দৈনিক পূর্বকোণের আয়োজনে ও আলহাজ্ব শামসুল হক ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার সংস্কার: সময়ের দাবি’ শিরোনামে এক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আলহাজ্ব শামসুল হক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের বেসরকারি কারা পরিদর্শক প্রকৌশলী মুহাম্মদ নাছির উদ্দিনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই আলোচনার উপর ভিত্তি করে সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) দৈনিক পূর্বকোণে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়।
গত শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) পূর্বকোণ সেন্টারে এই আলোচনা সম্পন্ন হয়। এতে বিজ্ঞজনদের আলোচনার মধ্য দিয়ে সংস্কারের বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। নিচে উপস্থিত আলোচকদের মতামত তুলে ধরা হল।
মো. হুমায়ুন কবীর
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপস.)
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ
সংস্কার এখন সময়ের দাবি। সেবা নেওয়ার জন্য প্রার্থীকেও উপযুক্ত হতে হয়। আমাদের বিচার ব্যবস্থাটা গড়ে তোলা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের সুবিধার জন্য। তাদের রাজস্ব আদায়ের জন্য আইনে ওসি-ডিসিকে সকল ক্ষমতা দেওয়া আছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর চলে গেলেও এসব জায়গায় কোনো সংস্কার হয়নি। বিচার ব্যবস্থার প্রাথমিক কাজটুকু পুলিশ করে। আসামিদের মধ্যে দেখা যায় অপরাধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণ রয়েছে। এরমধ্যে সম্পত্তি সংক্রান্ত, নারী নির্যাতন সংক্রান্ত, সামাজিক বা রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা সংক্রান্ত, জনউপদ্রব সংক্রান্ত, শিশু-কিশোর আর নারী। থানা কাস্টডিতে তাদের একসঙ্গে রাখতে হয়। কারাগারে নারীদের পৃথক রাখার ব্যবস্থা আছে। এর বাইরে সব অপরাধের আসামি এক স্থানে রাখা হয়। এতে কারাগারে যাওয়ার পর সে আরও দুর্ধর্ষ হয়ে ফিরে আসে। কারাগারকে কারাগার না বলে সংশোধনাগার বলা উচিত। ১৮৬১ সালে ব্রিটিশদের তৈরি আইন দিয়ে স্বাধীন দেশের নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণ কোনোভাবেই সম্ভব না।
সৈয়দ মাহবুবুল হক
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট
জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম
কারাগার নিয়ে বিভিন্নজন থেকে আমি শুনেছি ও বিভিন্ন ভিডিও দেখেছি। কারাগারের ভিতরে মাত্রাতিরিক্ত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে বলে শুনেছি। আমার প্রশাসনিক জায়গার বাইরে থেকে সাধারণ জনগণের কাছে শুনার চেষ্টা করি। এক লোক কারাবন্দী হয়ে আসছে আরেক জায়গায় তার সাথে দেখা হয়েছে। সার্ভিসে জয়েন করার আগে তার এমন বিশ্রি অভিজ্ঞতা আমার সাথে শেয়ার করেছে। এটা বলার বাইরে। কারাগার আসলেই অন্ধকার একটা জায়গা। গোলটেবিল, আলোচনা, পরিদর্শন এগুলো যদি চলমান রাখি তাহলে বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ আমাদের পক্ষে সম্ভব। আল্লাহ প্রদত্ত নির্দেশনা যদি আমরা মেনে না চলি তাহলে সেটি যৌক্তিক হবে বলে আমি মনে করি না। ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে আমরা ব্রিটিশ কলোনিয়াল পিরিয়ডের মতাদর্শ, আদর্শ, ধ্যান, চিন্তা চেতনা দিয়েই ঘুরপাক খাচ্ছি। এটা শুধু আমাদের দেশ নয় পুরো দক্ষিণ এশিয়া এটার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন যে সুযোগ তৈরি হয়েছে সেটিকে কাজে লাগানো দরকার। আমাদের বিশ্বাসের বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারি। কারাগারের জন্য স্পেশাল আইন করা, পেনেল কোড, জেল কোডে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। ভূমি অপরাধ ও প্রতিকার আইন নিয়ে বিধি নিয়ে সরকার নিজের জায়গা থেকে চেষ্টা করতেছে মানুষকে হয়রানি ও কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়ার। যখন নির্দিষ্ট আইন থাকবে তখন অন্য পথ দিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই। আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে কারাগারকে পুরোপুরি নতুন করে সাজানোর। এজন্য সবার সহযোগিতা চাই। কারাগারে শেখার সুযোগ কম। আমার চেষ্টা থাকবে সেই সুযোগ তৈরি করে দেয়ার। সেখানে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যারা ভালো কাজ করতে আগ্রহী তারা নিছক এটাকে দায়িত্ব মনে করে এগিয়ে আসছে। যারা ভলেন্টিয়ারি কাজ করতে চায় তাদেরকে আমরা সুযোগ দিতে পারলে এই জায়গা থেকেও উত্তরণ সম্ভব। বাইরের দেশে কারাগারকে পরিশোধন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। দেশের বাইরে যারা কারাগারে যায় তারা অবারিত সবুজ, শান্ত নদী দেখতে পায়। এর মাধ্যমে তাদের বোধোদয় হয়। অপরাধ থেকে সে বের হয়ে আসার একটা অবস্থা তৈরি হয়। আর আমাদের দেশে বিনাঅপরাধে ঢুকে অপরাধী হয়ে বের হয়।
সাইফুল আলম
চিফ রিপোর্টার, দৈনিক পূর্বকোণ
অতি সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল আলোচনায় কারা সংস্কার নিয়ে বেশকিছু সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে বন্দীদের সাথে আইনজীবীদের শারীরিক ও ভার্চুয়ালি পরামর্শ এবং ভার্চুয়ালি শুনানিতে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের প্রদত্ত সুযোগ সুবিধাগুলো মানবাধিকারের মানদণ্ড পূরণ করে না। তাদের অন্য বন্দীদের থেকে আলাদা রাখা উচিত। মৃত্যুদণ্ড সংক্রান্ত ডেথ রেফারেন্স ও ফৌজদারি আপিল সমূহের দ্রুত ও কার্যকর শুনানির ব্যবস্থা নেয়া। তাদেরকে লাইব্রেরি পরিচালনা, ধর্মীয় কাজ, বাগান করা ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত করা। তাদের প্রত্যেকদিন অন্তত ৮ ঘণ্টা সেলের বাইরে খোলা জায়গায় রাখা, শারীরিক ব্যয়াম ও খেলাধুলার সুযোগ ও মানসম্পন্ন খাবার সরবরাহ করা। কয়েদির মাসে দু’বার স্বজনদের সাথে দেখা করার অনুমতি এবং স্বামী স্ত্রীর সাথে ব্যক্তিগত সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া। স্যানিটারি সুবিধা কক্ষের বাইরে রাখা, প্রতিটি বন্দীর জন্য আলাদা তালা ও চাবি থাকা। এরকম আরও অনেকগুলো সুপারিশ ছিল। মোট কথা, কারাগার হচ্ছে সংশোধনের একটা স্থান। কিন্তু আমাদের এখানে দেখা যায় কারাগার থেকে বেরিয়ে মানুষ আরও বেশি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেন। কারাগারে থেকে সুপথে থাকার মেন্টালিটিটা তারা হারিয়ে ফেলেন। আমি মনে করি দেশের প্রতিটি কারাগার প্রকৃতপক্ষে সংশোধনের জায়গায় হওয়া উচিত।
আলহাজ এমএ আজিজ
যুগ্ম আহ্বায়ক, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি
২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে বলছি- জেল হচ্ছে পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করে তাদেরকে রাখার জায়গা। পুলিশের কিছু ত্রুটির কারণে জেলে অনেক সমস্যা হয়েছে। যেমন- বেওয়ারিশ অনেককে বন্দী হতে হয়েছে। পুলিশের প্রত্যেকটি থানায় একটি অঘোষিত ক্যাশিয়ার থাকে। যিনি চাঁদা সংগ্রহ করে থাকেন বিভিন্ন সোর্স থেকে। যখন ক্যাশিয়ার বলে মেস চলবে না, টাকা নেই। তখন ওসি নির্দেশ দেন ঝাড়ু মারো। এই ঝাড়ু মারতে গিয়ে রাত ১২টার পর পিকআপগুলো যাকে পায় তাকে ধরে নিয়ে আসে। সকালে অনেককে টাকার বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হয় আর যে দিতে পারে না তাকে পুরনো মামলায় চালান দিয়ে দেয়। তার পরিবার জানে না সে জেল খাটতেছে, যার কোনো ওকালতনামাও নাই। এরকম আমি তিনজনকে জামিন করিয়েছি প্রায় দুই আড়াইমাস জেল খাটার পর। জেলে ওয়ার্ড বেচাকেনা চলে। কয়েদি যাওয়ার সাথে সাথে পুরনো কয়েদিরা অর্থ্যাৎ মেটরা ওয়ার্ডগুলো ভাড়ায় নিয়ে নেয়। তখন তারা নতুন কয়েদিদের কিনে নেয়। একজন থেকে প্রতিমাসে তিন হাজার টাকা দিতে হয়। তাও থাকতে দেয়া হয় কষ্ট করে। যারা টাকা দিতে পারে না তাদের উপর নির্যাতন চলে। তাদেরকে পানি টানা, বাথরুম পরিষ্কারসহ বিভিন্ন কাজে লাগানো হয়। এই মেটের টাকা সব জায়গায় বণ্টন হয়। টাকা দিয়েও সেখানে ভালোমানের খাবার পাওয়া যায় না। খাবার তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় অস্বাস্থ্যকর তেল। এটার কারণে বিভিন্ন জনের হার্টের রোগ দেখা দেয়। এছাড়াও চিরস্থায়ীভাবে এলার্জির সমস্যা দেখা দেয়। ৫৩ বছরে এই প্রথম সারাজাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে ছাত্রজনতার মহাবিপ্লবের মাধ্যমে। এই পরিবর্তন আমাদের ধরে রাখতে হবে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, শুধু জেলখানায় নয় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে।
মুফতি হারুন ইজহার
যুগ্ম মহাসচিব, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ
আমি দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলাম। আইন সংস্কার করে সবকিছু হয় না। কারণ দেশে স্পেশাল অ্যাক্ট, স্পেশাল ফোর্স, স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল তৈরি করা হয়েছে। দেখা গেলো ব্রিটিশ উপনিবেশের বাইরে যে সংস্কারগুলো আগে হয়েছে, সেগুলো আরও বেশি নিপীড়নমূলক। সন্ত্রাস দমন আইনে ব্যাপক মানবধিকার লঙ্ঘন করে যাকে ইচ্ছে তাকে ধরে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কারা ব্যবস্থাটা বিচারিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। এসব সংস্কারে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা প্রয়োজন। কারাগারে দক্ষ যোগ্য ও নীতিবান শরীয়াহ কনসালটেন্ট নিয়োগ করা প্রয়োজন। সেটা জেলার বা অতিরিক্ত জেলার পদমর্যাদার হতে পারে। এখন যেটা হয় যে কারাগারে হুজুর আছে, কিন্তু বিদ্যমান কাঠামোতে সেটা কার্যকর হবে না। কারাগারে যে জুলুমটা হচ্ছে, এটার দায়ভার বিচারকদেরও। অন্যায়ভাবে অনেককে আটকে রাখা হচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিচারকদের মধ্যে একটা জুজুর ভয় দেখেছি। মানবতার ঘাটতি দেখেছি। তাই কারা সংস্কারের পাশাপাশি বিচারিক ব্যবস্থারও সংস্কার প্রয়োজন। যখন কেউ অপরাধ করবে ইসলাম বলে প্রমাণ সাপেক্ষে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দিতে হবে। ক্রিমিনাল আইনে ইসলামি শাস্তির বিধান মানতে চায় না অনেকে। কিন্তু কারাগারে হাজার হাজার আসামি আছে দরিদ্রতার কারণে অপরাধে জড়িয়েছে। তাদের বছরের পর বছর বন্দী রাখা হচ্ছে। এটা কি অপরাধের তুলনায় বড় শাস্তি না? ছোট অপরাধীরা কঠিন শাস্তি পেলেও বড় অপরাধীরা পার পেয়ে যান। তাদের কারাগারে যেতে হলেও ভিআইপি সুযোগ সুবিধা পায়। আর যারা গরিব, তাদের কপালেই জুটে সব লাঞ্ছনা। আরা কারাগারে যে সিন্ডিকেট আছে, আমার জানামতে সেখানে পুলিশের প্রাক্তন প্রধান থেকে শুরু করে উর্ধ্বতন অনেকে এবং কারা কর্তৃপক্ষের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত।
মো. ফরিদুল আলম
উপ-পরিচালক, জেলা সমাজসেবা কার্যালয় চট্টগ্রাম
আমরা অনেক ধরনের কাজ করে থাকি। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যারা সমাজের অনেক ধরনের সুবিধাবঞ্চিত শিশু মহিলা, জেলখানা, আইনের সংস্পর্শে জড়িত শিশুসহ সকলকে নিয়ে কাজ করার সুযোগ আমাদের রয়েছে। ব্যক্তি, দণ্ডবিধি, অবকাঠামো সংস্কার দরকার। প্রভেশন বলতে আমরা সাধারণ বুঝি, রায়টাকে স্থগিত রেখে কোনো কর্মকর্তার জিম্মায় দিয়ে সমাজে যাতে সাধারণ মানুষের সাথে চলাফেরা করতে পারে তাকে সংশোধনে জন্য একটা সময় দেয়া। সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার মাধ্যমে কারাগারে থাকা লোকদের সংশোধন করা আমাদের মূল উদ্দেশ্য। কারাগারে আমরা আলাদা আলাদাভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। কারাগার থেকে বের হয়ে যাতে সমাজে সুন্দরভাবে চলতে পারে সেটার জন্য আমরা সরকারের নিজস্ব খরচে ব্যবসা বাণিজ্য করার সুযোগ দিয়ে থাকি। চট্টগ্রাম কারাগারে রিকশা, ভ্যানগাড়ি, বিউটিশিয়ান, বাটিকান ইত্যাদি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলখানায় ছোট ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার জন্য আমরা ধর্মীয় শিক্ষকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে যারা তাদেরকে বয়স্কদের সাথে চার্জশিট দেয়া যাবে না। আলাদা শিশু আইনে তাদের চার্জশিট দিতে হবে। শিশু আদালতে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। জেলখানায় যেসব শিশু আছে তাদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সম্প্রতি কয়েকমাস আগে ৪ বছরের একটা শিশুকে আদালতের নির্দেশে ছোটমনি নিবাসে রাখার উদ্যোগ নিয়েছি সেই মুহূর্তে তার বাবা তাকে ভুল বুঝিয়ে ওই বাবার সাথে রাখে। ওই বাবা তাকে বুঝায় তুমি যদি আমার সাথে থাক তাহলে আমার জামিন পেতে সুবিধা হবে। শেষ পর্যন্ত শিশুটিকে আমরা স্থানান্তর করতে পারিনি। বর্তমানে হিজড়াদের আলাদাভাবে রাখা হয়। যদি আমরা আচরণ অবজারবেশনের আলোকে তাদের জন্য সুপারিশ করে সামাজিকভাবে সুন্দর একটি জীবনে ফিরে যেতে পারে তাদেরকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া যেতে পারে। তাহলে কারাগারের চাপটা কমে যাবে। আমাদের কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। অনেকসময় অনেক নিরীহ লোককে প্রধান আসামি করা হয়ে থাকে। আমার পরিচিত এক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে খুনের মামলার আসামি করা হয়। পরে সে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি।
মো. জাকের হোসেন
অবসরপ্রাপ্ত জেল সুপার
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার
কারাগার সমাজেরই অংশ। ১৮৬৪ সালের জেল কোড অনুযায়ী কারাগার পরিচালিত হচ্ছে, এরপর থেকে এখন পর্যন্ত কারাবিধির কোনো পরিবর্তন হয়নি। ১৮৯৪ সালে কারা আইন আর ১৯০০ সালে বন্দী আইন হয়েছে। ১৯৯৭ সালে কিছুটা কারা সংস্কার হয়েছে, পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে ও স্বাধীনতার পর ১৯৮০ সালে আদালতের কিছু সুপারিশ ছিল কারাগার নিয়ে। সেসব সুপারিশের একটি বড় অংশ এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলেও কারাগারে ফ্যান আর টেলিভিশন দেওয়া হয় ২০০৩ সালে। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের মানসিক দৈন্যতা আছে, কারাগার সংস্কারের জন্য ক্রিমিনাল জাস্টিসের পরিবর্তন দরকার। আবার এলাকাভেদে কারাগারের সমস্যাও ভিন্ন। এটা তদারকির ওপর নির্ভর করে। ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম কারাগার স্থানান্তরের একটি উদ্যোগ ছিল, ভূমিও অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত আর হয়নি। আবার কারাগারে বন্দীর সংখ্যা বেশি। তাই প্রতি দেড় হাজার বন্দীর জন্য অন্তত একজন জেলার রাখা দরকার। যাদেরকে বেসরকারি কারা পরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ করা হয়, তাদের মধ্যে দুয়েকজন যদি বিশেষজ্ঞ থাকে তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। জেলা ও মহানগরের জন্য আদালত পৃথক করা হয়েছে। কিন্তু মহানগরের মুখ্য হাকিমকে জেল পরিদর্শক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাই সিএমএমকেও কারা পরিদর্শক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। তাছাড়া কারাগারে জেলা ও মহানগরের বন্দীদের পৃথক রাখা প্রয়োজন। এতে তদারকি সহজ হবে।
এডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান
মানবাধিকার কর্মী
কারাগারে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে রাখার পৃথক ব্যবস্থা নেই। তারা কেন ব্যবস্থা করছে না জানি না। অনেক ক্ষেত্রে আইন বাতিল হয়ে গেলেও ওই আইনে আগে গ্রেপ্তার হওয়া অনেকে এখনও কারা ভোগ করছেন। এটা মানবধিকারের চরম লঙ্ঘন। নাম বিভ্রাটের কারণেও অনেকে এখনও কারাগারে রয়ে গেছে। অনেকে আবার এমন কিছু মামলায় গ্রেপ্তার যে মামলায় তার এক বছর জেল হবে, কিন্তু তাকে ৮-১০ বছর বিনাবিচারে আটকে রাখা হয়েছে। আবার পাসপোর্ট, এনআইডিসহ নানা জটিলতায় একজনের সাজা আরেকজন ভোগ করছেন। ১৮ বছরের নিচে কাউকে কারাগারে পাঠানোর নিয়ম নেই। কিন্তু সেফ হোমে না পাঠিয়ে পুলিশ অনেক সময় শিশু-কিশোর গ্রেপ্তার করে তাদের বয়স বেশি দেখিয়ে আদালতে পাঠান। এতে দাগি অপরাধীদের সঙ্গে তাদেরও কারাগারে থাকতে হয়। যার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব তাদের ওপর পড়ে। তবে চট্টগ্রামে কোনো কিশোর সংশোধনাগার নেই। কারাগারকে ডিজিটাইলজ করতে হবে। এতে বয়স ও নামের বিভ্রাট বা আয়নাবাজি কমে যাবে। ব্রিটিশ আইনে এখনও চলছে, আইনের সংস্কার প্রয়োজন। কারাবন্দীরা ভোট দিতে পারে না, এটা মানবধিকারের লঙ্ঘন। তাদের ভোটাধিকার সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। কারাগারের ধারণক্ষমতার তিনগুণ কয়েদি রাখা হচ্ছে সেখানে, এটা উচিত নয়।
এডভোকেট পাপড়ী সুলতানা
সাবেক বেসরকারি কারা পরিদর্শক
চট্টগ্রাম কারাগার
কারা পরিদর্শক থাকাকালীন আমি যে বিষয়টি বেশি অনুভব করেছি তা হল ১৮-২৫ বছরের যে মেয়েগুলো সেখানে বন্দি তাদের বেশিরভাগ মামলা হচ্ছে ইয়াবার। যে মামলাগুলো অপব্যবহার হয় বেশি। তাদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি অধিকাংশকেই পরিস্থিতির শিকার হয়ে কারাগারে যেতে হয়েছে। কিন্তু তারা থাকছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সাথে। তাদের সাথে থাকতে থাকতে তারা অপরাধের ধরণগুলো শিখে যাচ্ছে। ১৮-২৫ বছরের এই মেয়েগুলো বেশিভাগই ইন্টারমিডিয়েট, অনার্সে পড়ুয়া। সহজে একটা মামলার জামিনও হয় না। সেক্ষেত্রে তারা বন্দি থাকছে কয়েকবছর। অপরাধী না হয়ে ঢুকলেও অপরাধী হয়ে বের হচ্ছে। যারা হাজতি হিসেবে ঢুকে তাদের যদি আলাদাভাবে রাখা যায় তাহলে তাদের অপরাধের ধারণা জন্মাবে না। কারাগারের ক্যান্টিনে একটি সিঙ্গারা বিক্রি হয় ৫০ টাকা। বাণিজ্য যতগুলো আছে সব চলে। কারা পরিদর্শক যখন ওখানে রোস্টার হিসেবে ঢুকে তখন সবাই এতো বেশি ভালো হয়ে যায় তখন ভয়ে কেউ অভিযোগ দিতে আসতে পারে না। কারণ তাদের একটা সিন্ডিকেট আছে। মূলত ওই সিন্ডিকেট ভাঙতে পারলে কারাগারে অনেককিছু পরিবর্তন করা সম্ভব। সেখানে টাকা থাকলে ভালো এবং না থাকলে খারাপ অবস্থায় থাকতে হয়। টাকা থাকলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিও সেখানে ভালো অবস্থায় থাকতে পারে। আর টাকা না থাকায় সামান্য চুরির মামলায় কারাগারে সীমাহীন কষ্ট পেতে হয়। বন্দিদের শিশুদের জন্য আমরা মানবাধিকার সংগঠন থেকে পড়ালেখার জন্য শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলাম। খেলনার রুম করেছিলাম যেখানে বাচ্চারা খেলবে বিকেলে আর সকালে পড়াশোনা করবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ১০টা এলইডি টিভি দিয়েছিলাম এবং ১০টি ফ্যান দিয়েছি। বাচ্চাদের জন্য কাপড়, কম্বলের ব্যবস্থা করেছিলাম। অনেক বন্দি আছে যাদের পরিবারে কেউ নেই সে ব্যক্তিগতভাবে আইনজীবীর সাথে দেখা করে মামলা পরিচালনা করতে চায়। এই রকম অনেক মামলা নিয়ে আমি জামিন করিয়েছি। দাম্পত্য সম্পর্কের সুযোগ দেয়া জরুরি।
হোছাইন মোহাম্মদ ইউনুছ সিরাজী
সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
কারা সংস্কার হচ্ছে একটি ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের অংশ। তাই ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমকেই প্রথমে পুরোপুরিভাবে সংস্কার করতে হবে। এটি সংস্কার করা না হলে প্রিজন সিস্টেমকে সংস্কার করা সম্ভব হবে না। ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমে কারাবন্দীদের অধিকার ও কারাগার ব্যবস্থাপনা, দণ্ড প্রদান ও কার্যকরকরণ সম্পর্কিত বাংলাদেশে প্রচলিত অনেক আইন রয়েছে। অধিকাংশ আইন বিট্রিশরা তৈরি করে দিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে বিচারপতি মুনিমের নেতৃত্বে কারা সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছিল। কমিশন তার প্রতিবেদনে ১৮০টি সুপারিশ প্রদান করলেও অদ্যবধি তা বাস্তবায়নের পথে আর এগোয়নি। এছাড়া বাংলাদেশ নারী কারাবন্দীদের জন্য আলাদা করে দ্য স্পেশাল প্রিভিলেজ ফর কনভিক্টেড ওমেন অ্যাক্ট ২০০৬ তৈরি করেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক হেজাফতে মৃত্যু ও নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য দ্য টর্চার এন্ড কাস্টডিয়াল ডেথ (প্রেভেনশন) অ্যাক্ট ২০১৩ তৈরি করা হয়েছে। এত সব আইন থাকা স্বত্বেও পুলিশ হেফাজতে অসংখ্য লোকের মৃত্যু ঘটছে। প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া ও আইনসমূহের ল্যাকুনার কারণে কারাবন্দীদের মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের ১৭০টি দেশ আইনগত ও কার্যত মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করেছে। বিকল্প শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে এন্ডোরস করেছে, যা গবেষকরা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করছে। অনেক দেশ সাংবিধানিকভাবেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে বিলুপ্ত করেছে। এ ধরনের শাস্তি রাখাকে তারা রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় ও কারাবন্দীসহ পরিবারের সদস্যদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে। কারাবন্দীরা সংশোধিত না হয়ে উল্টো হারডেন ক্রিমিনাল হয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রিজনের পার্পাস হচ্ছে সেন্টেনসিংয়ের মাধ্যমে অপরাধীকে সংশোধন করা। জুডিসিয়াল সিস্টেমে বেআইনিভাবে দণ্ড দেয়া, দোষী সাব্যস্ত করা যদিও সন্দেহাতিতভাবে অপরাধ প্রমাণ করতে হয় বাস্তবে তা আমরা দেখতে পাই না। আন্ডার ট্রায়াল প্রিজনার্স রয়েছে অনেকে। তাদের অনেকবছর ধরে জেল খাটতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক যে আইন রয়েছে সেখানে সন্দেহাতিতভাবে কারো কোনো অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। পুলিশ কাস্টরিতে যারা থাকবে তারা কারাবন্দী নয়। কিন্তু আমাদের প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন যে ল’ রয়েছে সেই আইন অনুসারে মিনিমাম ছয়মাস পর্যন্ত কোনো ধরনের জবাবদিহিতা ছাড়া তাকে পুলিশ কাস্টরিতে রাখা হয়ে থাকে। আমাদের কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরাও থাকে। তাদেরও বিভিন্ন অধিকার রয়েছে সর্বোচ্চ আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার আগ পর্যন্ত। যখন সুপ্রিম কোর্ট থেকে রেফারেন্স নিতে হয় সেই সুপ্রিম কোর্ট নেয়ার আগে তারা কনডেম সেলে চলে যায়। এই ক্ষেত্রে তাদের যে অধিকার রয়েছে সেই অধিকারগুলো বিবেচনা করা হয় না। এই বিষয়গুলো সংশোধন করতে হবে। বাংলাদেশে কারা সংস্কার করতে গেলে অবশ্যই কারাগারের সাথে যারা স্টেকস হোল্ডারস যেমন- কারাগারের স্টেকসহোল্ডার হতে পারে, প্রিজনারস, প্রিজনার এডমিনিস্ট্রেশন, জুডিসিয়াল অফিসার্স, ল’ এন্ড ফোর্সেস এজেন্সিস তাদের সবাইকে রিফর্ম করতে হবে। অনেক রাষ্ট্র কারাদণ্ডের বিকল্প খুঁজছে। প্রায়ই সব ইউরোপীয়ান রাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রও কমিনিউটি সেন্টেন্স গ্রহণ করেছে। ফিনল্যান্ডে একজন কারাবন্দীর কাজ করার অধিকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা অধিকার রয়েছে। এভাবে প্রতিটা রাষ্ট্রকে সামাজিকভাবে প্রগ্রেসিভ হতে হবে। আমাদেরও কারাগারের বিকল্প খোঁজা জরুরি
নাঈম আহসান তালহা
প্রভাষক, আইন বিভাগ
চিটাগাং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি
গত বছরের আগস্টে প্রিজনার্স রাইটস নামে আমার একটি গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। আরেকটি প্রকাশের অপেক্ষায়। প্রকাশিত জার্নালে বন্দীদের দাম্পত্য সর্ম্পক বিষয়টি এসেছে। আইনের মাধ্যমে কারাগারে সাধারণত একজন বন্দী বা কয়েদির সব মুভমেন্ট নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু তাঁর স্বামী বা স্ত্রীর চলাচল অথবা দাম্পত্য সর্ম্পকের অধিকার সীমাবদ্ধ করার কোন সুযোগ আইনের নেই। একজন আইনমান্যকারী ব্যক্তির রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন অধিকার ক্ষুণ্ন করার এখতিয়ার আমাদের নেই। যিনি অপরাধ করেছেন তাকে আমরা শাস্তি দিতে পারি, কিন্তু যিনি অপরাধ করেননি তাকেও আমরা শাস্তি দিচ্ছি। রাষ্ট্রীয়ভাবে উনাকে দাম্পত্য সর্ম্পক পুনঃস্থাপিত করা থেকে আমরা বিরত রাখছি। গবেষণাপত্রে আমি এসব বিস্তারিত তুলে ধরেছি। এক্ষেত্রে ভারতের জুডিসিয়াল রেফারেন্স, পাঞ্জাবের বিভিন্ন কারাগারে দাম্পত্য সর্ম্পক রাখার সে সুযোগ দেয়া হয়েছে সেটা তুলে ধরেছি। একইসাথে তুরস্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ বিশ্বের ২৮টি দেশের কারাগারে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগটা আছে। একজন দীর্ঘমেয়াদে কারাগারে থাকা কয়েদি বা তাঁর স্ত্রী অথবা স্বামী চাইলে একটা নির্দিষ্ট সর্ম্পকের জন্য দাম্পত্য সম্পর্ক বা ব্যক্তিগত সময় অতিবাহিত করতে পারবেন। বর্তমানে কারা সংস্কারের যে দাবি উঠেছে, তাতে এ বিষয়টি যুক্ত করা জরুরি। এছাড়া রাজশাহীর আদালত একজন হিজড়াকে কারাগারে পাঠানোর পর আর একটি সমস্যা উঠে এসেছে। সেটা হল আমাদের কারা আইনে নারী এবং শিশুকে আলাদা সেলে রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু হিজড়াদের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ নেই। ফলে এই হিজড়াকে যখন কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তাকে মেয়েদের সাথে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বন্দী নারীরা এর তীব্র প্রতিবাদ করে উঠে। তারা জানায়, হিজড়া থাকলে তাদের ক্ষতি হতে পারে। তারপর পুরুষদের সেলে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর বন্দী হিজড়া নিজেই প্রতিবাদ জানান যে, জেলে থাকা পুরুষ বন্দী কর্তৃক তিনি যৌন হামলার শিকার হতে পারেন। দোদুল্যমান অবস্থায় কারা কর্তৃপক্ষ তাকে পুরুষদের সাথে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। এতে করে ও হিজড়া বন্দী যৌন হেনেস্তার শিকার হয়েছিলেন। এরপর আদালত বেশকিছু নির্দেশনা দিলেও এখনও পর্যন্ত কারা আইনে তা অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। তাই কারা সংস্কারের যে দাবি তাতে কারা আইন সংশোধন করে তাতে নারী, পুরুষ ও হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা সেল রাখার দাবি করছি। অন্যসব ডিজিটাল হলেও কারাগারে এখনও ম্যানুয়েলভাবে হয় না। কারাগারে একজনের পরিবর্তে অন্যজন কয়েদি হয়ে হাজতে থাকার ঘটনা আমরা প্রায় শুনে থাকি। এক্ষেত্রে কায়েদিদের ফিঙ্গার প্রিন্ট বা ফেজ রিকগনাইজেশনের মাধ্যমে ডিজিটাল রেজিস্ট্রি করতে পারি তাহলে একজন কয়েদি টাকার বিনিময়ে একজন সাধারণ মানুষকে জেল খাটাতে পারবে না। এছাড়া কারাগারে শিক্ষা কারিকুলামে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে।
নাজিম মুহাম্মদ
সাংবাদিক, দৈনিক পূর্বকোণ
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের বর্তমানে বন্দীর ধারণ ক্ষমতা ২২৪৯ জন, কিন্তু প্রতিদিন গড়ে বন্দী থাকে ৬ হাজারের ওপরে। এটাকে ভিত্তি করে বন্দীদের থাকা, খাওয়া নিয়ে বিশাল একটা সিন্ডিকেট বাণিজ্য হয়। পেশাগত কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বন্দীদের সাথে আলাপ করেছি। এসব আলাপে বেশকিছু সমস্যার বিষয়ে আমি জেনেছি। এর মধ্যে বন্দীদের থাকা, খাওয়া, স্বজনদের দেখা করা এবং বন্দী মায়েদের সাথে যেসব শিশুরা থাকে তাদের নিয়ে রয়েছে নানান সমস্যা। বন্দীরা কারাগারে গেলে প্রথম দিন আমদানি রুমে রাখা হয়। ২’শ বা ৬’শ যতই বন্দী আসুক তাদেরকে একরুমে রাখা হয়। পরদিন তাদের কেইস টেবিলে নিয়ে আসা হয়। সেখানে বন্দীর চুল কাটা থেকে শুরু করে ডাক্তারি পরীক্ষা পর্যন্ত সবকাজ সম্পন্ন করা হয়। এরপর শুরু হয় বন্দী বেচাকেনার কাজ। বন্দী কোন ওয়ার্ডে যাবে? বন্দী যখন ওয়ার্ডে যাবে তখন ওয়ার্ড পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কয়েদিরা বন্দীর সাথে চুক্তি করে। বন্দীর থাকা, খাওয়া ও স্বজনদের সাথে কয়বার দেখা করবে সেটা নিয়ে টাকার বিনিময়ে চুক্তি করতে হয়। ৬ হাজার বন্দী থাকলে এর মধ্যে প্রতিদিন ২ থেকে ৩ হাজার বন্দী কারাগার কেন্টিন থেকে খাবার কিনে খায়। কারাগার থেকে যে খাওয়া দেয়া হয় সেটা প্রথম অবস্থায় বন্দীরা খেতে পারেন না। যার কারণে বাইরে থেকে যেসব খাবার কারাগারে কেন্টিনে যায় বন্দীরা কয়েকগুণ বেশি মূল্যে তা টাকা দিয়ে কিনে নেয়। এটা নিয়ে ভালো একটা বাণিজ্য চলে। এছাড়া জেলকোডে কোন শিশু বন্দীর জন্য খাবারের বরাদ্দ নাই, তাই মায়ের জন্য যে খাবার সরবরাহ করা হয় তা থেকে শিশুকে খেতে হয়। এছাড়া টেলিফোন নিয়ে চলে অবৈধ বাণিজ্য। ২০১৮ সালে স্বজন পরিবারের বন্ধন নামে একটি প্রকল্পে সব কারাগারে টেলিফোন দেয়া হয়। যার মাধ্যমে একজন বন্দী মাসে দু’বার ১০ মিনিট করে কথা বলতে পারবেন। কিন্তু আমাদের কারাগারে বর্তমানে যে টেলিফোন রয়েছে, তা দিয়ে কথা বলতে চাইলে প্রতি মিনিটে ৫০ থেকে ৬০ টাকা করে দিতে হয়। নারী ও বৃদ্ধদের টেলিফোন ব্যবহারে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা থাকলেও তা মানা হয় না। এসব ছোট সমস্যাগুলোতে বেসরকারি কারা পরিদর্শকরা ভ‚মিকা রাখতে পারেন। আপনারা যদি কারাগারকে ঘিরে গড়ে উঠা এই সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেন তাহলে চট্টগ্রাম কারাগারে অন্যরকম পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারবেন।
প্রকৌশলী মুহাম্মদ নাছির উদ্দিন
চেয়ারম্যান আলহাজ্ব শামসুল হক ফাউন্ডেশন ও
বেসরকারি কারা পরিদর্শক, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার
আলহাজ শামসুল হক ফাউন্ডেশন আয়োজিত আজকের গোলটেবিল আলোচনাটি আশা করছি একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ছাড়িয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রথম সংগঠন হিসেবে আলহাজ শামসুল হক ফাউন্ডেশন গত দুইবছর ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় কাজ করছে। গাজায় নিয়মিত খাওয়া দাওয়া, তাঁবু স্থাপনসহ নিয়মিত সব কাজ করার পাশাপাশি সোলার এবং পানির কিছু প্ল্যান্ট স্থাপন করেছি। মসজিদ নির্মাণ করেছি। কিছু দিনের মধ্যে মিশরেও কাজ শুরু করবো। দেশের মধ্যে চট্টগ্রামে আমাদের পরিচালিত মেহমান খানায় গত পাঁচবছর ধরে দুপুরে বিনামূল্যে খাবার খাওয়ানো হয়। হ্যালো হসপিটালে প্রতিদিন বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। রয়েছে মুসাফির খানা। যারা বাইরে থেকে বিভিন্ন কাজে চট্টগ্রামে আসেন, তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। রয়েছে মহিলা মাদ্রাসা, ভাসমান মসজিদ। সিলেটে ভাসমান নৌ বিশুদ্ধকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে নদীর পানি বিশুদ্ধ করে হাওড়ে দৈনিক তিন হাজার মানুষকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছি। সম্প্রতি নিজেদের খরচে যৌতুকবিহীন বিয়ের আয়োজন শুরু করেছি। যা দেশে বিদেশে খুবই আলোচিত হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আধুনিক মরদেহ গোসলখানা স্থাপন করেছি। যাতে গরীব দুঃখীদের জন্য বিনামূল্যে কাফন কাপড়সহ যাবতীয় সব ব্যয় করা হয়। এছাড়া মেডিকেলের প্রশাসনিক ভবনে স্থাপন করা হয়েছে সবার জন্য উন্মুক্ত পানির প্ল্যান্ট। আজকের গোলটেবিল আলোচনায় বেশ কিছু সুপারিশ উঠে এসেছে, এর মধ্যে রয়েছে থাকা, খাওয়া ও টেলিফোন নিয়ে সিন্ডিকেট বাণিজ্য বন্ধ করা, দাম্পত্য সর্ম্পক রাখার সুযোগ, ডিজিটাল রেজিস্ট্রি, ধর্মীয় শিক্ষা অন্তর্ভূক্ত করা, বিচার বহির্ভূত আটক, হাজতি ও কয়েদি পৃথক রাখা, ক্যান্টিনে খাবারের উচ্চমূল্য, কয়েদিদের কাছ থেকে আলাদাভাবে অভিযোগ জানার ব্যবস্থা করা, আইনজীবিদের সাথে দেখা করার সুযোগ, তৃতীয় লিঙ্গের জন্য আলাদা রুম, শিশু কিশোরদের জন্য আলাদা সংশোধনাগার, কারাবন্দীদের ভোটাধিকারের ব্যবস্থা, কারা আইন সংস্কার, কারা ব্যবস্থা উন্নত করা, সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের সচেতনতা, জেলারের সংখ্যা বৃদ্ধি, চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে অফিসিয়ালি জেল পরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়া, জুডিশিয়াল ও সিভিল মামলায় আটক থাকা বন্দীদের আলাদা রাখা, রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে দলমত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সেবা প্রদান করা, শরীয়া কনসালটেন্ট নিয়োগ এবং কারা পরিদর্শকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়া। নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের বিষয়টি মুখে বললে হবে না, আমাদের কাজ করে দেখাতে হবে। কারাগার হবে মোটিভেশনের স্থান। কয়েদিদের মোটিভেশন কিভাবে বাড়ানো যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।
পূর্বকোণ/জেইউ