চট্টগ্রাম বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

সন্দ্বীপে প্রতারণার শিকার ৫ হাজার মানুষ

নরোত্তম বনিক, সন্দ্বীপ

২ মার্চ, ২০২১ | ২:২৩ অপরাহ্ণ

রীমা ও রুমা দুজন সন্দ্বীপ উপজেলার দীর্ঘাপাড় তালুকদার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্রী। দুই বছর আগে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সন্তোষপুর ইউনিয়নের বেড়ীবাঁধের ঝুপড়ি ঘর ছেড়ে দীর্ঘাপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে বসবাস শুরু  করেছে। নতুন বছরের শুরুতে তাদের স্কুল থেকে উপবৃত্তির টাকা পাওয়ার জন্য অভিভাবকের মোবাইল নাম্বারসহ বিকাশ নাম্বার আনতে বলে। মেয়েদের উপবৃত্তির টাকা নিজের মোবাইলে পেতে তাদের মা নিজের নামে সীমকার্ড কিনতে দোকানে যায়। সেখানেই বাঁধে বিপত্তি।

দোকানী জানায়, তার জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ১৫টি সিমকার্ড রেজিস্ট্রেশন করা আছে। এই পরিচয়পত্র দিয়ে নতুন সিমকার্ড নেওয়া সম্ভব নয়। দোকানীর কথা শুনে অবাক হয়ে যায় রীমা-রুমার  মা। তিনি তো সীমকার্ড রেজিস্ট্রেশন করা দূরের কথা, এপর্যন্ত মোবাইলের কোন সীমকার্ড কিনেননি। একই আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা জোসনা বেগমের নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে একটি  সিমকার্ড কিনেছিলেন। আরেকটি সিমকার্ড কিনতে গিয়ে জানতে পারেন তার নামে বিভিন্ন অপারেটরের ১৫ টি সীমকার্ড রেজিস্ট্রেশন করা আছে। বাকী ১৪ টি সীমকার্ড কোথায় আছে এবং কারা ব্যবহার করছেন তিনি তা জানেননা।

এমনকি তার জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে কে বা কারা সীমকার্ড রেজিস্ট্রেশন করেছেন তাও তিনি বলতে পারবেন না। বিষয়টি জানাজানি হলে তাদের সাথে বসবাস করা আশ্রয়ণ প্রকল্প ও তার আশপাশের এলাকার বেশীরভাগ মানুষ যাচাই করে দেখেন তাদের প্রত্যেকের একই সমস্যার শিকার। দীর্ঘাপাড় ইউনিয়নের রীমা-রুমার মা এবং জোসনা বেগমের মতো সন্দ্বীপের আরো কয়েকটি ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষের সাথে একইরকম ঘটনা ঘটেছে। উপজেলার প্রায় ৫ হাজার মানুষের নামে ৫০ হাজারের বেশি সীমকার্ড প্রতারণার মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। সংঘবদ্ধ কয়েকটি  প্রতারক চক্র ভূমিহীন ও নিম্ন্বিত্তের লোকজনকে টার্গেট করে  ত্রাণ দেওয়ার  অজুহাতে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও আঙ্গুলের ছাপ নেওয়ার মাধ্যমে এই প্রতারণা করেছেন।

২০১৮ সালে সন্দ্বীপের বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন উরিরচরে সন্দ্বীপ ও নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উভয় অংশের প্রায় ৫ হাজার মানুষের কাছ থেকে বশর  ভান্ডারী ও তাজন মাঝিসহ একটি সিন্ডিকেট প্রতারণার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র ও আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করে। তারা  চরের ভূমিহীন ও নিম্নবিত্তদের লাইনে দাঁড় করিয়ে ২ কেজি আলু ও ১ কেজি আটা দিয়ে আঙ্গুলের ছাপ ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নেয়। একইভাবে সন্দ্বীপের সন্তোষপুর ইউনিয়নের কেফায়েত উল্লা চাউল, আটা, ভোজ্য তেল, আলু দিয়ে  সন্তোষপুর, কালাপানিয়া, গাছুয়া, আমানউল্ল্যা ইউনিয়নের নিজের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার মানুষের সাথে প্রতারণা করে। বশর ভা-ারী ও তাজন মাঝির সাথে কেফায়েতের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। কেফায়েত ও সিন্ডিকেটের বাকি সদস্যরা প্রায়সময় উরিরচর আসা যাওয়া করতে দেখা গেছে।

সম্প্রতি সন্তোষপুর ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের বেড়িবাঁধ এলাকার জেলেপাড়ায় ভুক্তভোগী লোকজন নতুন সিমকার্র্ড কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হওয়ার বিষয় জানতে পারেন। তারা একত্রিত হয়ে বিক্ষোভ করে। ভুক্তভোগীরা জানান, ত্রাণের নামে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারণা করে  কেফায়েত ও সিন্ডিকেটের সদস্যরা তাদের থেকে  জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি ও আঙ্গুলের ছাপ নেয়। পরবর্তীতে আরো বেশি সরকারি সহযোগিতা আসলে তখন যাতে ঝামেলা না হয় সেজন্য তাদের আঙ্গুলের ছাপ নেওয়া হয়েছে বলে তাদের জানানো হয়েছিল।

কেফায়েত নিজেকে মানবাধিকার কর্মী হিসাবে পরিচয় দিত। প্রতারণার বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর থেকে কেফায়েত পলাতক রয়েছে।  ত্রাণের নামে প্রতারণার বিষয় আঁচ করতে পেরে ২০১৮ সালে উরিরচরের কয়েকজন সচেতন মানুষ তার প্রতিবাদ করে। বশর ভান্ডারী ও তাজন মাঝিকে উরিরচর ২ নং ওয়ার্ডে এসব কার্যক্রমে বাধা দিলে তারা ৩ নং ওয়ার্ডের গিয়ে প্রতারণার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। তাদের ধরে পুলিশের কাছেও হস্তান্তর করা হয়। তবে প্রতারক চক্রের পেছনে থাকা অদৃশ্য শক্তির কারণে তারা প্রতিবারই পার পেয়ে যায়। তাদের এসব অবৈধ কর্মকান্ডে একজন চেয়ারম্যান ও কয়েকজন মেম্বার সরাসরি উপস্থিত ও জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগীরা। বশর ভান্ডারী বর্তমানে উরিরচর সমবায় সমিতি নামে একটি সমিতির সভাপতি।

দীর্ঘাপাড় আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা ভুক্তভোগী মো. কামাল জানান, সরকারি সাহায্য দেওয়ার কথা বলাতে আমি ভোটার কার্ড আর আঙ্গুলের ছাপ দিয়েছি। তারা আধা কেজি  ডাল, আধা লিটার সয়াবিন তেল, ১ কেজি পিয়াজ আর ২ কেজি আলু দিয়েছে। আমার স্ত্রী বিবি ফাতেমাসহ আমরা বেড়ীবাঁধের সবাই ত্রাণ নিয়েছি।

প্রতারণার শিকার একজন মহিলা তার নামে রেজিস্ট্রেশন করা ১৪টি অজ্ঞাত মোবাইল নাম্বার উল্লেখ করে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর সন্দ্বীপ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। সন্তোষপুর ২ নং ওয়ার্ডের ভুক্তভোগী লোকজন ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে কেফায়েতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। পরবর্তীতে সন্দ্বীপ থানায় একটি প্রতারণা মামলা দায়ের করেন।

একই উদ্দেশ্যে কৌশল পাল্টে কালাপানিয়া ২ নং ওয়ার্ডের মো.জাবেদ তার চাচাতো ভাই শাহাদাতসহ একটি চক্র আমানউল্লা ইউনিয়নের বাসিন্দাদের সাথে প্রতারণার চেষ্টা করে। তারা আল খায়ের ফাউন্ডেশন নামে কোন এক এনজিওর নামে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য আসা ত্রাণ সামগ্রী ও শিক্ষাবৃত্তি দেওয়ার কথা বলে মাথাপিছু দেড় হাজার টাকা, জাতীয় পরিচয়পত্র ও আঙ্গুলের ছাপ নেওয়ার পাঁয়তারা করে। বিষয়টি আমানউল্ল্যা ইউপি চেয়ারম্যান শাহাদাত চৌধুরীর নজরে আসলে তিনি কৌশলে প্রতারকচক্রের হোতা জাবেদকে গ্রাম পুলিশ দিয়ে ধরে সন্দ্বীপ থানায় হস্তান্তর করেন। কিন্তু অদৃশ্য কারণে জাবেদ কিছুক্ষণের মধ্যে থানা থেকে বেরিয়ে আসেন। আমানউল্ল্যা ইউপি চেয়ারম্যান শাহাদাত চৌধুরী বলেন, যারা এসব প্রতারণা করছেন তারা লোকচক্ষুর  সামনেই করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে শুরুতে ব্যবস্থা নিলে এতগুলো মানুষ প্রতারণার শিকার হতেন না।

সন্দ্বীপ থানার ওসি বশির আহাম্মদ খান বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রতারণার অভিযোগে সন্দ্বীপ থানায় একটি প্রতারণা মামলা হয়েছে। আমরা আসামিকে ধরার জন্য কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করেছি।

প্রতারণার শিকার সন্দ্বীপের প্রায় ৫ হাজার মানুষের নামে ব্যবহৃত এসব সিমকার্ড  কে বা কারা ব্যবহার করছেন তা কেউই জানেন না। এমনকি এসব সিমকার্ড কোনো অপরাধমূলক কর্মকা-ের সাথে জড়িত কিনা সেই বিষয়েও তথ্য নেই। ভুক্তভোগী পরিবারের দাবি, তাদের নামে রেজিস্ট্রেশন করা এসব সিমকার্ড বন্ধ করে দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট