চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পরিবেশসম্মত নিরাপদ শিল্প

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ২:৫৭ অপরাহ্ণ

মোহাম্মদ আলী শাহীন

চায়না এবং তুরস্কের মতো দেশগুলোকে অনুসরণ করে পরিবেশসম্মতভাবে জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলার দিকে নজর দিচ্ছে বাংলাদেশ। পরিবেশসম্মত ও নিরাপদ উপায়ে জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণে আন্তর্জাতিক নীতিমালা হংকং কনভেনশনের আলোকে গ্রিন ইয়ার্ড তৈরির মাধ্যমে আধুনিকায়নে নামছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ইয়ার্ড মালিকেরা। হংকং কনভেনশন হলো, নিরাপদ ও পরিবেশসম্মত জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ নিশ্চিত করতে আইএমও (ইন্টারনেশনাল মেরিটাইম অরগানাইজেশন) কর্তৃক প্রণীত একটি আন্তর্জাতিক নীতিমালা। বাংলাদেশ সরকার জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ আইন-২০১৮ প্রণয়ন করেছে এবং এই আইন প্রতিপালনে সরকার জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বিধিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে।

আধুনিকায়নে সচেষ্ট হওয়া সত্ত্বেও এখনো শিপ ইয়ার্ডগুলোতে পরিবেশ দূষণ ও শ্রমিক হতাহতের ঘটনা ঘটছে। আর বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গ্রিন ইয়ার্ডের সংখ্যা বাড়লেও বাংলাদেশে এ সংখ্যা মাত্র একটি। জাহাজভাঙা ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের একটি বড় সমস্যা হলো এই শিল্পের অধিকাংশ কারখানায় দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। যার কারণে এ শিল্পের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া এই শিল্পে গত ১৫ বছরে দুর্ঘটনায় ২২৫ জনের অধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরে ১১ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। বছরওয়ারি শ্রমিকদের প্রাণহানির সংখ্যাই এই শিল্পের ঝুঁকির পরিমাণ নির্দেশ করে দেয়।  বছরের পর বছর ধরে দুর্ঘটনার বিশ্লেষণ করার পরে জানা যায়, জাহাজপুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে দুর্ঘটনাগুলোর প্রধান কারণ হলো জাহাজের বিস্ফোরক পদার্থের মিসহেন্ডেলিং এর ফলে বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে জাহাজে সৃষ্ট বিপজ্জনক ও বিষাক্ত পদার্থে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে, কোন সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া কর্মরত অবস্থায় লোহার আঘাতে বা জাহাজের উচ্চতা থেকে পড়ে গিয়ে হতাহত হওয়া।

অন্যদিকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন শিপ ইয়ার্ডে পরিবেশ আইন ভঙ্গের কারণে এবং অকার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ভাঙার জন্য আমদানিকৃত এই সকল পুরনো জাহাজগুলির বিচ্ছিন্নকরণ একটি জটিল প্রক্রিয়া তাই বৈজ্ঞানিক উপায়ে জাহাজভাঙা সম্পন্ন হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ শিপ ইয়ার্ডে পরিবেশ সুরক্ষা, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্যের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থার অভাব, সীমিত স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসন এবং শ্রম কল্যাণের অনুপস্থিতি অধিকাংশ শিপ ইয়ার্ডের শ্রমিকদের দুর্দশা আরো বাড়িয়ে তোলে।

তবে আশার কথা হলো, কয়েকজন প্রগতিশীল মালিক এই শিল্পের ভাবমূর্তি পরির্বতনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা শুরু করেছেন এবং একটি ইয়ার্ড ইতোমধ্যে গ্রিন ইয়ার্ড হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। হংকং কনভেনশন কমপ্লায়েন্সের জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির সনদ (সার্টিফিকেট অব কমপ্লায়েন্স) লাভ করেছে। আরও কয়েকটি শিপ ইয়ার্ড মালিক সেই পথ অনুসরণ করছে।

জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণে শিল্পের সার্বিক উন্নয়ন, শ্রম নিরাপত্তা এবং পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চতকল্পে নিম্নোক্ত কিছু মতামত বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের সম্ভাবনাময়ী এই শিল্পের পরিবেশগত উন্নয়নে প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব, যথাযথ দিক নির্দেশনা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে কার্যকরি কারিগরি সহযোগিতা। সেই লক্ষ্যে হংকং কনভেনশন এবং দেশীয় সকল আইনের আলোকে এই শিল্পের উন্নয়নে সরকারের পক্ষ হতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা বজায় রাখতে হবে। শিপ ইয়ার্ড ভিত্তিক কার্যকরি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সরকারের উচ্চ পর্যায় হতে প্রতিনিয়ত পরিদর্শন এবং তদারকি করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ আইন ২০১৮-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হলো ÔSRFP (Ship Recycling Facility Plan) (শিপ ইয়ার্ড ভিত্তিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা) যেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা কিংবা সাগরে কোন রকমের বর্জ্য বিশেষ করে কালো তেল বা অন্যান্য তরল বর্জ্য নিক্ষিপ্ত হচ্ছে কিনা তা মনিটরিংয়ের জন্য দক্ষ পরিদর্শক দল গঠন করা যেতে পারে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, গণমাধ্যম ও গবেষকদের পরিদর্শক দলের অন্তর্ভুক্ত করা গেলে পরিদর্শক দল আরও বেশি সক্রিয় হতে পারবে বলে আমরা মনে করি। এই শিল্পের সার্বিক কজের সমন্বয়ে সরকার চট্টগ্রামে  One Stop Service  নামে একটি কেন্দ্র চালু করতে পারে। এতে জাহাজ আমদানির অনুমতি হতে শুরু করে সকল বিষয়ে দাপ্তরিক কার্যক্রম দ্রুত সুরাহা করা অনেক সহজতর হবে। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে এই শিল্পে যে কোন ধরনের বিধি লঙ্ঘন বা অঘটনের জন্য সরকারের পক্ষ হতে দ্রুত ও কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। আর পরিবেশ সুরক্ষায় বাসেল কনভেনশন (বর্জ্যের বৈশ্বিক স্থানান্তর নিয়ন্ত্রণজনিত সনদ) এবং হংকং কনভেনশনের কমপ্লায়েন্স মেনে এবং উত্তমমানের ক্লাসিফিকেশন এজেন্সি কর্তৃক জাহাজের ক্ষতিকারক বর্জ্যরে (আইএইচএম-ইনভেন্টরি অব হেজারডেজ ওয়েস্ট) তালিকা প্রণয়ন করার শর্ত মেনে চললে পরিবেশের প্রতি ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পেতে পারে। সরকার ইতোমধ্যে শিপ ইয়ার্ডের  বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে টিএসডিএফ (ট্রিটমেন্ট স্টোরেজ ডিসপোজাল ফ্যাসিলিটি স্থাপনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকারের পক্ষ হতে টিএসডিএফ স্থাপন দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত।

গ্রিন ইয়ার্ড গড়ায় উৎসাহিত করার লক্ষ্যে যে সকল স্ক্র্যাপ ইয়ার্ড পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে জাহাজভাঙা কার্যক্রম পরিচালনা করবে, সে সকল স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডকে প্রণোদনাস্বরূপ TEX HOLIDAY/Green Benefit   এর আওতায় এনে উৎসাহ প্রদান করা যেতে পারে। এতে অন্যরাও পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে উদ্যোগী হয়ে উঠতে পারে। হংকং কনভেনশন কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট প্রদানে সাব-স্ট্যান্ডার্ড ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি বা অখ্যাত কোন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সার্টিফিকেট দেয়ার প্রবণতা যেন তৈরি না হয় সে ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট প্রদানের ক্ষেত্রে অবশ্যই উন্নতমানের তথা ইউরোপীয় বা জাপান কেন্দ্রিক ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি সমূহকে ব্যবহার করতে মন্ত্রণালয়ের জোরালো ভূমিকা রাখা উচিত বলে মনে করি।

শ্রমিক সুরক্ষায় ইয়ার্ডে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি যেমন, উইনঞ্চ মেশিনের ওয়্যার/ক্যাবল, ক্রেন, ক্রেন এর ওয়্যার, টাওয়ার ক্রেন, গ্যাস ডিটেকশন মিটারগুলোসহ প্রত্যেক সরঞ্জামের মান নিয়মিত সুনামধন্য মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরীক্ষা করাতে হবে এবং বেস্ট প্রেকটিস্ধসঢ়;ড থার্ড পার্টি অডিট কর্তৃক নিয়মিত তদসংক্রান্ত সেইফ ওয়ার্কিং লোড ভেলিডেটি সনদ নিশ্চিত করতে হবে। এই সকল বিষয় তদারকিতে শিপ ইয়ার্ডগুলোতে সুযোগ্য সেইফটি অফিসার নিয়োগ করতে হবে। ম্যান এন্ট্রি ফর হট ওয়ার্ক এর জন্য ইয়ার্ডের সেইফটি অফিসাররাই দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকবে। জাহাজ ভিত্তিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা অনুযায়ী কোন স্পটে ঝুঁকি বা হট স্পট আছে তা চিহ্নিত করা সেইফটি অফিসারদেরই দায়িত্ব হওয়া উচিত। সেইফটি অফিসারদের NEBOSH সনদপ্রাপ্ত বা সরকারিভাবে অনুমোদিত প্রশিক্ষণকেন্দ্র হতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলে শিপ ইয়ার্ডে ঝুঁকি হ্রাসে তারা সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারবে। দেশীয় সকল নিয়মনীতি মেনে জাহাজ কাটার কাজ করা হচ্ছে কিনা তার জন্য জাহাজের টেংক বিভাজনের সকল পর্যায়ের ছবি এবং ভিডিও এর মাধ্যমে ডকুমেন্টেড করে রাখা উচিত যাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়া হচ্ছে কিনা তা যাচাই বা পর্যবেক্ষণ করা যায়। এটা দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনের লক্ষ্যে সকল ইয়ার্ডকে সার্বক্ষণিক সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আনা যেতে পারে। শ্রমকল্যাণ বিবেচনায় রেখে দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ পরিমাণ বৃদ্ধি করা উচিত।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় কর্তৃক নির্দেশনা এবং জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বিধিমালায় (২০১১) দুর্ঘটনায় শ্রমিক নিহত হলে নিহত শ্রমিকের পরিবারের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের কথা বলা আছে আর অন্য দিকে শ্রম আইনের সর্বশেষ সংশোধনীতে আছে দুই লক্ষ টাকা। সেই হিসেবে (৫+২) সাত লক্ষের সাথে বর্তমান দ্রব্যমূল্য বিবেচনায় রেখে মোট ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার মতামত পোষণ করছি। দুর্ঘটনায় শ্রমিক শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে গেলে বা অঙ্গহানি হলে বা বিস্ফোরণের আগুনে ১০% এর অধিক পুড়ে গেলে বা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়লে বা দুই-এর অধিক অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে আহত শ্রমিককে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার মতামত পোষণ করছি।

জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ তথা নিরাপদ উপায়ে জাহাজ বিচ্ছিন্নকরণ, বর্জ্যরে সঠিক চিহ্নিতকরণ, অবমুক্তকরণ ও নিষ্পত্তি করার আন্তর্জাতিক ও উন্নত নানা মডেল রয়েছে যা ইয়ার্ড মালিক, যথাযথ কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডাররা গাইডলাইন হিসেবে মেনে চলতে পারে। স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বিবেচনায় রেখে নিরাপদ, শ্রমিক ও পরিবেশবান্ধব একটি শিল্প হিসেবে জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকে গড়ে তুলতে হলে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনদের নিয়ে কাজ করার কোন বিকল্প নেই।

লেখক : সমন্বয়ক, ইপসা

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট