চট্টগ্রাম সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

আজ বৃহস্পতিবার বার্ষিক ওরশ

চট্টগ্রামে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকারীদের অন্যতম শাহ্ আমানত খান (রহ.)

৩০ জুন, ২০২২ | ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ

বারো আউলিয়ার পূন্য ও ধন্যভূমি চট্টগ্রামে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয় পীর আউলিয়া ফকির দরবেশের মাধ্যমে। সুদূর আরব এবং ভারত থেকে কিছু পীর আউলিয়া, ফকির ও দরবেশ এখানে এসেছিলেন মানব কল্যাণ এবং ইসলাম প্রচারের জন্য। চট্টগ্রামে আগত পীর, আউলিয়া, ফকির-দরবেশদের মধ্যে হযরত বদর শাহ (রহ.), হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.), হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.), হযরত মোল্লা মিছকিন শাহ (রহ.), হযরত শেখ ফরিদ (রহ.), হযরত শাহ গরীব উল্লাহ শাহ (রহ.), হযরত বদনা শাহ (রহ.) প্রকাশ শফি শাহ (রহ.), হযরত আনার উল্লাহ শাহজী (রহ.), হযরত শাহ চান্দঁ আউলিয়া (রহ.), হযরত শাহ সুফি আমানত খান (রহ.) সহ অসংখ্য পীর আউলিয়া রয়েছেন। তাদের আগমনে চট্টগ্রাম ধন্য হয়েছে।

চট্টগ্রামের সূফিদের আসন কখনো খালি ছিলনা, এখনও খালি নেই। রাজা-বাদশাহরা যেমন পার্থিব ব্যাপারে রাজত্ব করেন, তেমনি সুফীদের মতে- সুফীরা ধর্মরাজ্যের রাজা। সূফীরা পৃথিবীর সব ধরণের বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করেন। তাঁরা আল্লাহর প্রিয় পাত্র হওয়ায় আল্লাহ তাঁদের সুপারিশ গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামে আগত পীর আউলিয়া, ফকির দরবেশদের মধ্যে হযরত শাহ সুফি আমানত খান ছিলেন অন্যতম একজন। চট্টগ্রামের আধ্যাত্মিক বেলায়েত রক্ষা, ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং মানব কল্যাণ করার জন্য তিনি সুদূর ভারত থেকে চট্টগ্রাম এসেছিলেন।

হযরত শাহ সুফি আমানত খান (রহ.) এর চট্টগ্রামে আগমন সম্পর্কে সঠিক সময় জানা না গেলেও ধারণা করা হয় ১৭৯৩ খৃষ্টাব্দের পরে তিনি চট্টগ্রাম আসেন। ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন। হযরত শাহ সুফি আমানত খান (রহ.)-এর পূর্বপুরুষের নিবাস ছিল ইরাকে। তিনি বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর বংশধর ছিলেন। তাঁর বাবার নাম হযরত নিয়ামত শাহ (রহ.)। ভারতের বিহারের প্রখ্যাত সাধক সুফী হযরত মোনায়েম পাকবাচ তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন।বংশ পরম্পরায় বুজুর্গ ছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষগণ। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে প্রথম ভারতে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে পীর আউলিয়া, ফকির দরবেশগণ তৎপর ছিলেন। ঠিক সেই সময় ভারতের কাশ্মির, পাটনা, লৌক্ষ্ণ, মুর্শিদাবাদ ছিল সুফী দরবেশদের মিলন ক্ষেত্র। এসব স্থান থেকে সুফী দরবেশগণ বিভিন্ন স্থানে ধর্ম প্রচারের জন্য বেরিয়ে পড়তেন।

তৎকালীন সময়ে মহান সাধক হযরত শাহ সুফি আমানত খান (রহ.) ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং আল্লাহর সাধনায় নিজেকে নিবেদন করেছিলেন। সংসারের সমস্ত মায়া ত্যাগ করে তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য বিহার থেকে কাশ্মির চলে যান। কাশ্মিরে গিয়ে তিনি শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন প্রখ্যাত সাধক পীর হযরত শহীদ (রহ.)-এর। দীর্ঘ ১২ বছর তিনি সেখানে অবস্থান করে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন এবং আধ্যাত্মিক জগতের শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন। তাঁর পীর তাঁকে বেলায়েতের সমস্ত ক্ষমতা প্রদান করেন ও তাঁকে ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং মানব কল্যাণের পথে নিজেকে নিয়োজিত করার উপদেশ দেন। এরপর হযরত শাহ সুফি আমানত খান (রহ.) চট্টগ্রামের বেলায়েত রক্ষা এবং প্রচারের জন্য বিহার থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।

তিনি চট্টগ্রামে আসার পর নিজের পরিচয় গোপন রেখে চট্টগ্রামের কোর্ট বিল্ডিং-এ পাখা টানার চাকরি শুরু করেন। চাকরি শেষে রাতের বেলায় লালদীঘির পূর্ব পাড়স্থ নিজস্ব ছোট্ট কুঠিরে আল্লাহর ধ্যানে মশগুল থাকতেন। তিনি চট্টগ্রামে অবস্থানকালে ইসলাম প্রচারের কাজ করতেন এবং মানবকল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেন। তিনি সব সময় দুঃস্থ-অসহায়ের সাহায্যে এগিয়ে যেতেন। সাধাসিধে জীবন যাপন করতেন তিনি। তাঁর আচার-ব্যবহার, চলাফেরা, কথাবার্তায় অমায়িকভাব থাকার কারণে লোকজন তাঁকে মিয়া সাহেব বলে সম্বোধন করতেন। অল্প আহার ও অধিক এবাদত করা ছিল তার করণীয় কার্যাবলীর মধ্যে অন্যতম। ভক্তদের তিনি হালাল উপার্জন, সৎ জীবন-যাপন, সংযমী এবং এবাদতে মশগুল থাকার পরামর্শ দিতেন।

মানব কল্যাণ করতে গিয়ে তাঁর প্রচন্ড আধ্যাত্মিক শক্তি প্রকাশ পায়। তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির বিষয় প্রকশের পর তিনি আর চট্টগ্রামের কোর্ট বিল্ডিং-এ চাকরি করতে পারেননি। ফলে চাকরি ছেড়ে ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং মানব কল্যাণে নিজেকে পুরোপুরিভাবে নিয়োজিত করেন তিনি। তাঁর জ্যোতিময় চেহারা দেখে মানুষ মোহিত হয়ে যেত। দলে দলে তাঁর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসতে থাকে। তিনি কাউকে জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করেননি। ধনী-গরীবের মধ্যে কোন সামাজিক ব্যবধান তিনি সহ্য করতে পারতেন না। কষ্টার্জিত আয়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকাটা তিনি বেশি পছন্দ করতেন। তিনি সব সময় এহরামের কাপড়ের মত সাদা কাপড় পড়তেন।

চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন অবস্থান করে ইসলাম এবং মানবতার কল্যাণ করে ১১৮৭ হিজরীর ৩১ জিলকদ ১২৫ বছর বয়সে ইন্তেকালের পর তাঁকে লালদীঘির পূর্বপাড়স্থ খানকাহ শরীফে সমাহিত করা হয়। তাঁর মাজার শরীফ হচ্ছে চট্টগ্রামের তীর্থস্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রতিদিন তাঁর পবিত্র মাজার শরীফে হাজার হাজার ভক্ত আসেন নিজ নিজ মনোবাসনা নিয়ে। তাঁর পবিত্র মাজার শরীফে সমস্ত কর্মকাণ্ড শরীয়ত মতে হয়ে থাকে। শরীয়ত বিরোধী সমস্ত কর্মকাণ্ড এখানে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দুঃস্থ ও গরীব-অসহায়দের জন্য দুবেলা লঙ্গরখানার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। এছাড়াও মাজার কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হয়। উল্লেখ্য, হযরত শাহ সুফি আমানত খান (রহ.) এর বার্ষিক ওরশ আজ বৃহস্পতিবার।

লেখক : প্রাবন্ধিক।

 

পূর্বকোণ/এএস/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট