চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

বজ্রপাত নিয়ে যত কথা

অনলাইন ডেস্ক

১ জুন, ২০২৩ | ৭:৩৬ অপরাহ্ণ

দেশে প্রতিবছর গড়ে দুই শতাধিক মানুষ বজ্রপাতে মারা যায়। নাসার তথ্য অনুযায়ী, বজ্রপাতের অন্যতম হটস্পট বাংলাদেশ। সিলেট হচ্ছে দেশের অন্যতম বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চল। বজ্রপাত সাধারণত এপ্রিল-মে, বঙ্গাব্দের বৈশাখে সংঘটিত হয়। বজ্রপাতের কারণ হিসাবে বলা যায়, স্থির তড়িৎ বা Static Electricity।

প্রতিটি বস্তুই অসংখ্য ক্ষুদ্র কণিকা দ্বারা গঠিত। এই কণিকাগুলোর নাম পরমাণু। প্রতিটি পরমাণুর কেন্দ্রে রয়েছে নিউক্লিয়াস। প্রতিটি নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রন নামক দুই ধরনের কণা থাকে। তাদের ভর প্রায় সমান। প্রোটন ধনাত্মক আধান (চার্জ) যুক্ত, নিউট্রনের কোনো আধান নেই। নিউক্লিয়াসের চারদিকে অবিরত ঘূর্ণায়মান কণা ইলেকট্রন-ঋণাত্মক আধানসম্পন্ন।

স্বাভাবিক অবস্থায় পরমাণুতে ইলেকট্রন ও প্রোটনের সংখ্যা সমান। ফলে স্বাভাবিক অবস্থায় যে কোনো পরমাণু তড়িৎনিরপেক্ষ থাকে। তবে প্রত্যেক পরমাণুরই প্রয়োজনের অতিরিক্ত ইলেকট্রনের প্রতি আসক্তি থাকে। তাই দুটি বস্তুকে যখন পরস্পরের সংস্পর্শে আনা হয়, তখন যে বস্তুর ইলেকট্রন আসক্তি বেশি সে বস্তু অপর বস্তু থেকে মুক্ত ইলেকট্রন সংগ্রহ করে-ঋণাত্মক আধানে আহিত হয়। যে বস্তু থেকে ইলেকট্রন চলে আসে সেটি ধনাত্মক আধানযুক্ত হয়।

ছোট একটি উদাহরণ দিই। শীতকালে শুষ্ক আবহাওয়ায় শ্যাম্পু করা শুকনো চুলে প্লাস্টিকের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে টেবিলে রাখা ছোট ছোট কাগজের টুকরার সামনে চিরুনি ধরলে চুম্বকের মতো চিরুনিতে কাগজের টুকরাগুলো আটকে যায়।

এক্ষেত্রে চুলের সঙ্গে চিরুনির ঘর্ষণের ফলে চিরুনিটি চার্জিত হওয়ায় এরকম হয়। চিরুনি দিয়ে যখন চুল আঁচড়ানো হয় তখন চুলের সঙ্গে চিরুনির ঘর্ষণের ফলে চুল থেকে ইলেকট্রন চিরুনিতে চলে এলে চিরুনি নেগেটিভ চার্জে চার্জিত হয়। কাগজ, চুল ও চিরুনি অপরিবাহী হওয়ায় উৎপন্ন এ চার্জ প্রবাহ করা সম্ভব হয় না। তড়িৎ আবেশের কারণে কাগজের টুকরা পজিটিভ চার্জে চার্জিত হয়। ফলে চিরুনি ও কাগজের মধ্যে আকর্ষণ হয়।

তড়িৎ আবেশ: একটি চার্জিত বস্তুকে একটি পরিবাহীর (অচার্জিত) কাছে আনলে সাময়িকভাবে চার্জিত করার পদ্ধতিকে তড়িৎ আবেশ বলা হয়। একটি চার্জিত বস্তুকে একটি অচার্জিত পরিবাহীর কাছে আনলে সাময়িকভাবে চার্জিত পরিবাহীর নিকট প্রান্তে বিপরীত ধরনের চার্জ এবং দূরত্বের প্রান্তে একই ধরনের চার্জ সৃষ্টি হয়। চার্জিত বস্তুকে সরিয়ে নিলেই ওই পরিবাহীর চার্জ লোপ পায়। একটি উদাহরণ দিই।

একটি কাচদণ্ড A-কে রেশমি কাপড় দিয়ে ঘষে পজিটিভ চার্জে চার্জিত করা হলো। অচার্জিত পরিবাহীর (BC) কাছে আনা হলো। দেখা যাবে কাচদণ্ডটির নিকট প্রান্ত ই-তে কাচদণ্ডের বিপরীত চার্জ নেগেটিভ চার্জে চার্জিত এবং কাচদণ্ডটির দূরের প্রান্ত C-তে কাচদণ্ডের পজিটিভ চার্জে চার্জিত হয়েছে। ঘর্ষণের ফলে বস্তুর ইলেকট্রন ও প্রোটনের ভারসাম্য নষ্ট হলে বস্তু চার্জগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বস্তুর এ চার্জ স্থির থাকে বলে অর্থাৎ একস্থান থেকে অন্যস্থানে চলাচল করে না বলে একে স্থির চার্জ বলা হয়। এ ঘটনাই ঘটে বজ্রপাতের সময় মেঘের মধ্যে। এ মেঘ হচ্ছে বজ্রপাতের ব্যাটারি। চার্জ দুধরনের হয়ে থাকে-পজিটিভ ও নেগেটিভ।

মেঘ যেভাবে চার্জিত হয়: জলচক্রের জলকণা যখন ক্রমেই ঊর্ধ্ব আকাশে উঠতে থাকে, তখন তার আগে থেকেই উপরে অবস্থিত মেঘের নিচের দিকের বেশি ঘনীভূত বৃষ্টি বা তুষারকণার সঙ্গে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়, যার ফলে উপরের দিকে উঠতে থাকা বাষ্পের পরমাণু বেশকিছু ইলেকট্রন হারায়। যে পরমাণু ইলেকট্রন হারায় সে পরমাণু পজিটিভ চার্জে চার্জিত হয়।

যে পরমাণু ইলেকট্রন গ্রহণ করে সে পরমাণু নেগেটিভ চার্জে চার্জিত হয়। যেমন চিরুনি ও কাগজের পরীক্ষা। ফলস্বরূপ, মেঘের মধ্যে স্থির চার্জ তৈরি হয়। চার্জ স্থির থাকলে স্থির বিদ্যুৎ তৈরি হয়। স্থির বিদ্যুৎ চার্জ পরিবহণের কোনো মাধ্যম থাকে না। এ নেগেটিভ চার্জ ও পজিটিভ চার্জ মিলিত হয়ে discharge বা Neutral হতে চেষ্টা করে। চার্জ মিলিত হওয়ার ফলে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়।

বজ্রপাত তিন ধরনের হয়ে থাকে:

১. ক্লাউড লাইটেনিং: যখন কোনো মেঘ নিজেদের মধ্যে চার্জ বিনিময় করে, তখন যে বজ্রপাত সৃষ্টি হয় তা ক্লাউড লাইটেনিং। এ ধরনের বজ্রপাত খুব সামান্য পরিমাণ ভোল্টেজ তৈরি করে। আওয়াজ করে না।
২. ক্লাউড টু লাইটেনিং: এ ধরনের বজ্রপাতে বড় মেঘ উপরে থাকে এবং নিচে ছোট মেঘ থাকে। ফলে বড় মেঘ ছোট মেঘের উপর নিচের চার্জকে discharge করে দেয়। একে আমরা ক্লাউড টু লাইটেনিং বলি। এ ধরনের বজ্রপাতে আলো ও শব্দ দু-ই সৃষ্টি হয়ে থাকে।
৩. ক্লাউড টু গ্রাউন্ড লাইটেনিং: এ ধরনের বজ্রপাতে মেঘের নিচের দিকে ভারী নেগেটিভ চার্জ জমা হতে থাকে। মেঘের মধ্যে এ ধরনের চার্জের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে বৃহৎ আকারে পরিণত হয়। ফলস্বরূপ, মেঘ শক্তিশালী ধারকে পরিণত হয়। ধারক চার্জ সঞ্চয় রাখে। এ সময় তড়িৎ আবেশ প্রক্রিয়ায় তার বিপরীতধর্মী চার্জ অর্থাৎ পজিটিভ চার্জ ভূপৃষ্ঠে তৈরি হয়।

মেঘের মধ্যে যে নেগেটিভ ও পজিটিভ চার্জ থাকে তা যদি যুক্ত হয়, তখন তা মেঘের মধ্যে আলো বা স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে। এটাকে আমরা মেঘের মধ্যে আলোর ঝলক হিসাবে দেখি। যেখানে মেঘের মধ্যে আলো সৃষ্টি হয় সেখানকার বায়ু প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে থাকে। Discharge হওয়ার সময়ই বাতাসের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। একে বলা হয় এয়ার ব্রেকডাউন। বাতাসের মধ্যে যে চ্যানেলের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়,

যার তাপমাত্রা ২৭০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে উন্নীত হয়, তা সূর্যের তাপমাত্রার ছয়গুণ বেশি এবং বাতাসের স্বাভাবিক চাপ থেকে প্রায় ১০ থেকে ১০০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। এই চাপ ও তাপমাত্রায় পৌঁছাতে সময় লাগে এক সেকেন্ডের কয়েক হাজার গুণের এক ভাগ। এত কম সময়ে এত তাপমাত্রা ও চাপের এত ব্যাপক পরিবর্তন তার চারপাশের বায়ুমণ্ডলকে প্রচণ্ড গতিতে প্রসারিত করে। এই গরম বায়ুর চারপাশে যে শীতল বায়ু থাকে তা গরম হালকা বায়ুর দিকে ধাবিত হয়। ফলে তাদের মধ্যে ধাক্কা লাগে। এ ধাক্কার ফলে প্রচণ্ড শব্দের সৃষ্টি হয়। এটি হলো মেঘ ডাকা। মেঘ হলো বজ্রপাতের ব্যাটারি।

বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায়: পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে কোথাও না কোথাও ১০০ বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। অতএব খুব সাবধান, বজ্রপাতে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচা খুব কঠিন।
তবে সতর্ক হলে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো যেতে পারে:
১. বজ্রপাতের সময় কোনো খোলা স্থানে দাঁড়ানো যাবে না। কোনো গাছের নিচেও আশ্রয় নেওয়া যাবে না। খোলা স্থানে গাছের ওপর বজ্রপাত বেশি হয়। কারণ গাছ মাটি বা ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে সংযুক্ত। বজ্রপাতের সময় ভূপৃষ্ঠে যে পজিটিভ চার্জ আবিষ্ট হয়, তা ভূপৃষ্ঠ থেকে মেঘের নেগেটিভ চার্জের আকর্ষণে গাছের মাথায় চলে যায়। বড় গাছের আগা ও মেঘের মধ্যে দূরত্ব কম থাকে। তাই গাছের মাথায় বা বড় বিল্ডিংয়ের উপরে মেঘ থেকে আসা নেগেটিভ চার্জ ভূপৃষ্ঠ থেকে আসা পজিটিভ চার্জের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বজ্রপাত ঘটায়। বড় বিল্ডিং ও টাওয়ারের উপরেও একই ঘটনা ঘটে। তাই বর্তমানে দেশে তালগাছ লাগাতে বলা হচ্ছে। ঝড়বৃষ্টির সময় সম্ভব হলে পাকা বাড়ির ভেতরে থাকতে হবে। কারণ বাড়ির ভেতরে লোহার রড থাকে। এ লোহার রড বিদ্যুৎ পরিবাহী। ফলে পাকা বাড়িতে বজ্রপাত হলে মেঘের থেকে ইলেকট্রন লোহার রডের ভেতর দিয়ে মাটিতে চলে যায়।
২. পানির কাছে যাওয়া যাবে না। কারণ পানি বিদ্যুৎ সুপরিবাহী।
৩. মোটরসাইকেল বা সাইকেল চালনারত থাকলে দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে।
৪. বজ্রপাতের আওয়াজ শোনার আগে তা মাটিতে স্পর্শ করে। কারণ আলোর বেগ শব্দের বেগের চেয়ে বেশি; তাই বজ্রপাত হওয়ার পরে শব্দ শোনা যায়।
৫. বজ্রপাতের সময় বাড়ির ভেতরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে হবে।
৬. বজ্রপাতের সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যায়; তবে ল্যান্ডফোন খুব বিপজ্জনক, কারণ এটি তার দ্বারা যুক্ত থাকে।
৭. বাড়ির সব বৈদ্যুতিক সামগ্রী যেমন-টিভি, ফ্রিজ, ফ্যান, এসি ইত্যাদির প্লাগ বন্ধ ও খুলে রাখতে হবে।
৮. কোনো ফাঁকা মাঠে থাকলে কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে মাঠের কম সংস্পর্শে থাকুন। নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ৯. গাড়িতে থাকলে তার দরজা-জানালা বন্ধ করে দিন। গাড়ির ধাতব পদার্থগুলো বিদ্যুৎ সুপরিবাহী। ফলে গাড়িতে বজ্রপাত হলে গাড়ির ধাতব পদার্থের মধ্য দিয়ে মেঘ থেকে আসা ইলেকট্রনগুলো মাটিতে চলে যায়। তাই বজ্রপাতের সময় গাড়িতে বসে গাড়ির ধাতব পদার্থগুলো স্পর্শ করা যাবে না।

বাড়িঘর, উঁচু টাওয়ার ইত্যাদি রক্ষা করার জন্য বাড়িতে Lightning Rod নামে একটা যন্ত্র লাগানো হয়। এটাকে Lightning Arrester বলা হয়। এতে একটি কপার রড বাড়ির উপর থেকে মাটির নিচে গভীরে কপার প্লেটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। কপার রডের উপরের প্রান্ত বাড়ির ছাদের উপরে উঁচু স্থানে থাকে। রডের উপরের প্রান্তে কপারের স্ক্রুর সাহায্যে চিকন ছোট কয়েকটি কপারের রড যুক্ত থাকে, যার খোলা প্রান্ত সূচিমুখের মতো থাকে। বাড়িতে Lightning Rod সংযুক্ত থাকলে মেঘ যখন বাড়ির উপর দিয়ে যায় তখন মেঘের নিচের দিকে থাকা নেগেটিভ চার্জের জন্য তড়িৎ আবেশ প্রক্রিয়ায় Lightning Rod-এর ওপরের প্রান্তে সংযুক্ত চিকন রডের সূচিমুখে প্রচুর পজিটিভ চার্জ আবিষ্ট হয়, কারণ সূচিমুখের ব্যাসার্ধ কম থাকে।

বাতাসের পরমাণুর পজিটিভ চার্জ সূচিমুখের পজিটিভ চার্জ দ্বারা বিকর্ষিত এবং মেঘের নিচের দিকে থাকা ইলেকট্রনের দ্বারা আকৃষ্ট হয়। মেঘের ইলেকট্রন বা নেগেটিভ চার্জ পজিটিভ চার্জ দ্বারা Neutral হতে থাকে। ফলে চার্জ কম হতে থাকে।

চার্জ কমার ফলে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র কমতে থাকে। ফলে বজ্রপাতের সম্ভাবনা কমতে থাকে। এছাড়া আর্লি স্ট্রিমার এমিশন এয়ার টার্মিনাল (ESEAT) নামক বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্রটি বজ্রপাত ঠেকাতে পারে। এতে দ্রুততার সঙ্গে বজ্রপাত ট্রান্সমিট হয়ে ভূগর্ভে চলে যায়। এ বজ নিরোধক যন্ত্র ৮৭ থেকে ১০০ মিটার বা ৩০০ ফুট এলাকায় নিরাপত্তা দিতে সক্ষম। বর্তমানে এ যন্ত্রটি বাংলাদেশেও ব্যবহার হচ্ছে।

বজ্রপাত থেকে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়। যেমন তাপশক্তি, শব্দশক্তি, বিদ্যুৎশক্তি। বজ্রপাতের শক্তি সঞ্চয় করে রেখে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করার জন্য বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে যাচ্ছেন। আল্লাহতায়ালা মানুষের কল্যাণের জন্য কিছু দিয়েছেন সরাসরি, কিছু রেখেছেন রহস্যাবৃত করে। মানুষ তার জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে ভবিষ্যতে হয়তো বজ্রপাতের শক্তি সঞ্চয় করে রাখার প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করবে। তখন আমরা পাবো অবিরাম বিদ্যুৎ, লোডশেডিং আর থাকবে না। তথ্যসূত্র: যুগান্তর

পরামর্শদাতা: নাসিম সুলতানা, সহকারী অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞান, মইন উদ্দিন আদর্শ মহিলা কলেজ; বাগবাড়ী, সিলেট।

পূর্বকোণ/সাফা

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট