চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আওয়ামী লীগের ভোট গেল কই?

সাইফুল আলম

২৯ জানুয়ারি, ২০২১ | ১২:৩৬ অপরাহ্ণ

বিএনপি প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনকে প্রায় তিন লাখ ভোটে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ ভোটার হলেও ভোট পড়েছে মাত্র ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৫৪৩। প্রায় এক পঞ্চমাংশ অর্থাৎ ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ ভোটার এবারের চসিক নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা নির্বাচনের তিনদিন আগে চট্টগ্রামে এসে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকের পর ‘আশ্বস্ত’ হয়ে স্বভাবসুলভ দৃঢ়তায় বলেছিলেন, চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন ‘ভাল’ হবে। সবাইকে উৎসবের মেজাজে ভোট দিতে আসার আহবান জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভোটদানের হারে মনে হচ্ছে, সিইসি’র কথায় ভোটাররা আশ্বস্ত হতে পারেননি। ভোটাররা ভোট দিতে আসেননি।

নির্বাচনে এত কম সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী নেতা- কর্মীর ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। নগরীর লালখান বাজার, ফকিরহাট, ফিরিঙ্গি বাজার, দক্ষিণ কাট্টলি, কোতয়ালীসহ অন্ততঃ আটটি কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা আওয়ামী লীগের প্রবীণ ও ত্যাগী বেশ কয়েকজন স্থানীয় নেতা- কর্মীর সঙ্গে আলাপকালে তারা ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার জন্য নেতা- কর্মীদের অতি আত্মবিশ্বাসকে দায়ী করেছেন। এছাড়া, জেতার জন্য কাউন্সিলর প্রার্থীদের অনাকাঙ্ক্ষিত নানা তৎপরতাও সমান দায়ী বলে মন্তব্য করেন।

লালখান বাজার এলাকার একটি কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ নেতা বলেন, ভোট দিতে কেন্দ্রে ঢোকার মুখেই কয়েকজন যুবক জিজ্ঞেস করে আমি নৌকার লোক কিনা। তাদেরকে আমার অপরিচিত মনে হয়েছে। ৪৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। আমাকে যদি প্রমাণ দিতে হয়, তাহলে আর যাব কোথায়! ফিরিঙ্গি বাজার এলাকায় আরেক আওয়ামী লীগ কর্মী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ভোটারদের ভোট দিতে উৎসাহ না দিয়ে কাউন্সিলর প্রার্থীদের কেউ কেউ যুবক বয়সীদের নিয়ে রাস্তার মোড়ে, অলি- গলিতে শো ডাউন করেছে। এ অবস্থা দেখে অনেকেই ভয়ে ভোট দিতে যান নি। আওয়ামী লীগ সমর্থক ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য যদি প্রার্থীদের মনযোগ থাকতো, তাহলে ভোটের পরিমাণ এত কম হত না।

বন্দর আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, সারাদিন কেন্দ্রে ছিলাম। আমার এলাকার এক চতুর্থাংশ আওয়ামী লীগ সমর্থক- পরিবারের ভোটারদেরও আমি ভোট কেন্দ্রে আসতে দেখিনি। ত্যাগী এমন অনেক আওয়ামী লীগ নেতা- কর্মীই ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাদের বক্তব্য, আওয়ামী লীগ নিঃসন্দেহে একটি বড় দল। তাদের কর্মী- সমর্থক ভোটাররা সবাই যদি ভোট দিত, তাহলেওতো ভোটদানের হার এত কম হওয়ার কথা নয়। কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ভোট পড়ার কথা। কিন্তু সাড়ে ২২ শতাংশ ভোট পড়ার হারে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, আওয়ামী লীগের ভোটাররাও ভোট দিতে আসেন নি।

মন্ত্রী ও নগর আওয়ামী লীগের নেতারা অবশ্য কম ভোট পড়ার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, করোনার পাশাপাশি বিএনপি ‘হাল ছেড়ে দেয়ায়’ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে ভোটদানের হার কম হয়েছে। গতকাল সচিবালয়ে ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের নতুন কমিটির নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এই মন্তব্য করে বলেন, ভোটার টার্নআউট কম হওয়ার প্রধান কারণ করোনা। দ্বিতীয়তঃ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলেও শেষের দিকে তারা হাল ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে ছিল। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্য বিএনপির যেভাবে মাঠে থাকা প্রয়োজন ছিল, সেভাবে তারা মাঠে ছিলেন না।

অন্যদিকে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচন নিয়ে বিএনপির ক্রমাগত নেতিবাচক প্রচারণার কারণে ভোট কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি কম ছিল বলে মন্তব্য করেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নেতিবাচক প্রচারণার কারণে তাদের লোকজন ভোট দিতে আসেননি। আবার যারা শান্তিপ্রিয় ভোটার তারাও আসেননি। নির্বাচনকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে বিএনপি বিভিন্ন কেন্দ্রে আমাদের কর্মীদের উপর হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

টিআইবি কেন্দ্রীয় পর্ষদ সদস্য ও নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামীলীগ নির্বাচনে বিজয়ী হতে চাইলেও বিএনপি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মতো তেমন কোন প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। যত প্রতিকূলতাই থাকুক বিরোধীদলকে জনসমর্থন নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। বিএনপি প্রার্থী শাহাদাত হোসেন যে নির্বাচন করেছেন সেখানে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটি কিংবা চট্টগ্রামের তেমন কোন নেতাকর্মীকে দেখা যায়নি। প্রধান বিরোধী দল হলেও বিএনপি তাদের কর্মীদের উৎসাহ দিয়ে ভোটকেন্দ্র্রমুখী করার উদ্যোগ নেয়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, মানসিকভাবে তারা আগেই হেরেছিল। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক অবস্থান থেকে নির্বাচনের ফলাফলের বিষয়ে মানসিকভাবে জ্ঞাত ছিল। যার কারণে সাধারণ ভোটাদের কাছে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি।

দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশন সাধারণ ছুটি ঘোষণা না করায় কিছু সংখ্যক ভোট কমে গেছে বলে আমার মনে হচ্ছে। অন্যদিকে, যানবাহন চলাচল সীমিত থাকার কারণে দূরবর্তী চাকরিজীবিদের হুট করে এসে ভোট দিয়ে আবার ফেরার মতো সুযোগ ছিল না। রাজনৈতিক বিবেচনায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে ‘মনোনীত প্রার্থী’ আর ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ এসব শব্দ ব্যবহার হয়েছে নতুন করে। বর্তমানে কাউন্সিলর পদটি অনেকের জন্য অনেক ক্ষেত্রে লাভজনক হওয়ায় মরিয়া হয়ে এ পদে বিজয়ী হওয়ার যে চেষ্টা, তার জন্য প্রত্যেক প্রার্থীর তরুণ কর্মীবাহিনীকে বিভিন্ন গলির মুখে দেখা গেছে। এক গলিতে যদি এক প্রার্থীর সমর্থক থাকে তাহলে অন্য প্রান্তে অন্য দলের সমর্থকের শো ডাউন দেখা গেছে। এতে সাধারণ ভোটাররা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আর কেন্দ্রমুখী হননি। আবার, নির্বাচনের দিন সকালে তিন-চারটি কেন্দ্রে হামলা- সংঘর্ষ এবং দু’টি প্রাণহানির ঘটনায় মানুষ ভীত হয়ে উঠে। এসব ঘটনা নির্বাচনে মানুষের উপস্থিতি কমাতে বেশ প্রভাব ফেলেছে।

পূর্রকোণ/ আরআর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট