বৈদ্যুতিক তামার তারের গুণগত মানের কারণে বাজার ছিল বড়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছিল লাভজনক প্রতিষ্ঠানে। দেশের ২০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করতো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস। সরকার সন্তুষ্ট হয়ে উৎপাদন ৫০ শতাংশে উন্নীতকরণে আধুনিকীকরণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু রক্ষকদের ভক্ষকের কারণে ধুঁকছে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। বড় কর্তাদের ‘জালিয়াতি ও দুর্নীতিতে’ ডুবে লাভজনক প্রতিষ্ঠান এখন লোকসানি-রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটি লাভ করেছিল ১১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। পরের দুই বছর লাভের অঙ্ক আরও বড় হয়। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে লাভ হয় ১৫ কোটি ৮৮ লাখ এবং ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ১৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এরপর থেকে লাভের সূচক টানা কমতে থাকে। ২০২০-২১ সালে লাভ হয় ২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। পরের তিন বছর লাভ-ক্ষতির উত্থান-পতন ঘটে। ২০২১-২২ সালে লোকসান গুণে ৫৫ লাখ টাকা। আবার ২০২২-২৩ সালে লাভ হয় ১৩ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ সালে লোকসান গুনতে হয় ৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। বড় অঙ্কের লোকসানের মধ্যে আগামী বছর থেকে শুরু হচ্ছে ঋণের কিস্তি পরিশোধের পালা।
গাজী ওয়্যারস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আবদুল হালিম পূর্বকোণকে বলেন, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডসহ পুরোনো ক্রেতারা ফিরে গেছে। উৎপাদন কম হওয়ায় এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর আরইবিসহ অন্য বড় ক্রেতাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। মন্ত্রণালয়ে একাধিক বৈঠকও হয়েছে। এখন কিছু প্রতিষ্ঠানের অর্ডার আসছে। আশা করছি, আগামী বছর থেকে লাভে ফিরতে পারবো।
নগরের কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকায় অবস্থিত গাজী ওয়্যারস কারখানায় তৈরি তামার তার প্রধানত ট্রান্সফর্মার, বৈদ্যুতিক মোটরসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক ইকুপমেন্ট তৈরি ও মেরামতের কাজে ব্যবহার করা হয়। কপার ওয়্যার আমদানি করে এসব তামার তার উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠানটি। দেশের মোট চাহিদার ২০ শতাংশ পূরণ করতো রাষ্ট্রায়ত্ত এ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। চাহিদার ৫০ শতাংশ মেটানোর লক্ষ্যে ২০১৮ সালে ৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিকায়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
আধুনিকীকরণ প্রকল্প :
২০১৭ সালে শক্তিশালী ও আধুনিকীকরণ শীর্ষক প্রকল্প নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। ২০১৮ সালে ৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদন পায়। প্রকল্পের আওতায় একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ, ৯টি ভারী মেশিনারিজ ক্রয় ও অন্যান্য নির্মাণ কাজ করা হয়েছে।
গাজী ওয়্যারস সিবিএর যুগ্ম সম্পাদক মাসুদুর রহমান পূর্বকোণকে বলেন, শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে লাভজনক প্রতিষ্ঠানটি এখন লোকসান গুনছে। বড় ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় বাজার ছোট হয়ে এসেছে। উৎপাদন কমে আসায় প্রায়শই মেশিন বন্ধ রাখতে হয়। এ অবস্থায় অনিশ্চয়তায় পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটি।
প্রকল্পে লুটপাটের অভিযোগ :
৬৫ কোটি টাকার প্রকল্পে ২৫ কোটি টাকা লুট হয়েছিল বলে দাবি করেছিল গাজী ওয়্যারস এমপ্লয়িজ এসোসিয়েশন। ২০২৩ সালের ২৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এই অভিযোগ করা হয়েছিল।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম মোস্তফা দাবি করেছিলেন, প্রকল্পে সরকারি অর্থ লুট করা হয়েছে। মেশিনগুলো বছর না যেতেই অকেজো হয়ে পড়ছে। কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে নানা ধরনের জালিয়াতি করা হয়েছে।
শ্রমিক-কর্মচারীরা জানান, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) গাজী ওয়্যারসের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। এছাড়া পিডিবি, ডিপিডিসি, ডেসকো, পিজিসিবিসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ কারখানার গ্রাহক ছিল। প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আঁতাত করে বড় ক্রেতাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। সংস্কার ও সম্প্রসারণের নামে অর্ডার বাতিল করা, নতুন অর্ডার না নেওয়া ও নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় বড় ক্রেতারা অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে গেছে। অনিয়ম-দুর্নীতি এবং অদক্ষতা ও কর্মকৌশলের অভাবে দিন দিন বাজার হারিয়ে ফেলেছে। লাভজনক সরকারি প্রতিষ্ঠানটি এখন বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে।
কেনাকাটানায় জালিয়াতি : ২০১৮ সাল সুপার এনামেল কপার ওয়্যার তৈরির জন্য মেশিনারিজ জাপান থেকে কেনার কথা। কিন্তু নয়টি মেশিনারিজের মধ্যে ছয়টি আনা হয়েছে তাইওয়ান থেকে। বাকি তিনটি কোথা থেকে আনা হয়েছে তার প্রমাণ পায়নি তদন্ত কমিটি। এসব মেশিনারিজ জাপানের পরিবর্তে তাইওয়ান থেকে এনে বিপুল অঙ্কের টাকা লোপাট করা হয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শিল্প মন্ত্রণালয়ের ইস্পাত ও প্রকৌশলী করপোরেশন অভিযোগের ভিত্তিতে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তিন কমিটির তদন্ত, পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশমালা সমন্বয় করে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। ২০২২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বিএসইসির তৎকালীন সচিব মো. নাজমুল হক প্রধান দুদক চেয়ারম্যানকে এই চিঠি দিয়েছিলেন। তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরফলে প্রকল্প পরিচালক আখতার হোসেন, উপ-পরিচালক তাজুল ইসলাম ও এমডি ডা. গোলাম কবীরের চাকরিচ্যুত এবং এমডির বেতন-ভাতা এবং পেনশন স্থগিত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৬৫ সালে ব্যক্তি মালিকানায় নগরের কালুরঘাট শিল্প এলাকায় ৩ দশমিক ৮৯ একর জায়গার ওপর গাজী ওয়্যারস লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সালে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে এ প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করে। বর্তমানে শিল্প মন্ত্রণালয়ে অধীন বিএসইসির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত।
পূর্বকোণ/ইব