নগরীর অভিজাত কমিউনিটি সেন্টার নেভি কনভেনশন হল থেকে আওয়ামী লীগ নেতা ফখরুল আনোয়ারকে আটক করে পুলিশে দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা। ঘটনার সময় তার ছেলে সৈয়দ মিনহাজুল আনোয়ারের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা চলছিল। শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) রাতে এই ঘটনা ঘিরে ‘তুলকালাম’ বাধে ওই কমিউনিটি সেন্টার এলাকায়।
ঘটনার সময় বিবাহোত্তর সংবর্ধনায় আগত অতিথিদের হেনস্থা, নারী অতিথিদের ব্যাগ ও গহনা চুরি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের কয়েকজনকে লাঠিপেটা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছে পূর্বকোণ।
মূলত শনিবার রাতে আওয়ামী লীগ নেতা ফখরুল আনোয়ার চৌধুরীর ছেলে ও সাবেক মেয়র মনজুর আলমের নাতনি সৈয়দা মাহবুবা হোসনে আরা মনজুরের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা ছিল। ফখরুল আনোয়ার চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক এবং চট্টগ্রাম-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনির চাচা। তার ভাই ও সনির বাবা রফিকুল আনোয়ারও আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন।
চট্টগ্রামের প্রভাবশালী এই দুই পরিবারের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিএনপি, জামায়াতসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা আমন্ত্রিত ছিলেন বলে জানা গেছে। সেখানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের উপস্থিত হওয়ার কথাও নিশ্চিত করেছেন ওই অনুষ্ঠানের একাধিক অতিথি।
রাত ৯টার পর ওই অনুষ্ঠানে খাদিজাতুল আনোয়ার সনি ও আরেক সাবেক সংসদ সদস্য নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী উপস্থিত আছেন- এমন একটি খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর জেরে তাদের আটকের উদ্দেশ্যে কমিউনিটি সেন্টারটি ঘেরাওয়ের চেষ্টা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা। পরে তারা কমিউনিটি সেন্টারে প্রবেশ করে আওয়ামী লীগের সাবেক দুই সংসদ সদস্যের খোঁজ করেন। তবে সেসময় কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে নির্বিচারে ভাঙচুর ও অতিথিদের হেনস্থার অভিযোগ করেছেন একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী।
বিবাহোত্তর ওই অনুষ্ঠানের শুরু থেকে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ফখরুল আনোয়ারের নিকটাত্মীয় ও ফটিকছড়ির একটি ইউনিয়নের সাবেক এক চেয়ারম্যান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি পূর্বকোণকে জানান, ঘটনার সময় নেভি কনভেনশন হলে দুটি অনুষ্ঠান ছিল। কমিউনিটি সেন্টারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় ছিল ফখরুল আনোয়ারের ছেলের অনুষ্ঠান। আরেকটি হলো নিচতলায় হাটহাজারীর ডা. জসিম নামে এক ব্যক্তির ছেলের বৌভাত অনুষ্ঠান।
তিনি আরও জানান, ঘটনার সময় নিচতলার অনুষ্ঠানের অধিকাংশ অতিথি উপস্থিত থাকলেও তুলনামূলক কম অতিথি ছিলেন উপরের তলার অনুষ্ঠানে। অধিকাংশই খাওয়া-দাওয়া সেরে চলে গিয়েছিলেন। রাত সাড়ে নয়টা থেকে ১০টার দিকে কমিউনিটি সেন্টারের বাইরে প্রথম স্লোগানের শব্দ শোনা যায়। ধীরে ধীরে স্লোগান দেওয়া লোকজনের সংখ্যা বেড়ে যায়। একপর্যায়ে রাত সাড়ে দশটার দিকে কমিউনিটি সেন্টারের ভেতর এক দল যুবক ফখরুল আনোয়ারকে ঘিরে ধরে হেনস্থা করতে দেখেন তিনি। তখন এগিয়ে গিয়ে ওই যুবকদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে উত্তেজিত যুবকরা তাকেও হেনস্থা করেন।
ওই অতিথি জানান, তাদের কেউ কেউ ফখরুলকে মারধর করে খাদিজাতুল আনোয়ার সনি ও নজিবুল বশর কোথায় জানতে চান। ধীরে ধীরে কমিউনিটি সেন্টারে কয়েকশ যুবক জড়ো হন। তারা খুবই উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করতে থাকেন এবং একাধিক নারীসহ কয়েকজন অতিথিকে হেনস্থা করেন। এর মধ্যে নারী অতিথিদের কেউ কেউ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখে পরনের গহনা খুলে ব্যাগে রেখে দেন। তাদের কয়েকজনের গহনাসহ ব্যাগ চুরি হওয়ার খবর পেয়েছেন তিনি। অনেকটা একই কথা বলেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত আরও অন্তত তিনজন অতিথি। তবে তাদের কেউই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
নেভি কনভেনশন হলে আওয়ামী লীগের সাবেক দুই সংসদ সদস্য থাকার খবরে সেখানে গিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রিজাউর রহমান। পূর্বকোণকে তিনি জানান, মূলত ঘটনার শুরু টাইগারপাস এলাকার ট্রাফিক জ্যাম থেকে। রাতে সেখানে জ্যামের কারণ খুঁজতে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জড়িত ওই এলাকার কয়েকজন নেভি কনভেনশন হলে একটি জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের বিষয়ে জানতে পারেন। সেটির একটি দাওয়াতপত্রও তাদের হাতে আসে। সেখানে বরের বাবার নাম দেখে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত বলে জানতে পারেন।
এর মধ্যে তারা চট্টগ্রাম-২ আসনের সাবেক এমপি খাদিজাতুল আনোয়ার ও নজিবুল বশরের উপস্থিত থাকার খবর পান। বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে খোঁজ নেন ছাত্ররা। সেখানে একজনকে নজিবুল বশরের মতো মনে হলেও তারা চিহ্নিত করতে পারেননি। পরে ফখরুল আনোয়ারের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তাকে চিনতে পেরে ঘেরাও করেন ছাত্ররা। এ সময় সেখানে উপস্থিত আওয়ামী লীগের নেতারা ছাত্রদের ওপর হামলা চালান। আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগ দেন কমিউনিটি সেন্টারটির কর্মচারীরা। তাদের হামলায় অন্তত ১০ ছাত্র আহত হন। পরে সেখানে পুলিশ উপস্থিত হলে তাদের হাতে ফখরুলকে তুলে দেন ছাত্ররা।
পরবর্তীতে হামলাকারীদের ওপর বিচারের দাবিতে সেখানে অবস্থান নেন ছাত্ররা। শেষরাতে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত হয়ে ছাত্রদের আশ্বস্ত করেন। পরে ছাত্ররা চার দফা দাবি জানিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। চার দফার মধ্যে রয়েছে- হামলার আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন, হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ, নেভি কনভেনশন হলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ঘিরে সৃষ্ট ট্রাফিক জ্যাম নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দ্রুততম সময়ে গ্রেপ্তার করা।
দুই সংসদ সদস্যকে খুঁজতে যাওয়া ছাত্রদের লাঠিপেটার বিষয়ে জানতে চাইলে ফখরুল আনোয়ারের ওই নিকটাত্মীয় বলেন, তারা সনি ও নজিবুলকে খুঁজতে খুঁজতে কমিউনিটি সেন্টারের পেছনের দিকে থাকা নেভির ক্যাম্পে চলে যান। সেখানে তারা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করায় মারধরের শিকার হয়েছেন বলে শুনেছি। পরে তিন তলায় উঠে এক নারীকে হেনস্থার সময় নৌ-সেনারা দেখে ফেলেন। তখন তাদের মারধর করেন। পরে তারা ফখরুল আনোয়ারকে আটক করে নিয়ে যান।
এদিকে, আওয়ামী লীগ নেতা ফখরুল আনোয়ারকে খুলশী থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে জানিয়েছেন নগর পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি-ক্রাইম) মো. রইছ উদ্দিন। পরে কোতোয়ালী থানার একটি মামলায় তাকে আদালতে হাজির করা হলে আদালত কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন বলে জানান নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন) মফিজ উদ্দিন।
আদালত সূত্রে জানা যায়, কোতোয়ালী থানায় ওই মামলা দায়ের করেছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র মো. তাফহীমুল ইসলাম। মামলায় এজহারনামীয় ১০ নম্বর আসামি ফখরুল আনোয়ার।
পূর্বকোণ/ইব