চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিচার নেই, ছাত্রলীগের সংঘাত বাড়ছেই

চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় ষ ৪ মাসে ৩ তদন্ত কমিটি, ঝুলে আছে সবকটি। ষ ‘দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, সুপারিশমালা বাস্তবায়ন না করায় হানাহানি বাড়ছে’

রায়হান উদ্দিন হ চবি

৮ মার্চ, ২০২০ | ২:০১ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের একের পর এক সংঘাতের ঘটনা ঘটেই চলছে। এসব ঘটনায় দৃশ্যমান কোনো বিচার করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায়নি শাখা ছাত্রলীগকে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বরাবর তদন্ত কমিটি করা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। ফলে নিশ্চিত হয় না অপরাধীর শাস্তি। অপরাধীরা পায় আশকারা। নতুন করে লিপ্ত হয় সংঘাতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংঘাতের পর তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুসারে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং সংঘর্ষ এড়াতে সুপারিশমালা বাস্তবায়ন না করায় ক্যাম্পাসে হানাহানির ঘটনা বাড়ছে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই দায়ী করছেন তারা। সর্বশেষ বৃহম্পতিবার এক কর্মীকে মারধর করে জখম করাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়। এতে উভয় পক্ষের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছে। এসময় ছয় রাউন্ড ফাঁকা গুলি, পাঁচটি ককটেল বিস্ফোরণ করে ছাত্রলীগের কর্মীরা। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এ এফ রহমান হলের ৮৭টি রুম ভাঙচুর ও লুটপাট করে হামলাকারীরা। এর আগে তুচ্চ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার্চ মাসের প্রথম দিনেই সিএফসি ও সিক্সটি নাইনের কর্মীরা সংঘাতে জড়ালে উভয় গ্রুপের নয়জন কর্মী আহত হয়। এসময় উভয় গ্রুপের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্রের মহড়া দিতে দেখা যায়। ৪ মাসে ৩ তদন্ত কমিটি, ঝুলে আছে সবকটি : অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর গত চার মাসে ছাত্রলীগের সংঘাতের ঘটনায় তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ২০ জানুয়ারি আরএস ও সিক্সটি নাইনের পাল্টাপাল্টি হামলায় ছাত্রলীগের উভয় গ্রুপের ছয় কর্মী আহত হয়। এ ঘটনা তদন্তে গত ২৮ জানুয়ারি সহকারী প্রক্টর মুহাম্মদ ইয়াকুব ও রিফাত রহমানকে সদস্য করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এর আগে গত ১৩ জানুয়ারি ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক সংগঠন বিজয় ও সিএফসি গ্রুপের মারামারির ঘটনা তদন্তে সহকারী প্রক্টর আহসানুল কবীর পলাশ ও এএইচএম জিয়াউল ইসলামকে সদস্য করে কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া গেল বছরের ৫ ডিসেম্বর শহীদ আবদুর রব হলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ মারামারি, দুই ছাত্রলীগ নেতার ওপর দুর্বৃত্তের হামলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চারটি, প্রক্টরের একটি গাড়ি এবং জিরো পয়েন্টে ওয়াচটাওয়ার

ভাঙচুরের ঘটনায় এ কমিটি গঠন করা হয়। এতে পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. শ্যামল রঞ্জন চক্রবর্তীকে আহ্বায়ক, সহকারী প্রক্টর মো. আহসানুল কবীরকে সদস্য এবং তথ্য শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ হোসেনকে সচিব করে তদন্ত কমিটি এ করা হয়। তদন্ত কমিটিগুলোকে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও ৩টি তদন্তের সবকটি এখনো ঝুলে আছে।
সংঘাত-ভাঙচুরের বিচার কমিটি গঠনে সীমাবদ্ধ :
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দুই বছরে ছাত্রলীগের বগি ভিত্তিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ বেধেছে শতাধিক। রক্ত ঝড়েছে বহু শিক্ষার্থীর। এসব সহিংসতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে রুটিন কর্মসূচির মতো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষরও কিছু রুটিন কাজ রয়েছে। আর তা হলো প্রতিটি সংঘাতের পরই তদন্ত কমিটি গঠন করা। কিন্তু এসব তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন কখনও আলোর মুখ দেখে না। কদাচিৎ সংঘর্ষের পর কাউকে আটক করলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আবার আসামিরা জামিনে বেরিয়ে যায়। নতুন করে লিপ্ত হয় সংঘর্ষে।
বহিষ্কারাদেশে নিয়ে প্রশ্ন :
অভিযোগ উঠেছে, দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংগঠনগুলোর মাঝে কোন্দল চলে এলেও তা নিরসনে প্রশাসনের তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রশাসন অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চত না করে সমঝোতাকেই সমস্যা সমাধানের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে মারধরসহ কয়েকটি ঘটনায় জড়িতদের বহিষ্কার করতেও দেখা গেছে। তবে এসব বহিষ্কারাদেশের কার্যকারিতা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। বহিষ্কার হয়েও পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার নজির এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। তাছাড়া একটি সহিংসতার ঘটনায় বহিষ্কৃত নেতা বা কর্মী তার বহিষ্কারের মেয়াদ না ফুরাতেই ফের জড়িয়ে পড়েন আরেকটি সহিংসতায়। কিন্তু এসব বিষয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজর এড়িয়ে যায় প্রায়ই। ফলে নিশ্চিত হয় না অপরাধীর শাস্তি। শুধু গত দুই বছরই না, গত দুই যুগের ইতিহাস ঘাটলে এমন চিত্রই উঠে আসে।
বিশেজ্ঞরা যা বলছেন :
সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাইদুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন উপদলের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সহিংসতা এবং তাদের সঙ্গে প্রশাসনের আপোষ নতুন কিছু নয়। ছাত্রলীগের সঙ্গে প্রশাসনের সমঝোতা নতুন করে ছাত্রলীগকে আরও বেপরোয়া করবে এবং ভবিষ্যতে আরও তাদের সহিংসতায় প্রণোদনা দেবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই’।
তিনি বলেন, ‘অহরহ এইসব ঘটনায় একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা এবং শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে একটা ভয়ের সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের মানসজগতে ঢুকে যাচ্ছে। তাই বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে’।
যা বলছেন ছাত্র নেতারা :
এ বিষয়ে শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আশরাফী নিতু বলেন, ‘ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে কর্তৃপক্ষের তদন্ত কমিটিগুলো নাটকের জন্ম দেয়। এখন তা সকলের কাছেই এক সহজলভ্য, কমেডিতে পরিণত হয়েছে। অপরাধীদেরকে বারবার শাস্তির আওতায় থেকে মুক্ত করে তাকে পুনর্বার অপরাধ করতে উৎসাহিত করে তা কারো অজানা নয়। অপরাধীদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমঝোতা কেন? তা আমাদের মাথায় আসে না’।
সংঘাত না কমার বিষয়ে প্রশাসনের বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই দায়ী করছেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল। তিনি বলেন, ‘বিশ^বিদ্যালয়ে সিসি ক্যামরো আছে। সেগুলোর মাধ্যমে শনাক্ত করে প্রকৃত অপরাধীদর শাস্তি আওতায় আনলে এ ধরনের সংঘাত অনেকাংশে কমে যাবে’।
অপরাধীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের অবস্থান কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত, তাদের এখন পদ পদবি নেই। থাকলে আমরা তাদের বহিষ্কার করতাম। এ অবস্থায় প্রশাসনের কঠোর অবস্থানে যাওয়া দরকার’।
প্রশাসনের বক্তব্য :
বিশ^বিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান বলেন, ‘সর্বশেষ ছাত্রলীগের ঘটনায় কাল (আজ রোববার) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। এর আগে যে তিনটি তদন্ত কমিটি করেছি এর প্রতিবেদন দ্রুত সময়ের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়েছে। কিছু কৌশলগত কারণে প্রতিবেদন জমা দিতে দীর্ঘসূত্রিতা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এবার তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেবো। অপরাধী যে হোক কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না’।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট