্ত্রাসী দমন না হলে আমরা একদিন মানবঢাল হয়ে যাব। অপহরণ বন্ধ না হলে পুরো ক্যাম্প ধ্বংস হবে। উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা মজিবর রহমান জানান, রোহিঙ্গা সমস্যা ছিল মানবিক, এখন এটি অস্ত্রধারীদের নিয়ন্ত্রিত জোনে রূপ নিচ্ছে। ৮ বছরের অপহরণ চক্রের চিত্র উঠে এসেছে ভয়াবহ এক বাস্তবতায়।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট