চট্টগ্রাম সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

খলিফা ওসমান (রা) হত্যাকাণ্ডের জেরেই মুসলিমদের মধ্যে ফেৎনা শুরু

৩ আগস্ট, ২০২২ | ৫:১৩ অপরাহ্ণ

আল্লাহর প্রিয় হাবিব মুহাম্মদ (সা) যখন মদীনায় ছিলেন তখন সুন্দরভাবে আশুরা পরিচালনা করেছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর আবু বক্কর (রা) ইসলামের প্রথম খলিফা হলেন। তাঁকে খলিফা নির্বাচনের সময় বনি সাদ আর আনসার-মুহাজেরদের বিশাল গণজমায়েত ছিল। তারা সিদ্ধান্ত নিল আমরা আমিরুল মুমেনিন বানাবো আবু বক্কর (রা)কে। তিনি আড়াই বছর খলিফার দায়িত্ব পালনের পর ইন্তেকাল করেন। তবে তার আগেই জীবদ্দশায় তিনি সাহাবাদের পরামর্শক্রমে হযরত ওমর (রা) এর নাম পরবর্তী খলিফা হিসাবে ঘোষণা করেন।

ওমর (রা) ১০ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। সর্বপ্রথম তিনি “আমিরুল মুমেনিন” উপাধি লাভ করেন। তিনি যখন ফজরের নামাজের ঈমামতি অবস্থায় একজন ইহুদি গোলামের খঞ্জরের আঘাতে গুরুতর আহন হন । তখন বুঝতে পারলেন তাঁর মৃত্যু সন্নিকটে। তিনি আর বাঁচবেন না। তখন তিনি ৬জন শীর্ষ আলেম, সাহাবাদের কমিটি গঠন করলেন। বললেন, এই ৬জন পরামর্শের মাধ্যমে তাদের মধ্য থেকে বা বাইরে থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে খলিফা মনোনীত করবেন। তাঁর মৃত্যুর পর ওই ৬জনের পরামর্শমতে হযরত ওসমান (রা) খলিফা হলেন।

হযরত ওসমান (রা) প্রায় ১২ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তখন হজের মৌসুম। সব সাহাবায়ে কেরাম যখন হজে চলে গেছেন, তখন ইহুদি ষড়যন্ত্রকারী এবং কিছু নতুন মুসলমান মিলে মদীনা অবরোধ করে। তারা ওই সময় আক্রমন চালিয়ে ওসমান (রা)কে শহীদ করেন। তখন থেকে ইসলামের মধ্যে ফেৎনা শুরু হয়।

ওসমান (রা) শহীদ হন নতুন মুসলিমদের হাতে। তাঁর মৃত্যুর পর মদীনাতে যারা ছিলেন তারা সর্বসম্মতিক্রমে হযরত আলী (রা) কে খলিফা ঘোষণা করেন। তিনি খলিফা হওয়ার পর বেঁকে বসলেন ওসমান (রা) এর বংশধর তথা উমাইয়ারা। তারা দাবি করলো, আমরা আলীকে ততক্ষণ পর্যন্ত মানবো না, যতক্ষণ না পর্যন্ত ওসমান হত্যার বিচার না করা হয়। তখন উমাইয়া বংশের বিশাল একটি দল তৈরী হয়ে গেল। তাদের সাথে অনেকে যোগ দিল। তারা ওসমান হত্যার বিচার দাবিতে অনড়। তারা ঘোষণা করল, বিচার না হলে আলীর আনুগত্য করবেন না, আলী (রা) কে খলিফা মানবেন না।

এই দ্বন্ধে কুফার মধ্যে দু’দল মুখোমুখি হলো। একপক্ষে ছিল হযরত আলী (রা)। অপরপক্ষে ছিল তালহা যুবায়ের ও আয়েশা (রা)। ওসমান হত্যার বিচারের জন্য সবাই দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়ল। পরিশেষে ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় উটের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে তালহা জুবায়ের ও আয়েশা (রাঃ) সম্মিলিত যুদ্ধ। আয়েশা (রাঃ) উটের উপর সওয়ার হন বিধায় উটের যুদ্ধ নামকরণ করা হয়। ওই যুদ্ধে প্রায় ১০ হাজার সাহাবা, তাবেয়ীন শহীদ হন। এতে আয়েশা (রাঃ) এর দল পরাজিত হন। পরাজিত হওয়ার পর আয়েশা (রাঃ) তাঁর ভুল বুঝতে পারেন। তিনি বুঝতে পারেন এভাবে মুসলমানে-মুসলমানে যুদ্ধ করা ঠিক হয়নি। তওবা করে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করেন, ক্ষমা চান।

এদিকে খলিফার দায়িত্বে আলী (রা)। ফিৎনা তখনো দমেনি। ওদিকে সিরিয়ার গভর্ণর ছিলেন মুয়াবিয়া (রা)। তিনি ওমর (রা) এর যুগ থেকে সিরিয়ার গভর্ণর। প্রায় ২০ বছর এই দায়িত্ব পালন করছেন। গোটা সিরিয়াবাসী তার পক্ষে। তিনি বনি উমাইয়ার শীর্ষ নেতা। তিনিও বলেন, আমি আলীর হাতে বায়েত হবো, যদি তিনি ওসমান হত্যার বিচার করেন। কিন্তু আলী বললেন, উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে জটিল এই বিচার করা সম্ভব নয়। যখন পরিস্থিতি শান্ত হবে–তখন বিচার করা সম্ভব হবে। ওসমান হত্যাকারীদের বিশাল দল ছিল। তাদের বিচার করতে গেলে ফেৎনা আরো বেড়ে যাবে। তাই তিনি সময় চান। আর উমাইয়ারা সময় দিতে রাজি নয়।

এই দ্বন্ধে আলী এবং মুয়াবিয়ার মধ্যে চূড়ান্ত আরেকটি যুদ্ধ হলো, যাকে আমরা সিফ্ফিনের যুদ্ধ বলি। সিফিনের যুদ্ধ ছিল উটের যুদ্ধের পরে প্রথম ফিতনার দ্বিতীয় যুদ্ধ। বর্তমান সিরিয়ার রাক্কার আশেপাশে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে সিফফিন নামক স্থানে এই যুদ্ধ হয়৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে । সিফফিনের যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল প্রায় চারমাস। এই যুদ্ধে ৮০ হাজার তাবেয়ীন-সাহাবা শাহাদাত বরণ করেন।

ওসমান (রা) এর শাহাদাতের পর শুরু হওয়া ফেৎনার কারণে পরিশেষে দুইভাগ হল ইসলামি খেলাফত। সিরিয়া শাসন করেন মুয়াবিয়া। আর ওদিকে কুফা, বশরা, মক্কা ও মদীনা শাসন করেন আলী (রা)। তখন মুয়াবিয়া রাজধানী ঘোষণা করলেন সিরিয়াকে। আলী(রা) রাজধানী ঘোষণা করলেন কুফা। হযরত আবু বক্কর (রা), ওমর (রা) ও ওসমান (রা) এর যুগে ইসলামী খেলাফেতের রাজধানী ছিল মদীনা। সর্বপ্রথম আলী (রা) ইরাকের কুফাকে এবং মুয়াবিয়া সিরিয়াকে রাজধানী ঘোষণা করলেন।

সিফ্ফিনের যুদ্ধের পর কিছু মুনাফিক চিন্তা করলো তারা আলী (রা) ও মুয়াবিয়া উভয় নেতাকে হত্যা করবে। ইতিহাসে এরা খারেজি বা দলত্যাগী নামে কুখ্যাত। তাদের হত্যা করার জন্য তারা উভয় নেতার কাছে একইদিনে লোক পাঠাল। আলী (রা) ফজরের নামাজ পড়ার জন্য বের হলে তাঁকে শহীদ করা হলো। মুয়াবিয়া অসুস্থ থাকার কারণে বের না হওয়ায় বেঁচে যান। আলী (রা) শহীদ হওয়ার পর তার গ্রুপ সেখানে হাসান (রা) কে খলিফা বানালেন। হাসান খলিফা হওয়ার সময় ওদিকে মুয়াবিয়া খলিফা ছিলেন। আবার তারা যুদ্ধের মুখোমুখি হলেন। তখন হাসান চিন্তা করল, এভাবে মুসলমান যুদ্ধে লিপ্ত হলে লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে। এরচেয়ে সন্ধি করা ভাল। তখন তিনি দূতের মাধ্যমে সন্ধির প্রস্তাব দিলেন। সন্ধি হয়ে গেল।

মুয়াবিয়া অখন্ড মুসলিম বিশ্বের আমীর হবেন। তবে তারপর আমীর হবেন হাসান (রা)। মুয়াবিয়া ৪০ থেকে ৬০ হিজরী পর্যন্ত ২০ বছর খেলাফত পরিচালনা করেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় হলো মুয়াবিয়ার মৃত্যুর আগে হাসান মারা যান। কারো মতে বিষপানে তিনি ষড়যন্ত্রের কারণে শহীদ হয়েছেন। তাই সেই কারণে চুক্তি বাতিল হয়ে গেল। চুক্তি বাতিল হলেও তার ছোট ভাই হোসাইন (রা)কে খলিফা বানানো যেত। কিন্তু কুচক্রি মহলের কারণে মুয়াবিয়া তার ছেলেকে খলিফা ঘোষণা করলেন। ছেলেকে ৩জন লোকের ব্যাপারে অসিহত করলেন মুয়াবিয়া। “যারা যোগ্য তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ বিন ওমর। মানুষ তাঁকেও খলিফা বানাতে পারে। তবে সে বেশি আবেদ। এধরনের রাষ্ট্রনায়ক হওয়া পছন্দ করে না। আরেকজন হোসাইন (রা)। তিনি সাধাসিধে। তার পিতার হত্যাকারীরা তার জন্য যথেষ্ট। তাকে ধোকা দেবে। অপরজন আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের। সে অনেক চালাক। তাই কৌশলে তাকে দমাতে হবে”। এই বলে ছেলেকে নসিহত করলেন মুয়াবিয়া ।

মুয়াবিয়া যখন ৬০ হিজরীতে মারা গেলেন, তখন ইয়াজিদ খলিফা হল। তখন সাথে সাথে সে চিঠি পাঠালো মদীনার গভর্ণর ওয়ালিদের নিকট। তুমি তাড়াতাড়ি মদীনাবাসী থেকে বায়েত গ্রহণ কর। বিশেষ করে আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের, হোসাইন (রা) ও আবদুল্লাহ বিন ওমর থেকে বায়েত গ্রহণ করার নির্দেশ দেন । তখন চিঠি পাওয়ার পর ঘোষণা করার আগে তাদের ডাকলেন। হোসাইন আসলেন, ওয়ালিদের দরবারে। তখণ গভর্ণর ওয়ালিদ বললেন, মুয়াবিয়া ইন্তেকাল করেছেন। তখন তিনি ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্নাইলাইহে রাজেউন পড়েন। এরপর বললেন, আপনি ইয়াজিদের জন্য বায়েত গ্রহণ করুন। তখন তিনি বললেন, আমার মতো মানুষ গোপনে বায়েত গ্রহণ করা ঠিক নয়। মসজিদে সবাইকে ডাকেন। সবার সম্মতিতে আমি বায়েত গ্রহণ করবো। এই বলে তিনি চলে যান।

লেখক: ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট