চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

জাতীয় পরিচয়পত্র দানের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আর কালক্ষেপণ নয়

৫ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:১০ পূর্বাহ্ণ

মিয়ানমার কর্তৃক নাগরিক মর্যাদায় রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। মিয়ানমার সত্যিই এ ব্যাপারে আন্তরিক হলে তা হবে এ অঞ্চলের জনগণের জন্যে সবচেয়ে আশা জাগানিয়া সুখবর। এতে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের পথ মসৃণ হবে। আর শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সংকটের সম্মানজক সমাধান হলে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। তবে সব কিছুই নির্ভর করছে মিয়ানমারের সদিচ্ছার উপর।

মিয়ানমার এতোদিন নানা ছলের আশ্রয় নিয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে। এখনো তারা নানা কৌশলে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন নীতিই অনুসরণ করে যাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশের জোর কূটনীতির ফলে মিয়ানমারের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা, বিভিন্ন দেশের চাপ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা এবং সর্বশেষ জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে কোণঠাসা হওয়ার পর দেশটি সংকট নিরসনের লক্ষে রোহিঙ্গাদের নাগরিক বিবেচনায় জাতীয় পরিচয়পত্র দেবে বলেছে, তবে তা অনেকেই বিশ^াস করতে পারছে না অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে। এখন রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমার সত্যিই আন্তরিক কিনা তার প্রমাণ দিতে হবে প্রতিশ্রুতির আন্তরিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা সঙ্কট যে মিয়ানমারের তৈরি এবং এর সমাধান তাদেরই করতে হবে, সেই বিষয়টিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রায় সব দেশ মত দিয়েছে।

এরপর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে গত ২৪ সেপ্টেম্বর চীনের মধ্যস্থতায় বৈঠকে বসেন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরানোর আনুষ্ঠানিক সংলাপে চীনকে সঙ্গে নিয়ে একটি ‘ত্রিপক্ষীয় যৌথ কার্যনির্বাহী’ ফোরাম গঠনে মিয়ানমারের সম্মতি আসে। সে বৈঠকেই নাগরিক হিসেবে শনাক্তের পর রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র দিতে মিয়ানমার সম্মত আছে বলে জানানো হয়েছে। নাগরিকত্ব শনাক্তকরণে রোহিঙ্গাদের যে আবেদনপত্র পূরণ করতে দেয়া হয়েছিল, তাতে ভুল থাকার কথা মিয়ানমার স্বীকার করেছে। শনাক্ত হওয়া নাগরিকদের যতদ্রুত সম্ভব ফিরিয়ে নেয়া হবে বলেও জানিয়েছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের নতুন ফরম দিতে এবং নাগরিকত্ব শনাক্ত হওয়ার পর সবাইকে জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে রাজি হয়েছে তারা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন নিউইয়র্কে সদ্য শেষ হওয়া জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি ‘বড় অর্জন’ হিসেবে দেখছেন। আমরাও মনে করি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে তাদের নাগরিক পরিচয়পত্র দানের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে বড় অগ্রগতি। তবে অতীতে কথা দিয়ে কথা না রাখার কারণে মিয়ানমারের ওপর আস্থা রাখা কঠিন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কূটনৈতিক তৎপরতা ও চাপ পূর্বাপেক্ষা বাড়িয়ে দিতে হবে।

বর্তমানে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে সাড়ে সাত লাখই এসেছে ২০১৭ খ্যিস্টাব্দের আগস্টে রাখাইনে নতুন করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন শুরু হওয়ার পর। জাতিসংঘ ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান হিসেবে বর্ণনা করে আসছে। মিয়ানমার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ায় দুই দফা চেষ্টা করেও রোহিঙ্গাদের কাউকে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এবার জাতিসংঘ অধিবেশনসহ বিভিন্ন ফোরামে রোহিঙ্গা সঙ্কটের চিত্র বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনের দেয়া বক্তব্যে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের অনিশ্চয়তা যে আঞ্চলিক সঙ্কটের মাত্রা পেতে যাচ্ছে, তা বিশ্বকে উপলব্ধি করার আহ্বান জানান। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে জাতিসংঘে চারটি প্রস্তাবও দেন তিনি। এর আগে গত বুধবার মার্কিন থিংক ট্যাংক ‘কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশনস’ আয়োজিত এক সংলাপে শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার, এ সমস্যার সমাধানও সেখানেই রয়েছে। মিয়ানমারের কারণে সৃষ্ট রোহিঙ্গা সঙ্কট বাংলাদেশের উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে বলেও সেখানে মন্তব্য করেন তিনি। এরপর মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকলে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় দেশটি। আমরা এই প্রতিশ্রুতির দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চাই।

এ জন্যে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। তাদের উচিত রোহিঙ্গাদের সমনাগরিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলোর দ্রুত সুনিষ্পত্তি করে কোনো ধরনের কালক্ষেপণ ছাড়াই সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখা। আমাদের বিশ^াস, পুরোবিশ্ব মানবিকবোধে উজ্জীবিত হয়ে নির্যাতিত ও বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের টেকসই পুনর্বাসনে সোচ্চারকণ্ঠ হলে সংকটের সম্মানজনক সমাধানে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট