চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সিন্ডিকেটেই ধস চামড়ায়

ইফতেখারুল ইসলাম

২৫ জুলাই, ২০২১ | ১১:২৯ পূর্বাহ্ণ

ফটিকছড়ি পৌরসদরের বাসিন্দা মাবুদ অর রশিদ চৌধুরী কোরবানির ঈদের দিন কোন ক্রেতা না পেয়ে প্রায় ৪০ বর্গফুটের একটি গরুর চামড়া এতিমখানায় দান করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এতিমখানা কর্তৃপক্ষ এসে চামড়া নিয়ে যেতে রাজি হয়নি। কারণ তারা ওই চামড়া বিক্রি করে রিকশা ভাড়া তুলতে না পারার আশঙ্কায় ভুগছিল। শেষ পর্যন্ত নিজের পকেট থেকে ১০০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে তিনি চামড়াটি ওই এতিমখানায় পৌঁছে দেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এক দশক আগে এই আকারের চামড়া ১৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। মূল্যস্ফীতির কারণে এখন এই চামড়ার দাম তিনগুণ হওয়ার কথা ছিল। সেই চামড়া এখন মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। চামড়া নিয়ে এই ভোগান্তি শুধু তার ছিল না। অধিকাংশ কোরবানিদাতা এই সমস্যায় ভুগেছেন।
তবে আড়তদার এবং ট্যানারি মালিকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা না থাকা এবং দেশীয় বাজারে করোনার কারণে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা একেবারেই তলানিতে থাকার কারণে কাঁচা চামড়ার চাহিদা কমে গেছে। যে কারণে দাম পড়ে গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজিতে এবারও কোরবানির কাঁচা চামড়ার সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর হয়নি। নানা কৌশলে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা পানির দরে কিনে নিয়েছেন চামড়া। বর্গফুটে নয়, এবার কোরবানির চামড়া বিক্রি হয়েছে প্রতিপিস হিসেবে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের তেমন দেখা না পেয়ে শেষ মুহূর্তে বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসায় নিজ খরচে চামড়া পৌঁছে দিয়েছেন কোরবানিদাতারা। যারা বিক্রি করতে পেরেছেন তাও নামমাত্র মূল্যে। প্রতিটি চামড়ার দাম ২০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকা। কেউ কেউ কোথাও দান করতে না পেরে মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত মনিটরিং টিমের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ চা বোর্ডের উপসচিব রুহুল আমিন এবার চট্টগ্রামে চামড়া নষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটেনি উল্লেখ করে বলেন, টিমের লক্ষ্য ছিল চামড়া যাতে কোনভাবেই নষ্ট না হয়। ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি যে পর্যায়েরই ব্যবসায়ী হোন কেন, টিম চেয়েছে তারা যেন চামড়া হুড়োহুড়ি করে বিক্রির চেষ্টা না করে লবণজাত করে। লবণজাত না করলে রাত ১০টার মধ্যে চামড়া বিক্রি করতে হয়। কিন্তু লবণ দিলে তার মেয়াদ আড়াই থেকে তিন মাস পাওয়া যায়। তখন দাম ধরে চামড়া বিক্রির সুযোগ মিলবে। চামড়ার দাম ধরে রাখতে হলে অবশ্যই ইউনিয়ন পর্যায়ে চামড়া লবণজাত করতে হবে। এক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও মনিটরিং করতে পারেন। চামড়ার ক্ষেত্রে একটিই সমস্যা, কোরবানির দিনেই চামড়া বিক্রি করতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে চামড়া লবণজাত করলে আড়তদাররা ট্রাক নিয়ে চামড়া কিনতে যেতে বাধ্য হবে। তিনি জানান, চট্টগ্রাম জেলায় এবার ৩ লাখ ১ হাজার ২৫০টি চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। তার মধ্যে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৫০টি গরুর চামড়া এবং ২৫ হাজার ২০০টি ছাগলের চামড়া। গতবার চামড়া সংগ্রহ হয়েছিল ৩ লাখ ৫৬ হাজার। গতবারের চেয়ে এবার ৫৪৭৫০টি চামড় কম সংগ্রহ হয়েছে। করোনা মহামারীর কারণে এবার কোরবানিদাতার সংখ্যা কিছুটা কমেছে। তাই চামড়া সংগ্রহ কমেছে।
জানতে চাইলে রিফ লেদার লিমিটেডের পরিচালক মোখলেছুর রহমান পূর্বকোণকে বলেন, তারা এবার লাখ খানেক চামড়া কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। তবে কোরবানির দিন প্রায় ছয় হাজার চামড়া তারা কিনে লবণ দিয়েছেন। চামড়ার দাম ট্যানারি মালিকদের উপর নির্ভর করে না। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম কম। সমস্যা হচ্ছে চাহিদার উপর। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় দেশীয় বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। কারণ অধিকাংশ চামড়া ট্যানারি থেকে বিদেশে রপ্তানি হয়। অতীতে দেড়-দুই হাজার টাকায় চামড়া কিনেও লাভ হয়েছে। এখন ৭০০ টাকায় কিনেও লোকসান হচ্ছে। কারণ চামড়ার চাহিদা নেই। জুতার দোকান বন্ধ। কোম্পানিগুলো মার খাচ্ছে। চামড়ার দাম কমার অনেকগুলো কারণ আছে। পরিস্থিতি ভাল হবে এই আশায় তারা চামড়া কেনার মনস্থির করেছেন উল্লেখ করে বলেন, ভাল চামড়া সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশি দামে কিনেন। মান ভাল না হলে মূল্য দিতে পারি না। দাম নির্ভর করে চামড়ার মানের উপর।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম চামড়া আড়তদার সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিম বলেন, কোরবানির রাতে আড়তে এসেছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৫০০টি চামড়া। বাকি চামড়াগুলো গ্রামে আছে। এবার চামড়া পঁচেনি উল্লেখ করে বলেন, অনেকেই কেন বিক্রি করতে পারেননি তা তার বোধগম্য নয়। কিছু মানুষ দাম নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায় উল্লেখ করে বলেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অতি অল্পদামে চামড়া কিনে গলির মোড়ে বিক্রি করে। সেখান থেকে মাঝারি ব্যবসায়ীরা প্রধান সড়কে এনে চামড়া বিক্রি করেন। প্রধান সড়ক থেকে ট্রাকে করে আড়তে বিক্রি করেছে। আড়তে তারা ২৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় চামড়া কিনেছেন জানিয়ে বলেন, এক সময় দুই হাজার টাকায়ও তারা চামড়া কিনেছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা কমে গেছে। তাছাড়া কেমিকেলের দাম কয়েকগুন বেড়ে গেছে। এসব কারণে দাম কমে গেছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কোরবানিদাতাদের বিভ্রান্তি করে চামড়া হাতিয়ে নিয়েছে উল্লেখ করে বলেন, চার হাত ঘুরে চামড়া আসছে। আড়তদাররা ঠিকই মূল্য পরিশোধ করছে। সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে তা হল লবণযুক্ত। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়ায় লবণ না দিয়েই নিয়ে আড়তে আসে। চামড়ায় লবণ দেয়া, লেজ-কান পরিষ্কার করাসহ নানা খরচ আছে। ট্যানারিতে বিক্রি করতে গেলে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাদ দেয়। এসব বিষয় মাথায় রেখে চামড়া কিনতে হয়। তিনি দাবি করেন, চট্টগ্রামে আরো কয়েকটি ট্যানারি থাকলে অধিকাংশ চামড়া এখানে বিক্রি হত। চট্টগ্রামে কয়েকটি ট্যানারি চালু করার সুযোগ দেয়ার দাবি জানান তিনি। লকডাউন খোলার পর ঢাকায় চামড়া বিক্রির উদ্যোগ নেবেন উল্লেখ করে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সেই দামে বিক্রি করতে পারলে সামান্য লাভ হবে।

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট