চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০২৫

সর্বশেষ:

সমুদ্রের শহরে পাহাড়-নদীর কান্না

মিজানুর রহমান

১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১১:২৮ পূর্বাহ্ণ

ঢেউয়ের গর্জন, বালিময় সৈকত, কাঁকড়ার ছোটাছুটি, পাখির কিচিরমিচির, ঝর্ণার ঝিরি ঝিরি শব্দ, হাজারো প্রজাতির গাছের সমারোহ, বন-পাহাড়ের মায়াবী ডাক- কী নেই কক্সবাজারে! প্রকৃতি যেন এখানে উদার ও মায়াময়। স্রষ্টা যেন এখানে তার অপার মহিমায় সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছেন দুই হাত ভরে।

 

তবে প্রকৃতির নৈসর্গিক এই রূপে ‘শকুনের থাবায়’ কক্সবাজার হারাতে বসেছে তার আপন সত্তা। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রের এই শহরে এখন কান পাতলেই শোনা যায় পাহাড়-নদীর কান্না। স্কেভেটর-কোদালের কোপে এখানকার পাহাড়গুলো নেই হওয়ার পথে। দখল-দূষণে মৃতপ্রায় নদীগুলোও।

 

সাবাড় হচ্ছে চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালীর পাহাড়: চকরিয়ার বিস্তৃত বনভূমির সিংহভাগই এখন বৃক্ষশূন্য। বন বিভাগের শতাধিক পাহাড় কেটে বালি-মাটি বিক্রি করায় সাবাড় হয়েছে এসব পাহাড়। ১২টি বনবিটের আওতায় এমন কোন পাহাড় নেই যেখানে ভূমি ও বনদস্যুদের থাবা পড়েনি। ১০ হাজারের বেশি কাঁচা-পাকা স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে সেখানে। এর মধ্যে দোকানপাট এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

 

অভিযোগ রয়েছে, বন বিভাগ জবাবদিহিতা থেকে রক্ষা পেতে পাহাড় ও গাছ কাটা নিয়ে হাতেগোনা কয়েকটি মামলা করলেও সেই মামলায় প্রভাবশালীদের আসামি করা হয় না। ফলে মূল বনখেকোরা অধরাই থেকে যায়। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লোকবল সংকট, প্রভাবশালীদের চাপ, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, সশস্ত্র বনদস্যুসহ নানা কারণে বনরক্ষায় বন বিভাগ অসহায়।

 

চকরিয়ার ঐতিহ্যবাহী ‘সুন্দরবনের’ অনুপম সৌন্দর্যও এখন আর নেই। বিশাল সুন্দরবন এলাকায় যেদিকে নজর যায়, সেদিকেই মৎস্য ঘের আর লবণমাঠ। ২০০০ সালেও সুন্দরবনের মাঝামাঝি স্থানে ১১টি সুন্দরীসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ছিল। কিন্তু এখন কেবল বাইন, কেওড়া ও কিছু গোলপাতা গাছ দেখা যায়। মৎস্য ঘেরের নামে দখলদারদের দখল উৎসব চলছে সেখানে।

 

সুন্দরবন রেঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত রেঞ্জ কর্মকর্তা মেহেরাজ উদ্দীন জানান, বর্তমানে সুন্দরবনের ৮ হাজার ২৩ দশমিক ৩১ একর ভূমি জবরদখলে রয়েছে। বনের জমি জবরদখলে রাখায় বিভিন্ন এলাকার ৭৬৫ জনের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ মামলা দায়ের করা হয়েছে। উচ্ছেদ অভিযান কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও আবেদন জেলা প্রশাসকের দপ্তরে জমা দিয়েছি।

 

দখলে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার বনভূমি প্যারাবনের সৃজিত বাইন গাছ। দ্বীপের উপকূলজুড়ে আগের সেই ঘন প্যারাবন এখন আর চোখে পড়ে না। এ কারণে জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে অনন্য এই দ্বীপটির বন্যপ্রাণীর জন্য পরিবেশগত হুমকি তৈরি হয়েছে। লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে পরিযায়ী পাখির আনাগোনা।

 

পাহাড় দখলে পিছিয়ে নেই পেকুয়াও। পেকুয়া পাহাড়ের চূড়ায় প্রায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। দিন দিন এ সংখ্যা আরও বাড়ছে। ফলে পাহাড় ধ্বংসের পাশাপাশি বর্ষায় ভূমিধসসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপুল প্রাণহানির শঙ্কা রয়েছে। এসব পাহাড় এখন বেশিরভাগ ভূমিদস্যুদের দখলে চলে গেছে।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মঈনুল হোসেন চৌধুরী জানান, পাহাড়ের চূড়ায় ঝুঁকিতে বসবাসকারী পরিবার এবং বনের জায়গায় অবৈধ দখল, মাটি কাটা, বসতি স্থাপনের ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। পাহাড় কর্তন করা ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

 

মৃত প্রায় বাঁকখালী, পিলটকাটা, ভোলা নদী: কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গুরুত্বপূর্ণ নদী বাঁকখালী। কিন্তু আগ্রাসী দখল ও নদী সংলগ্ন ম্যানগ্রোভ বন কাটায় নদীর প্রবাহ এবং জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে নদীর তীরে হাজার হাজার অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ৬ নম্বর ঘাট থেকে উত্তর নুনিয়াছড়া পর্যন্ত প্রায় ২৮টি অবৈধ জেটি রয়েছে বর্তমানে। সবকটিই অনুমোদনহীন।

 

নদী থেকে বালি তুলে রাখার পাশাপাশি সিলেট থেকে পাথর ও বালি এনে বিক্রির জন্য ৫টি সেল সেন্টার করা হয়েছে অবৈধভাবে বাঁকখালী নদীর তীরে। কয়েকটি তেলের বার্জও রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে বরফকল, কোল্ড স্টোরেজ, ফিশিং অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ডকইয়ার্ড, মাছের আড়ত, শুঁটকির আড়তসহ শত শত বসতঘর। ৬ নম্বর ঘাটের পাশে করা হয়েছে ট্রাকস্ট্যান্ড।

 

দ্বীপকন্যা কুতুবদিয়ার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পিলটকাটা খাল। তবে অবৈধ দখল-দূষণ ও পলি জমে খালটি এখন চরম অস্তিত্ব সংকটে। কৈয়ারবিলের ক্রসডেম স্লুইসগেট থেকে ধুরুং বাজারের পূর্বপাশ পর্যন্ত বেশিরভাগ অংশে খালটি ভরাট হয়ে গেছে। দ্রুত খালটি পুনঃখননের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-সহকারী প্রকৌশলী এলটন চাকমা জানান, তিন বছর আগে পিলটকাটা খাল পুনঃখননের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কোন এক অদৃশ্য কারণে তা গৃহীত হয়নি। তবে আমরা হাল ছাড়িনি। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে দ্রুত তাগাদা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

 

মাতামুহুরী এবং পেকুয়ার পাহাড়ি ছোট ছোট নদী থেকে ভোলা খালের উৎপত্তি। খরস্রোতা ভোলা খাল একসময় এ অঞ্চলের প্রাণ ছিল। সম্প্রতি এ খাল দখলে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতেছে ভূমিদস্যুরা। খালের বিভিন্ন অংশে বাঁধ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে মৎস্য ঘের, বসতভিটা, দোকানপাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট