চট্টগ্রাম বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

সামান্য পুঁজি থেকে ৫০ বছরে বৃহৎ শিল্প গ্রুপ শফি মোটর্স

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ২:০৬ অপরাহ্ণ

প্রফেসর ড. সৈয়দা খুরশিদা বেগম

প্রায় পঞ্চাশটি বছর ধরে সড়ক পরিবহন কাজে অভিজ্ঞ পরিচিত একটি নাম ‘সফি মোটর্স লি.’। এর শুরুটি ছিল খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে। যৎসামান্য আর্থিক পুঁজির সাথে দৃঢ় মনোবল, আত্ববিশ্বাস, একাগ্রতা, সততা, বন্ধুসুলভ মনোভাব, দূরদৃষ্টি ও বুদ্ধিমত্তা কিভাবে একটি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানকে একটি স্বনামধন্য বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে পরিনত করতে পারে তার একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যেক্তা আমার বাবা আলহাজ সৈয়দ মোহাম্মদ শফি।
চট্টগ্রামের রাউজান থানার কদলপুর গ্রামে ১৯৩৪ সালে জন্ম বাবার। ওখানেই বেড়ে উঠা। শৈশবেই দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির কারণে বাবাকে গ্রাম ছেড়ে চলে আসতে হয় শহরে, তাঁর এক চাচার সাথে। যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের ফজলুল করিম নামে এক শুভাকাক্সক্ষীর সাথে পরিবহন ব্যবসায় অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পান তিনি। মোটর গাড়ির ইঞ্জিন ও কলকব্জা সর্ম্পকে প্রবল আগ্রহ ও বুদ্ধিমত্তার কারণে স্বল্প সময়েই বাবা একজন অভিজ্ঞ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেন। ফজলুল করিম সাহেবের ¯েœহপূর্ণ সমর্থন ও তার ব্যবসার সফলতা বাবা তার মনে পরিবহন ব্যবসার সাথে জড়িত হওয়ার আগ্রহ জাগ্রত হয় বলে বিভিন্ন সময় উল্লেখ করতেন।
ইতোমধ্যে পরিচিত এক বন্ধুর আগ্রহ ও সহযোগিতায় একটি সুগারমিলে কাজ করার সুযোগ পান বাবা। সেখানে কাজের সময় কর্মদক্ষতার কারণে সেখানকার এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের সুনজরে পড়েন। কিন্তু পর পর দুবার বিদেশে ট্রেনিং এর জন্য নমিনেশন পেয়েও যেতে না পারায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন ‘চাকরি আর নয়’। সেটি ছিল ১৯৬৪ সাল। মোটর পার্টস ও সড়ক পরিবহন ব্যবসায় পূর্বে অর্জিত অভিজ্ঞতা, দৃঢ় মনোবল ও যৎসামান্য পুঁজি সম্বল করে চট্টগ্রাম শহরে এক টুকরো জমির উপর গড়ে তোলেন “সফি মোটর্স” নামে মোটর পার্টস/সার্ভিসিং এর ক্ষুদ্র এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সাথে পেলেন নিবেদিত প্রাণ কিছু কর্মচারী।
শুরুতে “সফি মোটর্স” কে নিয়ে কঠোর সংগ্রামের পর বিজয়ী হয়ে ব্যবসার সুবিধার্থে এটি আরও বড় পরিসরে বর্তমান অবস্থান ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড়ে স্থানান্তরিত করেন। ধীরে ধীরে বাবা একটি, দুটি গাড়ির মালিক হতে লাগলেন। অকশন থেকে কেনা অতি পুরানো বা বিকল গাড়ি-বাস, ট্রাক, ক্রেন এসব। কঠোর পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্তায় গাড়িগুলো নতুন ও কার্যোপযোগী করে তুলতেন বাবা। আস্তে আস্তে গাড়ির সংখ্যা বাড়তে লাগল। কিছু দেশব্যাপী নিজের পরিবহন ব্যবসার কাজে ও কিছু বিক্রি করা এভাবেই চলছিল ‘সফি মোটর্স’ এর কার্যক্রম। বাড়ছিল ব্যবসার পরিধি। বাবার সড়ক পরিবহন ব্যবসায় যোগ হল বড় ট্রেইলার। খাদ্য মন্ত্রনালয়ের চট্টগ্রাম বিভাগে “সফি মোটর্স” সর্বাধিক পরিমাণ খাদ্য সামগ্রী পরিবহন করার রেকর্ড অর্জন করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থার মাধ্যমে বৈদেশিক ঋণের সহায়তায় বাবা “সফি মোটর্স লি.” নামে তার সড়ক ব্যবসাকে পরিবহন ব্যবসাকে ইন্ডাস্ট্রিতে রুপান্তর করেন। যা এদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাসে এক অনবদ্য সৃৃষ্টি ও অবদান হিসেবে স্বীকৃত। এখানে উল্লেখ্য যে, উক্ত ঋণ পাঁচ বছরে পরিশোধ করার চুক্তি থাকলেও তা চার বছরে সম্পূর্ণ পরিশোধ করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তার শিল্প মানসিকতার পরিচয় দেন।
‘সফি মোটর্স লি.’ এর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম বেসরকারি ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো (ওঈউ) ও কন্টেইনার ফ্রাইট স্টেশন (ঈঋঝ) । বর্তমানে এটি বাংলাদেশের শিল্পকারখানায় ৩চখ সেবা প্রদানকারীদের মধ্যে অন্যতম একিিট প্রতিষ্ঠান।
দীর্ঘদিন বাবা রোড ট্রান্সপোর্ট এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এদেশে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি নিজের স্বার্থকে গৌণ করে দেখে সার্বিক উন্নয়নের দিকেই বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন সব সময়।
যে কোনো প্রতিষ্ঠানের সফলতার অংশীদার সেই প্রতিষ্ঠানের সকলেই, সকল কর্মকর্তা কর্মচারী। সকলের সমর্থন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে প্রজ্ঞা, আদর্শ, ধৈর্য্য ও বিচক্ষণতার প্রয়োজন তার সবই ছিল বাবার মধ্যে। দেখতাম কিভাবে বাবা তাদের সুন্দর মুল্যায়ন করতে যাদের অবদান আছে বাবার সাফল্যে। দেখতাম কিভাবে বিভিন্ন জনের ছোট খাট দোষ ত্রুটি এড়িয়ে যেতে। দেখতাম স্নেহভরা কন্ঠে নির্দিষ্ট কঠোর নির্দেশনা। দেখতাম অসুস্থ অবস্থার দিনগুলোতে ও সবার আগে নিজের অফিসে যাবার চেষ্টা যাতে সবাই অনুপ্রাণিত হয়।
১৯৮৫ সালে আশরাফ আলীর সম্পাদনায় প্রকাশিত বই ‘ব্যবসায় সফলতা পেলেন যারা’ তে সংযুক্ত এক সাক্ষাৎকারে ব্যবসায় সফলতা লাভের বিষয়ে জানতে চাইলে বাবা দুরদর্শিতা, অঙ্গীকার ঠিক রাখা, কাজ ও কথায় বিশ^স্ততা, ব্যবসায়ে সুুযোগের সদ্ব্যাবহার, সঠিক প্রশাসন ও ব্যবসায়িক মানসিকতার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। উক্ত সাক্ষৎকারে বাবা বলেন “এক টাকাকে পাঁচ সিকি করে সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারলে ব্যবসায় সফলতা অবশ্যম্ভাবী।” বইতে লেখক উল্লেখ করেন “ব্যক্তিগত জীবনে আলহাজ সৈয়দ মোহাম্মদ শফি খুবই ধর্মভীরু কিন্তু, সকল প্রকার ধর্মীয় গোড়ামীর উর্ধ্বে, খুবই বাস্তববাদী। কথা ও কাজের মানুষ তিনি। রুচিশীল ও অতিথিপরায়ণ, সিদ্ধান্তে স্থির অটল, অন্যদিকে বিনয়ী ও সহযোগিতাপূর্ণ মানসিকতার ব্যক্তি তিনি। কাজ তার পেশা, সমাজসেবা তার নেশা। তিনি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কিন্তু নিজের হাতে কাজ করতে তার দ্ধিধা বা সংকোচ নেই।” বইতে লেখক আরও উল্লেখ করেন “এদেশে সড়ক পরিবহন উন্নয়নকল্পে তার চিন্তাধারা যে সমসাময়িক সমস্যাবলী সমাধানকল্পে খুবই কার্যকর ও প্রগতিশীল তা সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে স্পষ্টভাবে বুঝা গেল।”
আমার চোখে সফল ব্যবসায়ী বাবার মধ্যে ছিল অসাধারণ মানবিক গুনাবলী ও উদারতা যা দেখে থমকে যেত আমাদের গতানুগতিক চিন্তাভাবনা। এ ব্যাপারে একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি।
একদিন শুনি বাবার ব্যবহারের প্রাডো গাড়িটি খালি রোডে কিভাবে যেন বড় একটা এক্সিডেন্ট করেছে। জানা গেল ড্রাইভারের কোন আঘাত না হলেও গাড়ির অনেক ক্ষতি হয়েছে। পরে গাড়িটি বাড়ির আঙ্গিনায় আনা হলে বাবার সাথে আমিও গেলাম দেখতে। ড্রাইভার পাশেই হাঁটাহাঁটি করেছে। গাড়ির অবস্থা দেখে খুব কষ্ট পেলাম। সুন্দর গাড়িটি বিভিন্ন দিকে দেবে গিয়েছে। “ইস গাড়ির অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে” আমি এটা বলতেই দেখলাম বাবা আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে থাকালেন। বাবার চোখে মুখে কোন কষ্ট, ক্ষোভ বা আফসোস নেই। বরং আস্তে করে গভীর আন্তরিকতার সাথে বললেন “থাক শুকরিয়া যে আল্লাহ ড্রাইভারকে নিরাপদে রেখেছে।”
বাসায় বাবা ব্যবসায়িক আলোচনা ওভাবে না করলেও ছোট বেলা থেকে যতটুকু বুঝতাম, মনে হতো বাবার ব্যবসা সব সময় অতটা সহজ ছিল না। মাঝে মাঝে মনে হতো কিছুটা জটিলতা যাচ্ছে। কেউ হয়ত ঠকাচেছ। কিন্তু কোনদিন এজন্য বাবার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া, উদ্বেগ বা হতাশা দেখিনি। দেখেছি একাগ্র মনে ব্যবসা চালিয়ে যেতে। এট্ওা হয়ত বাবার সাফল্যের অন্যতম একটি কারণ।
জীবনে আপাত দৃষ্টিতে সফলতা হয়ত অনেকভাবেই সম্ভব। কিন্তু নীতি, আদর্শ ও সততার পথে থেকে প্রকৃত সফলতা অনেক বড় ও অনেক আনন্দের একটি অর্জন। ২০১৭ সালে ইন্তেকাল করা বাবা আলহাজ এস এম শফির এই অর্জনই বাবাকে অমর করে রাখুক তার গড়া প্রতিষ্ঠান সফি মোটর্স লি.- এর উত্তরোত্তর সাফল্য ও সমৃদ্ধি। এজন্য সকলের দোয়া কামনা করছি।

লেখক : প্রফেসর, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট