চট্টগ্রাম সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

অর্থনীতির বিপদসংকেত

অধ্যাপক ড. নারায়ণ বৈদ্য

১৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:০৩ পূর্বাহ্ণ

পুঁজিবাদী বিশে^র মধ্যে শ্রেণিগত পার্থক্য রয়েছে। কোন কোন পুঁজিবাদী দেশের ভিত্তি খুবই শক্ত। কোনটা একটু মধ্যম গোচের। আবার কোনটা দুর্বল। বিশে^র পুঁজিবাদী দেশের ধারক-বাহক হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি দুর্বল। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ (সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত) অনুসারে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৩৭ লাখ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭ শতাংশ। পুরুষ ও মহিলার অনুপাত ১০২ : ১০০। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১১০৩ জন। শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৪ জন। এ দেশে বসবাসরত জনগণের গড় আয়ু হয় ৭২ বছর। তৎমধ্যে পুরুষদের গড় আয়ু ৭০.৬ বছর এবং মহিলাদের গড় আয়ু ৭৩.৫ বছর। ডাক্তার ও জনসংখ্যার অনুপাত ১ : ১৭২৪ জন। স্বাক্ষরতার হার ৭২.৩ শতাংশ। জিডিপি (এৎড়ংং উড়সবংঃরপ চৎড়ফঁপঃ) প্রবৃদ্ধির হার ৮.১৩ শতাংশ। এ দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বার্ষিক ১৯০৯ মার্কিন ডলার বা প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসেবে ১,৬২,২৬৫ টাকা যা অবিশ^াস্য। এ সময়ে অর্থনীতিতে মোট শ্রম শক্তি হিসেবে নিয়োজিত আছে ৬.৩৫ কোটি লোক যাদের মধ্যে ৪.৩৫ কোটি পুরুষ এবং ২ কোটি নারী। এর সোজা অর্থ হলো যে, বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ২০১৯ সালে ১৬ কোটি ৩৭ লক্ষ হলেও অর্থনৈতিক কর্মে নিয়োজিত রয়েছে ৬.৩৫ কোটি লোক। অর্থাৎ ৬ কোটি ৩৫ লক্ষ লোক কাজ করে ১৬ কোটি ৩৭ লক্ষ লোকের খাদ্যের সংস্থান করে। বিশে^র কোন দেশে এত বেশি নির্ভরশীল লোক দেখা যায় না।

খাতভিত্তিক শ্রমশক্তির কথা যদি উল্লেখ করা হয় তবে দেখা যায় ৪০.৬ শতাংশ লোক বাংলাদেশে এখনো কৃষি কাজে নিয়োজিত রয়েছে। অবশ্য স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে এদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজের সাথে জড়িত ছিল। শিল্প খাতে নিয়োজিত আছে ২০.৪ শতাংশ এবং সেবা খাতে নিয়োজিত আছে ৩৯ শতাংশ লোক।

বাংলাদেশের মোট সড়কপথের পরিমাণ হয় ২১৫৯৬ কিলোমিটার। তৎমধ্যে জাতীয় মহাসড়ক হচ্ছে ৩৯০৬ কিলোমিটার। আর রেলপথের পরিমাণ হয় ২৯৫৬ কিলোমিটার। ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত এ অর্থ বছরে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ হয় ১১৮৬৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-কে পরিপূর্ণভাবে চালিয়ে নেয়ার জন্য মোট ব্যাংক আছে ৫৯টি। তৎমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক ৬টি। বিশেষায়িত ব্যাংক আছে ৩টি, বেসরকারি ব্যাংক আছে ৪১টি, বৈদেশিক ব্যাংক আছে ৯টি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে ৩৪টি। ২০১৯ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের রিজার্ভ মুদ্রার পরিমাণ হয় ২,২৬,৭৪৩ কোটি টাকা। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে গচ্ছিত রয়েছে। প্রতিটি অর্থনীতিতে চাকুরীজীবীদের কষ্টার্জিত অর্থের মান যে বিষয়টি কমিয়ে দেয় তা হলো মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি যতই বাড়ে প্রাপ্তব্য অর্থের মূল্যমান তত শতাংশ হ্রাস পায়। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, এ সময়ে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৫.৪৪ শতাংশ। অবশ্য এটা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেকাংশে কম। সেই হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশে অর্থনীতির বেশি পরিচিত সূচকগুলো আপাতঃদৃষ্টিতে ঠিকই আছে। এখনো পর্যন্ত প্রত্যাশিত অবস্থা অনুসারে অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। পরিচিত সূচকগুলো হচ্ছে জিডিপি, মাথাপিছু আয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, রপ্তানির পরিমাণ, প্রাপ্ত রেমিট্যান্স, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ, দারিদ্র্যের হার হ্রাসের পরিমাণ, মানুষের গড় আয়ু ইত্যাদি। কিন্তু অর্থনীতির মজবুত ভিত্তিকে বোঝানোর জন্য এগুলো যথেষ্ট নয়। এর সাথে অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হয় বাজেট ঘাটতি বা উদ্বৃত্ত, খেলাপি ঋণের পরিমাণ, শেয়ার বাজারের সূচক, লেনদেনের ভারসাম্য, আদায়কৃত কর-জিডিপির অনুপাত, মূল্যস্ফীতির পরিমাণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক মুদ্রা সরবরাহের পরিমাণ, দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের মজুরীর পরিমাণ, আয় ও সম্পদের বৈষম্য, কু-ঋণের পরিমাণ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ইত্যাদিকে। অর্থনীতিকে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য উপরোক্ত বিষয়গুলোকে অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। এ বিষয়গুলো যদি মজবুত না হয় তবে তা হবে অর্থনীতির জন্য মহাবিপদ সংকেত।

বিশ^বাণিজ্যে বাংলাদেশের দখলদারিত্ব খুবই কম। অর্থাৎ বাংলাদেশ বিশ^বাণিজ্যের এক ক্ষুদ্র শক্তি হিসেবে বিবেচিত।
অর্থনীতির ভাষায় তাকে ‘ঝগঅখখ ঈঙটঘঞজণ ঈঅঝঊ’- বলা হয়। এর অর্থ হলো যে, বাংলাদেশ এখনো বিশ^ অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বাংলাদেশের দর-কষাকষির (ইঅজএঅওঘওঘএ) ক্ষমতা একেবারেই সীমিত। পৃথিবীর বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর দরকষাকষির ভেতর দিয়ে বিশ^ অর্থনীতিতে পণ্যের দাম যেটি নির্ধারিত হয় আমাদের মত ছোট অর্থনীতির দেশকে সেই দামই গ্রহণ করে বাণিজ্য করতে হয়। এ কারণে বিশ^ অর্থনীতিতে বয়ে যাওয়া ঝড়-ঝাপ্টা আমাদের গায়ে তেমন লাগে না। তবে দেরিতে হলেও এর মৃদু বাতাস আমাদের গায়ে লাগে। অনেক সময় তাও আমরা সহ্য করতে পারি না। আজকের পিঁয়াজের দাম বৃদ্ধি আমরা কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না। অথচ নিত্যনৈমিত্তিক কারণে পিঁয়াজ প্রয়োজন হয় সামান্যটুকু, যা আমাদের মাসিক আয়ের এক শতাংশের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ মাত্র। অথচ রাজনীতির সুবাদে বিখ্যাত ব্যক্তিরাও দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে চল্লিশ টাকা দামের এক কেজি পিঁয়াজ সংগ্রহ করছে যা খবরের কাগজের রসালো সংবাদে পরিণত হয়েছে। যে ব্যক্তি দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ালো তাঁর দুই শ্রমঘণ্টার মূল্যমান যদি ২০০+২০০= ৪০০ টাকা হয় তবে অর্থনীতিতে ‘ডেড ওয়েট লস’ (উঊঅউ ডঊওএঐঞ খঙঝঝ) হচ্ছে ৪০০-৪০= ৩৬০ টাকা। সুতরাং এ ধরণের সস্তা জনপ্রিয়তার রাজনীতি অর্থনীতিবিদদের নিকট মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

বিশে^র উন্নত দেশগুলোতে মন্দার কালো ছায়া পড়তে শুরু করেছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ। একদেশ অন্য দেশের পণ্যের ওপর প্রতিযোগিতামূলক শুল্ক আরোপ করছে। যার ফলে বিশ^-বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছে। এতে উভয় দেশের উৎপাদন ও কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছে। এতে বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে উভয় দেশের এবং অন্যান্য দেশের উৎপাদন হ্রাস পেলে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি যেমন হ্রাস পাবে তেমনি রপ্তানিকৃত জনশক্তি দেশে ফিরে আসলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে।
দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকিং খাত রয়েছে মহাবিপদে। বিতরণকৃত ঋণের একটি বিরাট অংশ খেলাপি এবং কুঋণ হয়ে গেছে। এ অর্থ ফেরৎ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ফলে ব্যাংকগুলো প্রভিশন ঘাটতি, মূলধন ঘাটতিসহ নানা সমস্যায় ভুগছে। বাজেট থেকে ভর্তুকি বা অনুদান সুবিধা না পেলে অনেক ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতো। জনগণের টাকায় রুগ্ন ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। কারণ ব্যাংক ধসে পড়লে জনসাধারণের আস্থার জগতে যে চিড় ধরবে, তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে বিপদগ্রস্ত করে তুলবে।

বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত বেড়ে চলছিল। এ ধারা অনুসারে রিজার্ভের পরিমাণ ৪০ বিলিয়নের কাছাকাছি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এটি ৩২ বিলিয়নের আশেপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। এটা একটি অশনিসংকেত। অর্থনীতির আরো কয়েকটি চ্যালেঞ্জ আলো-ছায়ায় অবস্থান করছে। এগুলো হচ্ছে চামড়াজাত পণ্যের হ্রাসকৃত চাহিদা, বস্ত্রশিল্পের উৎপাদন হ্রাস ও বাজারজাতকরণের সমস্যা, রড ও ইস্পাতের হঠাৎ চাহিদা পতন ইত্যাদি। এগুলো অর্থনীতির জন্য মহাবিপদ সংকেত।
এ মহাবিপদ সংকেত মোকাবেলা করার জন্য যদি প্রস্তুতি নেয়া না হয় তবে ছোট অর্থনীতির বাংলাদেশও একদিন মহামন্দার কবলে পড়বে। তখনই জনগণ বুঝতে পারবে মহামন্দা কিভাবে অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট