চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যখাত : একটি পর্যালোচনা

১৬ জুন, ২০২১ | ৭:৪৭ অপরাহ্ণ

প্রথম পর্ব। নিম্নের সংবাদচিত্রসমূহের প্রতি সম্মানিত পাঠকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ১) চট্টগ্রামে হাসপাতালে করোনাচিকিৎসার চিত্র:  চট্টগ্রামে করোনাচিকিৎসায় ২৪টি আইসিইউ, ১০টি ভেন্টিলেটরসহ মাত্র ৩৩০টি বেড রয়েছে। অথচ এরই মধ্যে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই দাঁড়িয়েছে তিন হাজারের উপর (যুগান্তর, ০৭-০৬-২১)।

২) বিগত জানুয়ারি, ২০২০ এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে জনসংখ্যার অনুপাতে আইসিইউ বা ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিট বেডের সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম। নেপালে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য আইসিইউ আছে ২ দশমিক ৮, ভারত ও শ্রীলংকায় ২ দশমিক ৩, পাকিস্তানে ১ দশমিক ৫, মিয়ানমারে ১ দশমিক ১, বাংলাদেশে আছে ০ দশমিক ৭ টি (যুগান্তর, ১২-০৫-২০)।

৩) আইএমএফ-এর তথ্য অনুযায়ী, মহামারী মোকাবেলায় বাংলাদেশ এই পর্যন্ত ব্যয় করেছে জিডিপি-এর মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। যার পরিমাণ ৪৬০ কোটি ডলার। এর মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় মাত্র ৪০ কোটি ডলার। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ব্যয় জিডিপি-এর ৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং পাকিস্তান এই পর্যন্ত ব্যয় করেছে জিডিপি এর ২ শতাংশ (ঢাকা টাইমস, ২৮-০৫-২১)।

৪) বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য বাজেটে খুবই অপ্রতুল বরাদ্দ রাখা হয়। ২০২০-২১ বছরের বাজেটে মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্র ১ হাজার ৫৩৭ টাকা ছিল। এ কারণে মানুষকে নিজের পকেট থেকে প্রায় ৬৬ শতাংশের মতো খরচ করতে হয়। অর্থাৎ স্বাস্থ্যের পেছনে ১০০ টাকা খরচ হলে সরকারি সহায়তা পাওয়া যায় ৩৪ টাকা এবং বাকী ৬৬ টাকা রোগী নিজে বহন করে। এই টাকা খরচ করা অনেক মানুষের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় (সিপিডি-এর নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, সাম্প্রতিক দেশকাল, ০৭-০৬-২১)।

৫) পাওয়ার এন্ড পারটিসিপেশান রিসার্চ বা পিপিআরসি এবং ব্র্যাক ইনসটিটিউট অব গভর্নেন্স এন্ড ডেভেলারমেন্ট-এর এক যৌথ গবেষণা অনুযায়ী দেশে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা ২ কোটি ৪৫ লক্ষ।আগের সাড়ে ৩ কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংগে এই নতুন দরিদ্র মিলে এখন দেশে সর্বমোট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৬ কোটির মতো। দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে (সানেম জরিপ জানুয়ারি ২০২১, ঢাকা টাইমস, ২৮-০৫-২১)।

উল্লিখিত সংবাদচিত্রসমূহ পর্যালোচনা করলে বিপর্যস্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে চিত্র ফুটে উঠে তা হচ্ছে- ১) গুরুতর রোগীদের চিকিৎসা সরঞ্জামাদির অভাব প্রকট। চট্টগ্রামে অভাব আরো বেশী। ২) মহামারী মোকাবিলায় দক্ষিন এশিয়ায় জিডিপি-এর হিসাবে বাংলাদেশ সবচেয়ে কম ব্যয় করেছে। ৩) স্বাস্থ্যখাতে অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দের কারণে সরকানরি স্বাস্থ্যসেবার উপর নির্ভরশীল সাধারণ জনগোষ্ঠীকে নিজেদের পকেট থেকে দুই-তৃতিয়াংশ চিকিৎসাব্যয় বহন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে এবং এর ফলে দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এসব অচলাবস্থার পেছনের কারণসমূহ জানতে হলে নিম্নের তথ্যাদি পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। ক) বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা তিনটি ধাপে বিভক্ত। ১) প্রাইমারী ধাপ : ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও মাতৃমংগলকেন্দ্র, ওয়ার্ড পর্যায়ে কম্যুনিটি ক্লিনিক, বেসরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পৌর ও সিটি করপোরেশন স্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহ। ২) সেকেন্ডারী ধাপ : জেলাপর্যায়ে অবস্থিত সরকারি হাসপাতালসমূহ, বেসরকারি পর্যায়ের হাসপাতালসমূহ, পৌর ও সিটি করপোরেশন হাসপাতালসমূহ। ৩) টারশিয়ারী ধাপ : জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে অবস্থিত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসমূহ, বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষায়িত হাসপাতালসমূহ।

খ) রোগীদের চিকিৎসা অর্থনৈতিক অবস্থা : ১) স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে দারিদ্র্যের শিকার হওয়া : স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে দারিদ্র্যের শিকার হওয়ার হার বাংলাদেশে খুব বেশি, প্রায় ৭৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। যেটি দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সবচেয়ে বেশি আফগানিস্তানে ৭৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ (দ্য ডেইলী স্টার,০৪-০৬-২১)। ২) বাংলাদেশে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারি ব্যয় সর্বনিম্ন এবং ব্যক্তিগত ব্যয় সর্বোচ্চ। মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারি ব্যয় ভারতে ৩৩ সতাংশ, নেপালে ৪০ শতাংশ,বাংলাদেশে ২৩ শতাংশ। মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে ব্যক্তিগত ব্যয় ভারতে ৫৭ শতাংশ, নেপালে ৪৯ শতাংশ,বাংলাদেশে ৬৩ শতাংশ।

গ) সরকারি খাতে অপর্যাপ্ত চিকিৎসক নিয়োগ : বাংলাদেশে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি খাত মিলিয়ে সর্বমোট চিকিৎসক প্রয়োজন কমপক্ষে ১০২৫৬৫ জন। বর্তমানে সরকারি চিকিৎসকের সংখ্যা ২৬১৫৩ জন। যা মোট প্রয়োজনের ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ মাত্র।

ঘ) অপর্যাপ্ত সেবাকর্মী নিয়োগ : প্রয়োজনের তুলনায় নার্স রয়েছে মাত্র ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ঙ) অপর্যাপ্ত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী একজন চিকিৎসকের বিপরীতে পাঁচজন টেকনোলজিস্ট থাকা প্রয়োজন। সে হিসাবে বাংলাদেশে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকা প্রয়োজন ১০২৫৬৫ x ৫ বা ৫১২৮২৫ জন। বর্তমানে দেশে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট আচে মাত্র ১০৬৫৩ জন,যা প্রয়োজনের ২ শতাংশ মাত্র। চ) প্রস্তাবিত ২০২১-২২ বাজেটে স্বাস্থ্যখাত : ১) ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট প্রস্তাবিত বাজেটের পরিমাণ ৬ লাখ ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবাজেট ৩২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উন্নয়ন খাতে ১৩ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ২ দশমিক ১ শতাংশ। স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের উন্নয়ন খাতে ২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ০ দশমিক ৪ শতাংশ। উভয় বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা বাবদ ১৭ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ২ দশমিক ৮ শতাংশ। ২) এর মধ্যে মহামারীকালে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী (বিডিনিউজ ২৪ ডট কম, ০৩-০৬-২১)।

৩) স্বাস্থ্যশিক্ষার সম্প্রসারণ : স্বাস্থ্যখাতের অর্জনসমূহকে টেকসই করা ও ভবিষ্যতে মহামারীর অভিঘাত হতে পরিত্রাণ পাওয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মানসম্পন্ন গবেষণাভিত্তিক স্বাস্থ্যশিক্ষার সম্প্রসারণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য আগামী অর্থবছরেও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে (জাগোনিউজ ২৪ ডট কম,০৩-০৬-২১)।
ছ) চলতি ২০২০-২১ ও প্রস্তাবিত ২০২১-২২ বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের তুলনা : স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ০ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ০ দশমিক ৩১ শতাংশ বেড়েছে। স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কম-বেশি হয়নি। উভয় বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা বাবদ বরাদ্দ ০ দশমিক ১ শতাংশ বেড়েছে। জ) স্বাস্থ্যখাতে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি দেখালেও প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ তেমন বাড়েনি। অতি সামান্য ০ দশমিক ৪৩ শতাংশ অর্থাৎ এক শতাংশেরও কম বৃদ্ধি করোনাবিপর্যয় সামলিয়ে ভেংগে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পুনরায় খাড়া করতে মোটেও তেমন অবদান রাখতে পারবে না। এটা স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের অভিমত।
ঝ) ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি : মন্ত্রীপরিষদ সচিব বলেছেন, মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি জিডিপি-এর পরিমাণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ ৮৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, আগে যা ছিল ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা (প্রথম আলো, ১৭-০৫-২১)। ঞ) মোট বাজেটের অনুপাতে বরাদ্দ বাড়লেও জিডিপির হিসাবে বরাদ্দ বাড়ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী স্বাস্থ্যখাতে জিডিপি-এর কমপক্ষে ৫ শতাংশ ব্যবহার করা উচিৎ। সে অনুযায়ী এ বছরের ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ দেয়া উচিৎ ছিল ৩০৮৭৩০০.২০ বা ১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। কিন্তু বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৫৪৩৬৫-৩২৭৩১ বা ১ লাখ ২১ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা কম প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির ০ দশমিক ৯২ শতাংশ বরাদ্দ ছিলো। এবার প্রস্তাবিত ২০২১-২২ বাজেটে তা কিছুটা কমে ০ দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে আসছে (মেডিভয়েস, ২৯-০৫-২১)।
ট) জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার জন্য বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম : ১) সামগ্রিক সব ব্যয় হিসাব করা হলে দেশের মোট স্বাস্থ্যব্যয় জিডিপির ২ দশমিক ৩৪ সতাংশ এবং মাথাপিছু স্বাস্থ্যব্যয় ১১০ ডলার। গত সাত অর্থবছর ধরে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের ৫ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতে বরাদ্দ ছিলো ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। এটি ঐ অর্থবছরের মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই বরাদ্দের পরিমাণ ছিলো ২২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৫ দশমিক ০৫ শতাংশ। ২) জিডিপির বিচারে কম বরাদ্দ : এসকাপ-এর ২০১৮ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিডিপির বিচারে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২ টি দেশের মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেওয়া হয় বাংলাদেশে (সাম্প্রতিক দেশকাল, ০৬-০৬-২১)।

ঠ)স্বাস্থ্যখাতে মাথাপিছু বরাদ্দ বাংলাদেশে কম : ১) বর্তমানে স্বাস্থ্যখাতে মাথাপিছু বরাদ্দ বাংলাদেশে ৩২ ডলার, ভারতে ৬১ ডলার,নেপালে ৩৯ ডলার, ভিয়েতনামে ১১১ ডলার, মালদ্বীপে ৭২০ ডলার, শ্রীলংকায় প্রায় ১০০০ ডলার (মেডিভয়েস, ২৭-০৬-১৮)। 

লেখক: ডা. হাসান শহীদুল আলম

পূর্বকোণ/মামুন/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট