চট্টগ্রাম সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

শীত ও দরিদ্রজনদের জীবন

সমকাল দর্পণ

ড. মাহফুজ পারভেজ

২১ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:১২ পূর্বাহ্ণ

আসি আসি করে চলে এসেছে শীত আর বাংলাদেশ হচ্ছে উৎসবমুখর। লোকায়ত বাংলার সাংস্কৃতিক সুষমা নানা উৎসব ও আয়োজনের বাতাবরণে উন্মোচিত হচ্ছে। বাংলার চিরায়ত গান, পালা, পুথিপাঠ, যাত্রা, নৃত্য গ্রামে, গঞ্জে, জনপদে মুখরিত হতে শুরু করেছে।
যদিও এবার পৌষের শুরুতেই বইছে শৈত্যপ্রবাহ, তথাপি থামিয়ে রাখা যাচ্ছে না মানুষের গতি। রং-বেরঙের পোষাকে শীতের সঙ্গে লড়াই করে পথে, ঘাটে, অফিসে, কলেজে ছুটছে মানুষ। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শীত-কাপড়ের বাজারও জমে উঠেছে। ফুটপাতের রেলিং-এ, চলমান ভ্যানে ছড়িয়ে পড়েছে বাহারী শীত-পোষাক।
উৎসবমুখর বাঙালি নানা আয়োজনে শীতকে বরণ করছে, যার মধ্যে পোষাক ও খাদ্যের বৈচিত্র্যময় ছোঁয়া আছে। পিঠা, পুলি খাওয়ার ধুম চলছে। আরও আছে শীতকালীন সাংস্কৃতিক কর্মকা-।
মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বাংলার লোকঐতিহ্যের অনুপম ভা-ার ও প্রসিদ্ধ পূর্ব মৈমনসিংহ-গীতিকা’র লীলাক্ষেত্রে শুরু হয়েছে ৬ দিনব্যাপী লোক সংগীত উৎসব। শুধু ময়মনসিংহ নয়, সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে লোকজ সংগীতের সমৃদ্ধ ধারা। উত্তরবঙ্গের রংপুরের ভাওয়াইয়া, রাজশাহীর গম্ভীরা ছাড়াও ধামাইল, মুর্শিদি, বাউল সংগীতের হৃদয়-ছোঁয়া আবেশ মিশে আছে সারা দেশেই। সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফরিদপুর, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক আবহে সংগীতের বহুমাত্রিক ধারা যুগ যুগ ধরে মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনকে আলোড়িত করছে। আলোকিত করছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভূগোলকে।
বাংলার লোক সংগীত ও সংস্কৃতির যে বিশ্ববিশ্রুত যশ ও সুনাম, তা সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী প্রসারিত। বাংলার মেঠোপথ, নদীতীর, বটমূল ও লোকালয়ে কান পাতলেই বহমান বাতাসের সমান্তরালে প্রবহমান সুরের দোলা টের পাওয়া যায়। মন উচাটন হয় লোকায়ত শিল্পীর চিরায়ত সুরের টানে।
শুধু সংগীত নয়, গ্রামীণ শিল্প, কুটির সামগ্রী, মৃৎশিল্প, ক্রীড়া ও বিনোদন আবহমান বাংলার মহার্ঘ সম্পদ। শীতের আবাহনে, বিশেষত হেমন্তের ধান কাটার পরের অবসর সময়ে বাঙালি মাতোয়ারা হয় লোকজ সংগীতে, ক্রীড়ায় ও নানা রকমের উৎসব ও আয়োজনে।
উৎসব আর সংগীতময়তা বাঙালির প্রাণময়তার প্রমাণবহ প্রতীক। মারী, খরা, দুঃখ, দারিদ্র্যের পরেও বাঙালি উৎসবমুখর। বিত্ত নয়, চিত্ত সম্পদে বাঙালি ঐশ্বর্যের অধিকারী। শত বিরূপতাতেও বাঙালি গান গায়। বেদনাকে ভাসিয়ে দেয় উদাসী বাতাসে। বিষাদকে মিশিয়ে দেয় প্রমত্তা নদীর ভরা¯্রােতে। যাবতীয় যাতনাকে একাকার করে দেয় অমলধবল জোছনার মায়াবী আলোর রেখায়।
শীতে যে উৎসবমুখর বাংলাদেশ জাগ্রত হয় তার সামগ্রিক সংগীত ও সংস্কৃতি নিয়ে, তাকে আন্তরিকভাবে ধারণ করে বাংলার বাঙালি। বাংলার, বাঙালির প্রাত্যহিত যাপিত জীবনের যাবতীয় অনুষঙ্গকে ধারণ করছে এই বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার এই গৌরবময় মাসে, বাংলাদেশের বাঙালি শীতের পরশে সাংস্কৃতিক উত্তাপ ছড়াবে জনপদের সর্বত্র। বিশ্বায়নের আগ্রাসী তা-ব রুখতে নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও স্বকীয়তাকে বিকশিত করতেই হবে। লোক-লোকান্তরের ঐতিহ্যকে পুষ্ট ও সমৃদ্ধ করতে হবে চর্চা ও পালনের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের আত্মা ও অস্তিত্বের যে সৌরভ মিশে আছে চিরায়ত বাংলা সংস্কৃতিতে, তাকে যেকোনও মূল্যে রক্ষা করতে সবাইকে সঙ্কল্পবদ্ধ হতে হবে। বিশ্বায়নের বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনে নিজস্বতার কোনও ক্ষতি যেন না হয়, তা লক্ষ রাখা সবার দায়িত্ব।
এ দায়িত্ব অবশ্যই সরকার ও প্রশাসনের, তবে তা কেবলমাত্র তাদেরই নয়। সমাজ ও ব্যক্তিমানুষকেও এক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে হবে। সবাইকে মিলেই বাংলার সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হবে, বাংলাদেশকে করতে হবে ঋতুতে ঋতুতে উৎসবময়।

ড. মাহফুজ পারভেজ কবি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী; অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট