চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রুখতে হবে ভাষা বিকৃতি

রোকেয়া হাসনাত

১০ মার্চ, ২০২০ | ২:৪১ পূর্বাহ্ণ

ভাষা আন্দো লনের রাজ নৈতিক মাত্রার যতটা বিস্তার ঘটেছে শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিকের ততটা প্রসার ঘটেনি। এমনকি বাংলা ভাষা চর্চার মান নিয়েও ইদানিং প্রশ্ন উঠেছে। নির্ভুল বাংলা লিখতে সক্ষম লেখক, সাংবাদিক খুঁজে পেতেও এখন কষ্টকর ব্যাপার।
ভাষা আন্দোলনের সোপান বেয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও এর শাসন ক্ষমতায় যখনই যারা এসেছে তারা সমাজে অধিপতি শ্রেণীর ভাষাই ব্যবহার করতে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন। এ কারণে সরকারী কাজকর্মে বাংলা ব্যবহারের চাপ থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘকাল যাবত বাংলার চাইতে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করার ঝোঁক বেশি লক্ষ্য করা যায়।
একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলা ভাষার ওপর সত্যিকারের দখল অর্জন করতে হলে সংষ্কৃতি, আরবি, ফার্সি এমনকি ইংরেজি ভাষায় জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। কারণ, এসব ভাষা গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে। এজন্য উপরোক্ত ভাষা সমূহের উপর স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের ভাল দখল না থাকলে বাংলা ভাষার শব্দ সম্ভাব সম্পর্কে বানান রীতি ও ব্যাকরণ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সম্যক ধারণা দেয়া কিভাবে সম্ভব? ভাষা আন্দোলনের পরে অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বয়স আটচল্লিশ পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষার নিজস্ব ব্যাকরণ পুনর্গঠন করার কোন উদ্যোগ আজো গ্রহণ করা হয় নি। বানানের ক্ষেত্রে যা চলছে তাতে তাকে স্বেচ্ছাচারিতা বললেও কম বলা হয়। প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সন্ধি, সমাস, কারক, বিভক্তি ইত্যাদি পড়ানো হলেও যারা পড়াচ্ছেন তারা এ বিষয়ে কতোটা অভিজ্ঞ তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বাংলা ভাষার এসব বিষয় মূলত সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ জানা না থাকলে বাংলা ভাষার এসব বিষয়ে ঠিকমতো জ্ঞানদান করা কঠিন। সংস্কৃত থেকে আগত বাংলা ভাষার ব্যবহৃত শব্দের ব্যুৎপত্তি জানার জন্য সংস্কৃত ভাষার জ্ঞান অপরিহার্য। বাংলা ভাষার জ্ঞান জীবিকা অর্জনে যথেষ্ট, ইংরেজির মতো সহায়ক নয় বলে উচ্চবিত্তদের দেখাদেখি এখন নি¤œবিত্তরা কষ্ট স্বীকার করে সন্তান-সন্ততিদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াতে বেশি আগ্রহ দেখান। এদেরকে দোষারোপ করে লাভ নেই। এরা হয়তো এখনো শিক্ষাকে বিত্তবান শ্রেনীর বিশেষ অধিকার হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত। তবে যারা সত্যিকার জ্ঞানী-গুণী, তারা স্বীকার করেন যে, শিক্ষার মান নির্ভর করে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমের উপর। এ মান তখনই বৃদ্ধি পায় যখন জ্ঞানের তৃষ্ণা মাতৃভাষায় মেটানোর সুযোগ থাকে। ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান, রাশিয়ান, চাইনিজ, জাপানিজ প্রমুখ উন্নত ও সভ্য জাতিসমূহে এ কারণেই মাতৃভাষায় পারদর্শী হয়ে অন্য ভাষা শিখেছে। কবি মধুসূদন দত্তের জীবন থেকেও আমরা এ ব্যাপারে শিক্ষা নিতে পারি।
এই পদ্মা-মেঘনা-যমুনার অবিরাম ভাঙ্গা গড়া বঙ্গোপসাগরের বুক থেকে উঠে আসা বিধ্বংসী ঝড় ঝঞ্ঝার সঙ্গে বোঝাপড়া এবং লড়াই করে বেঁচে থাকা মানুষের সুখ দুঃখের জীবন, তাদের স্বপ্ন আশা ও ভালোবাসার কথা আপন সৃজনী ক্ষমতায় তারা রূপ দিয়ে চলেছেন অন্যের অনুকরণে পারঙ্গমন হয়ে নিজের মুখের ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা করে তোলার ক্ষেত্রে তাদের সাহস ও স্বকীয়তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, বেগম সুফিয়া কামাল, শওকত ওসমান, ফররুখ আহমেদ, আহসান হাবীব, হাসান হাফিজুর রহমান, কথাশিল্পী সেলিনা চৌধুরী, আবু বকর ছিদ্দিক, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ুন আহমেদ প্রমুখের নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখই যথেষ্ট। ভাষা আন্দোলনের আবেগকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে যথাযথভাবে কাজে লাগানো গেলে মাতৃভাষা পড়তে ও লিখতে সক্ষম জনসংখ্যার শতকরা হার অতিক্রম করা যেতো। এখনো এ আবেগকে কাজে লাগাবার সুযোগ রয়েছে। এজন্য ভাষা আন্দোলনের পর লেখক-সাহিত্যিকদের উচিত ছিলো মধ্যযুগের পুঁথিগুলো গ্রন্থাকারে মুদ্রিত করা এবং সেই সঙ্গে বিদেশী গ্রন্থাকারে রক্ষিত আমাদের লেখকদের দুষ্প্রাপ্য রচনাগুলো এনে মুদ্রণের ব্যবস্থা করা। সাহিত্যের সমৃদ্ধ ইতিহাস তৈরীর স্বার্থে এই কাজটি খুবই জরুরী। কেননা, বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধ ইতিহাসের অভাব আমাদের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ। এদেশের ভাষা আন্দোলনের আবেগকে কাজে লাগিয়ে কবি-সাহিত্যিক লেখকদের জন্য এমন একটা আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং অনুকূল স্থিতিশীল অবস্থা তৈরী করা জরুরী, যে পরিবেেেশ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি উৎকর্ষের দিক দিয়ে শিখর স্পর্শী হতে পারে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট