চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

হাটহাজারীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউছুপ

সেনানিবাসে হামলার কারণে বাঙালি পরিবারগুলো বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম হ হাটহাজারী

৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৩৩ পূর্বাহ্ণ

নভেম্বরের শেষের দিকে রাউজান এবং ফটিকছড়ির কিছু অংশ স্বাধীন ঘোষণা করেন ফটিকছড়ির মির্জা মনসুর। হাটহাজারীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মাস্টার মো. ইউছুপ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে এ তথ্য জানান। হাটহাজারী উপজেলার গুমানমর্দন ইউনিয়নের নুর আহাম্মদ মাস্টারের বাড়ির বাসিন্দা মাস্টার ইউছুপ আজীবন মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। সর্বশেষ ফতেপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নেন ২০১৩ সালে। দুই ছেলে ও ১ কন্যার জনক তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হাটহাজারী উপজেলার গুমানমর্দন ইউনিয়ন ও উপজেলায় সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে গঠিত সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ও গুমানমর্দন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা ইউছুপ ছিলেন ২০ বছরের টগবগে তরুণ। তিনি তখন চট্টগ্রাম কলেজের ডিগ্রির শিক্ষার্থী ছিলেন।

তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরুর দিকে হাটহাজারীর সাবেক গণপরিষদ সদস্য এম এ ওহাব এবং হাটহাজারী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ডা. আবুল হাশেম এর নির্দেশে জিপে করে আমি, হাফেজ কামাল, শহীদ আলিম উল্লাহ, মাস্টার দেলোয়ার পাশাসহ আমরা মোট ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা রামগড়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে যাই। সেখানে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের আমাদের গ্রেনেড, রাইফেল চালানোসহ যুদ্ধের বিভিন্ন আত্মরক্ষামূলক কৌশল প্রশিক্ষণ দেন। আমরা প্রায় ৫দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে আসি। যুদ্ধের প্রথমাবস্থায় ২ ও ৩ এপ্রিল এমপি এম এ ওহাবের নেতৃত্বে ইপিআর সুবেদার আব্দুল আজিজ এবং সুবেদার আব্দুল গণির নেতৃত্বে আমরা চট্টগ্রাম সেনানিবাসে গুলি বর্ষণ করি। হাফেজ কামালের হাতে ছিল একটি চাইনিজ রাইফেল। রাতে বিরতি দিয়ে ৪ এপ্রিল ভোরে আমরা পুনরায় গোলা বর্ষণ শুরু করি সেনানিবাসের নির্দিষ্ট এলাকায়। এ সময় প্রতিপক্ষের পাল্টা গুলিতে সাধুর পাহাড় এলাকায় যুদ্ধে আমাদের সহযোদ্ধা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক সৈনিক শহীদ হন। এ শহীদের লাশ আমরা আনতে পারিনি। সেদিন সেনানিবাসে আমাদের হামলার কারণে সেখানে (সেনানিবাসে) আটকে পড়া বাঙালি পরিবারগুলো বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে হাটহাজারীর দিকে আসতে থাকে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেনানিবাস থেকে হাটহাজারীর দিকে অগ্রসর হওয়ার সংবাদ পেয়ে ১১ এপ্রিল আমরা এম পি ওহাব এবং ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বে অক্সিজেন হাটহাজারী সড়কের নন্দীরহাট দিঘিরপাড়ে অবস্থান করি। ক্যাপ্টেন এজাজ ও ক্যাপ্টেন মোছলেহ উদ্দিন অস্ত্র দিয়ে আমাদের সাহায্য সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ দেন। এসময় ছাত্র জনতা, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক মিলে প্রায় ১৮০ জন যোদ্ধা ছিলাম। নন্দীর হাটের দিঘির পূর্বপাড়ে একটি বিল্ডিংয়ে দুপুর ১২টায় আমরা দুপুরের খাবার খেতে বসি। তখন চৌধুরীহাটের দক্ষিণ এলাকা থেকে ট্যাংক এবং আর্টিলারি কামান থেকে গুলিছুড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আমরা তখন পাল্টা গুলি ছুড়ি রাইফেল, আর আর কামান, এল এম জি, এস এম জি (স্মল মেশিনগান) দিয়ে। দুপুর হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা যুদ্ধ চলে। একসময় পাঞ্জাবিরা পিছু হটে সেনানিবাসে চলে যায়। এ সম্মুখ যুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক শহীদ হন। পরে আমরা চবি ক্যাম্পাসে অস্থায়ী ক্যাম্পে গিয়ে রাতের খাবার খাই।

নভেম্বরের শেষের দিকে রাউজান এবং ফটিকছড়ির কিছু অংশ স্বাধীন ঘোষণা করে ফটিকছড়ির মির্জা মনসুর এমপি এবং বিএলএফ’র ল্যাফটেন্যান্ট শওকত আলীর নেতৃত্বে ফটিকছড়ির কালু মুন্সির হাটে (নানুপুর বাজার) স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। এতে মির্জা মনসুর এমপি ও ল্যাফটেন্যান্ট শওকত আলী সামরিক অভিবাদন গ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন সুবেদার ছাবেদ আলী। এ অনুষ্ঠানে কোরআন তেলওয়াত করেন হাটহাজারীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাফেজ মো. কামাল। এসময় আমরা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা ছাড়াও সামরিক বাহিনী, পুলিশ, ইপিআরসহ এলাকার বিভিন্ন স্তরের শত শত মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট