চট্টগ্রাম সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

দুগ্ধখামারে প্রাণিকল্যাণের ভূমিকা ও করণীয়

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রাশেদুল আলম

১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:০৯ পূর্বাহ্ণ

দুগ্ধখামারের শুরুটা আমাদের দেশে বেশীদিন আগের নয়। প্রাচীনকাল হতেই আবহমান বাংলার একটি কথা প্রচলিত রয়েছে- ‘গোলা ভরা ধান, গোয়ালভরা গরু আর পুকুরভরা মাছ’। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিটি বাড়ীর গোয়ালেই দুইটি বা তিনটি দুগ্ধবতী গাভী থাকতো, যা দ্বারা ঘরের চাহিদার পাশাপাশি গোবরজাত জ্বালানীর চাহিদা মেটাতো। সাথে সাথে এ গরুগুলো অর্থনৈতিক বীমা হিসেবেও কাজ করত। এছাড়াও আর্থিক টানাপোড়ন কালে এই গরুগুলো গেরস্থের অর্থের যোগান দিত। সেইদিন এখন অতীত। নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে মানুষ এখন শহরকেন্দ্রিক জীবিকামুখী। কিন্তু, এই বিশাল জনগোষ্ঠীর দুধের চাহিদা পূরণে সেই দুইটি/তিনটি বা স্বল্প উৎপাদনশীল গাভী এখন যথেষ্ট নয়।

এমতাবস্থায়, এ সহস্রাব্দের উপকণ্ঠে কিছু শিক্ষিত উদ্যমী তরুণের অদম্য ইচ্ছা ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ধীরে ধীরে শুরু হয় বাণিজ্যিক দুগ্ধখামার, যা দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য একইসাথে দেশীয় মাংসের চাহিদা পূরণের লক্ষে সম্পূরক উৎস হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বর্তমানে ‘ডেইরি এবং ফ্যাটেনিং’ একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা এবং অত্যন্ত দ্রুতলয়ে তা সারাদেশে প্রসারিত হচ্ছে। তারপরও প্রতিনিয়ত আমাদের ঘাটতি রয়েই যাচ্ছে। একজন সুস্থ মানুষের জন্য দৈনিক যতটুকু দুধ প্রয়োজন তার চেয়ে দুধ উৎপাদনে আমাদের দেশ এখনো পিছিয়ে। যেহেতু দুগ্ধখামার দেশের দুগ্ধচাহিদা মেটানোর জন্য ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। অতএব এদের কল্যাণ সম্পর্কে খামারী তথা এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণের সচেতন হওয়া জরুরী।
দুগ্ধখামারের মূল উৎপাদিত দ্রব্য হচ্ছে দুধ এবং এটিই মূল লাভের উৎস, যা থেকে আসে বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য। গরুর ওলান হতে দুধ নিঃসরণ পুরোটাই গাভীর শরীরের শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক, পারিপার্শ্বিক অবস্থার একটি জটিল অর্কেস্ট্রা, যার কোন একটি বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় হলে দুধ উৎপাদন হ্রাস এমনকি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। প্রাণিকল্যাণ এই তিনটি বিষয়ের সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদি কোন খামারে প্রাণিকল্যাণের মূলনীতিসমূহ নিশ্চিত করা যায় তবে সুনিশ্চিতভাবেই সে খামারের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।

উন্নত এবং অনুন্নত বিশ্বে, উভয় ক্ষেত্রেই প্রাণিকল্যাণ বিষয়টি বর্তমানে বহুল আলোচিত এবং অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে পঠিত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যে খামারে প্রাণিকল্যাণ সঠিকভাবে রক্ষা করা হয়, সেসব খামারে প্রতি গরুতে উৎপাদন দৈনিক আধা লিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। আরেকটি গবেষণায় দেখা যায় যে, যেসব খামারে বাতাস পরিচলন ও তাপ নির্গমন ব্যবস্থা সঠিক নয়, সেসব খামারে গরমকালে অতিরিক্ত তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার কারণে দুধ উৎপাদন প্রায় ২৭% কমে যায়। এছাড়াও খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ৩০% কমে যাচ্ছে। যার দরুন দুধ উৎপাদন আরো হ্রাস পায়। এছাড়াও যেসব খামারে গরুগুলো ছেড়ে লালন-পালন করা হয় সেখানে শারীরিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক আচার-ব্যবহার ভাল থাকে এবং উৎপাদনও ভাল হয়।

আপাতদৃষ্টিতে গরুকে অনেক শান্তশিষ্ট অবলা প্রাণী বলা হলেও তাদের মস্তিষ্ক ও আবেগ সংক্রান্ত বিষয়গুলো অনেক জটিল। একটি প্রাণী হিসেবে তারও আনন্দ পাবার, দুঃখ-বেদনা সইবার, ভালোবাসা বুঝার ও দেওয়ার অনুভূতি রয়েছে, যা আমরা অনেক সময় বুঝতে পারি না। এই আবেগ ও অনুভূতির সামান্য পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে তাদের উৎপাদন বিশেষত দুধ উৎপাদনে। একটি দুধের খামার লাভজনক হবার জন্য সুস্থ ও স্বাভাবিক গাভীই হলো পূর্বশর্ত। কারণ একমাত্র এ রকম গাভীই পারে সর্বোচ্চ উৎপাদন দিতে, যা খামারের অর্থনীতির জন্য একান্ত অপরিহার্য। সুস্থতা বলতে শুধু শারীরিক সুস্থতা নয় বরং মানসিক সুস্থতাও বুঝায়। দৈনিক চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিতকরণই হচ্ছে প্রাণিকল্যাণের মূল বিবেচ্য। একটি সুস্থ গাভীর জন্য প্রয়োজন উন্নত বাসস্থান, পুষ্টিকর খামার ও পরিপূর্ণ জৈবনিরাপত্তা। আমাদের দেশের খামারে সাধারণত ফ্রিজিয়ান ক্রস জাতের গাভী পালিত হয়। এরা যেহেতু আমাদের এই অঞ্চলের জাত নয় তাই তাদের নিবিড় পরিচর্যা একান্ত জরুরী।

দুগ্ধখামারে পরিচালিত পূর্ববর্তী জরিপ হতে দেখা গেছে যে, যদি গাভীর বাসস্থানের মেঝে পিচ্ছিল থাকে বা এবড়োথেবড়ো হয় তবে অস্থিসন্ধিতে প্রদাহ, খুরের অযাচিত ফাটলসহ সাময়িক ও স্থায়ীভাবে পঙ্গু হবার আশংকা থাকে। অপরিস্কার মেঝের ফলে ম্যাস্টাইটিস বা ওলান প্রদাহের হার বহুলাংশে বেড়ে যায়, যা অনেক গাভীর মৃত্যুও ঘটাতে পারে। অপর দিকে গবেষণাগুলো হতে এটাও প্রতীয়মান হয় যে অনেক দুগ্ধখামারে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার মান সন্তোষজনক নয়। অপ্রতুল নিষ্কাশন ব্যবস্থার ফলে মাছি ও মাছিবাহিত পরজীবীদের আক্রমণ ঘটে। ফলে গাভীর স্বাস্থ্যহানিসহ উৎপাদন হ্রাস পায়। একটি সুস্থ গাভীর দৈহিক গঠন ন্যূনতম ৩.৫ বিসিএস (বডি কন্ডিশন স্কোর) রাখা জরুরী। এর চেয়ে কম স্কোর যদি কোনো গাভীর হয়ে থাকে তবে সে খামারের গাভীগুলো যাথেষ্ট পরিমাণ পুষ্টি পাচ্ছে না। অপুষ্ট গাভীতে যেমন বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি আক্রমণ করে তেমনি মেটাবলিক সমস্যা যথা ক্যালসিয়ামের, গ্লুকোজের ও ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি তৈরী হয়, যা একাধারে গাভীর জন্য কষ্টদায়ক সাথে সাথে খামারের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই পর্যাপ্ত পুষ্টি সম্বলিত খামার গাভীকে দিতে হবে এবং মাঝে মধ্যে গাভীর রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে কোনো প্রয়োজনীয় উপাদানের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে কিনা।

প্রাণীকল্যাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হলো গাভীর মানসিক স্বাস্থ্য। একজন মানুষের মতো গবাদি পশুগুলোও ভালো ও খারাপ আচরণের পার্থক্য বুঝতে পারে। এই আচরণের পার্থক্য শুধু উৎপাদনে নয় বরং শারীরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায়ও বহুলাংশে ভূমিকা রাখে। একটি গভীর সাথে যারা সবচেয়ে বেশি সময় কাটান যেমন খামার শ্রমিক বা গোয়ালারা তাদের সুন্দর ব্যবহার গরুগুলোর উপর খুবই বড় প্রভাব বিস্তার করে। গবেষণায় প্রতিফলিত হয়েছে যে, গাভীর সাথে যদি চিৎকার-চেঁচামেচি করা হয় বা লাঠি দ্বারা আঘাত করা হয় বা ধাক্কা দেয়া হয়, তবে তার দুধের উৎপাদন কমে যায়। এতে বিভিন্ন রোগের সাথে সাথে পায়ের ক্ষতের পরিমাণ বেড়ে যায়। আবার অপরদিকে যদি শরীরে হালকা কোমল স্পর্শে আদর দিয়ে স্ন্দুর স্বরে ডাকা হয় তবে গাভীর উৎপাদন বেড়ে যায়। এর মূল কারণ হচ্ছে দুধ দোহানোর জন্য যে হরমোনটি দায়ী সেই অক্সিটোসিন হরমোন এর নিঃসরণ ভালো হয় বিধায় দুধের উৎপাদন বেড়ে যায়। যদি গাভী কোন কারণে অসুস্থ হয় বা কোন প্রদাহ থাকে অথবা যদি কোনো কারণে খামারে খারাপ ব্যবহারের সম্মুখীন হয় যেমন আঘাত বা জোরে চিৎকার বা থাপ্পর-ধাক্কাজনিত কারণে ভয় পেয়ে কর্টিসল হরমোন নিঃসরণ হয়। এই হরমোন অক্সিটোসিনকে কাজ করতে বাধা দেয়। ফলে দুধ নিঃসরণ কমে যায়। এছাড়া অতি মাত্রায় কর্টিসল বা স্ট্রেস হরমোনের কারণে গর্ভপাতও হতে পারে। অপরদিকে খামারে শ্রমিকেরা তাদের উপরে অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণে সাধারণত ক্লান্ত থাকেন। এতে তাদের চিন্তা-চেতনার চাপ বাড়ে, যার ফলে তারা গাভীর সঠিক পরিচর্যা করতে পারেন না বা অবচেতন মনে খারাপ আচরণ করে ফেলেন। যেহেতু খামারের উৎপাদন এই ‘মানব-প্রাণি সম্পর্কের’ উপর অনেক পরিবর্তন হয় তাই এ বিষয়ে নজর দেয়া খুবই জরুরী।

প্রাণিকল্যাণ একটি বিশদ ও জটিল বিষয়। একটি দুগ্ধখামারে সর্বোচ্চ উৎপাদন বজায় রাখতে হলে খামারের গরুগুলোর শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও লক্ষ্য রাখা দরকার। খামার মালিকদের উচিত খামারের খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনাকে বলবৎ রেখে খামারের অবলা প্রাণিদের নিজের সন্তানের মতো পরিচর্যা করে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও প্রশান্তি বজায় রাখা। আর এই প্রশান্তি বজায় রাখার নিমিত্তে খামারের কর্মচারীদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কেননা সুন্দর খামারব্যবস্থাপনা ও পরিবেশই পারে গাভীকে সুস্থ রাখতে। আর সুস্থ গাভীই হচ্ছে নিরাপদ দুধের মূল শর্ত।

ড. মোহাম্মদ রাশেদুল আলম অধ্যাপক চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়। ৎধংযবফঁষ২০০০@ুধযড়ড়.পড়স

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট