চট্টগ্রাম সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

অসংক্রামকে মৃত্যু বেশি, নজর শুধুই করোনাতে

৭ এপ্রিল, ২০২২ | ১২:১৪ অপরাহ্ণ

ইমাম হোসাইন রাজু

চট্টগ্রামে হৃদরোগের সবচেয়ে বড় চিকিৎসা কেন্দ্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগ। বিভাগটিতে প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ জনের বেশি মানুষ হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়ে থাকে। যা বছরে ১৫ হাজার ছাড়ায় ভর্তি রোগীর সংখ্যা। ওয়ার্ডের হিসেবেই বছরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ১৪ থেকে ১৫ শ’ জনের। এরমধ্যে ২০২০-২০২১ বছরেই মৃত্যু হয় ১ হাজার ৪৪৬ জনের।

এ ছাড়া হাসপাতালের নিউরোলজি ওয়ার্ডের চিত্রও প্রায় একই। ওয়ার্ডটিতে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ জন স্ট্রোক বা মস্তিষ্কজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়। আর দিনে ২ থেকে ৩ জনের মৃত্যু হয় এ রোগে। যা মাসে ৭০ থেকে ৮০ জন পর্যন্ত পৌঁছায়।

মৃত্যুর এ সংখ্যাই বলে দিচ্ছে- এ দুই রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে কত মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে চট্টগ্রামে। এ দুই বিভাগসহ চমেক হাসপাতালে বছরে মোট মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। যার মধ্যে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশের বেশি। সঠিক পরিসংখ্যান না থকলেও, চট্টগ্রামের চিকিৎসকদের মতে- বছরে পুরো চট্টগ্রামে ৩০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগে। বিপরীতে চট্টগ্রামের করোনায় গেল দুই বছরে মারা গেছেন ১ হাজার ৩৬২ জন। অথচ করোনার চেয়ে অসংক্রামক রোগের মৃত্যুর হার ২২ গুণের বেশি হলেও তাতে নজর নেই কারোরই। আলোচনা শুধু করোনাকেই ঘিরে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে যেভাবে জোর দেয়া হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদী অসংক্রামক রোগে সেই ভাবে নজর নেই কারও। যার কারণে ধীরে ধীরে এ মৃত্যুর হার আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠছে। তাই হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, স্থুলতা, ক্যান্সারসহ কয়েকটি বিষয়ে চিকিৎসা নিশ্চিতের পাশাপাশি প্রতিরোধের উপর জোর দিতে হবে। এ জন্য স্বাস্থ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। আশংকা প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশের বেশি এ অসংক্রামক রোগের কারণে হয়ে থাকে। এটিকে গুরুত্ব না দিলে ২০৪০ সালে এই হার ৭০ থেকে বেড়ে ৮০ শতাংশে উঠে যেতে পারে। 

করোনার মতো অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে দরকার পরিকল্পনা :

এই পরিস্থিতিতে যা করণীয় হচ্ছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে অসংক্রামক রোগের সেবাকে উন্নত করা দরকার বলে মত সংশ্লিষ্টদের। মত প্রকাশ করে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও জেলার সাবেক সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘গত দুই বছরে করোনাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে অসংক্রামক রোগের প্রতি তেমন নজর দেয়া যায়নি। তাছাড়া অসংক্রামক রোগীরাও সঠিক সময়ে হাসপাতালে তেমন আসেনি। যার কারণে তাদের রোগ জটিল হয়ে যায়, এ জন্য করোনার চেয়েও এ রোগে মৃত্যু বেশি হয়েছে। যদিও স্বাভাবিকভাবেই অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের এ কর্মকর্তা।

অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে আমাদের সঠিক পরিকল্পনা করা দরকার আছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য বিভাগের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরই পৃথক একটি উইং আছে। তবে আমাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও স্বাস্থ্যখাতে অনেক সফলতা রয়েছে। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করতে হলে স্বাস্থ্য বিভাগের আগে অবশ্যই সাধারণ মানুষকেই সচেতন হতে হবে। সঠিক পদক্ষেপ নিলেই এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

অকাল মৃত্যু বা পঙ্গুত্বের কারণ অসংক্রামক রোগ :

সঠিক ও পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পেলে অসংক্রামক রোগ অতি নীরবে জটিল আকার ধারণ করে। যা আক্রান্ত ব্যক্তিকে অকালমৃত্যুর অথবা দীর্ঘমেয়াদি পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দেয় বলে মত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রিজোয়ান রেহান বলেন, ‘মানুষের সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে অনেক। সাধারণত মানুষ শারীরিকভাবে অসুস্থতা বোধ না করলে চিকিৎসকের কাছে যায় না। এ কারণেই অসংক্রামক ব্যাধি মানুষের উপর ভর করছে। এসব রোগ ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির মধ্যে না ছড়ালেও ধীরে ধীরে বেড়েই চলছে।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জামান আহমেদ বলেন, ‘অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর মধ্যে স্ট্রোক বা মস্তিস্ক রোগ বড় একটি কারণ। তবে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও অতিরিক্ত ওজন- এ তিনটি নিয়ন্ত্রণে থাকলে এ রোগ থেকে ৮০ শতাংশ বাঁচা সম্ভব। এতে করে মৃত্যুর সংখ্যাও কমে আসবে। তাছাড়া মানুষ সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতেও আসে না, দেরিতে আসার কারণেও অনেকাংশে মৃত্যু হয়ে থাকে। তাই এ বিষয়ে সকলকেই সচেতন থাকা প্রয়োজন।’

মাসে সহস্রাধিকের মৃত্যু চমেক হাসপাতালেই : বৃহত্তর চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় এ হাসপাতালে প্রতিমাসে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে। যার ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশই হচ্ছে অসংক্রামক রোগে। বাকিদের মধ্যে বড় অংশের বিভিন্ন দুর্ঘটনায় কবলিত হয়ে মৃত্যু হয়ে থাকে। তকে সংক্রামক রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ন্যূনতম। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় হৃদরোগ, নিউরোলজিক্যাল, ক্যানসার, কিডনি রোগসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে।

তথ্য অনুসারে, এ হাসপাতালে চলতি মাসে মৃত্যু হয়েছে ১৪০ জনের। এছাড়া জানুয়ারিতে ১ হাজার ৪৬৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ২৮৮ জন এবং মার্চ মাসে মৃত্যু হয় ১ হাজার ১৫৯ জন। আর গত বছরে তথা ২০২১ সালে এ হাসপাতালে মৃত্যু হয় ১৪ হাজার ৯৮৬ জনের, ২০২০ সালে মৃত্যু হয় ১৪ হাজার ১৪০ জন, ২০১৯ সালে ১৮ হাজার ২৯ জন, ২০১৮ সালে ১২ হাজার ২৬৪ জন এবং ২০১৭ সালে মৃত্যু হয় ১০ হাজার ৩৭৫ জনের। হিসেবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে মৃত্যু হারও বেড়েছে পাঁচ হাজারের বেশি।

 

পূর্বকোণ/এস

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট