চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

হিজড়া : এক অস্তিত্বের লড়াই

ফারহাত ইসলাম, তাশনিয়া মজুমদার দ্যুতি, মেঘা কানুনগো

১৬ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:৫২ পূর্বাহ্ণ

ব্যতিক্রম মানে ভিন্নতা, ভিন্নতা মানে ভয়াবহতা না। ভিন্নতা মানে বৈচিত্র, আদিকাল থেকে আমরা আদম আর হাওয়ার গল্প শুনেছি। মানুষের মনে এই ধারণা গেঁথে গিয়েছিল, মানুষ মানেই নারী এবং পুরুষ। কিন্তু, এই নারী আর পুরুষের সমন্বয়ে সৃষ্টিকর্তা যে এক আলাদা অস্তিত্বকে সৃষ্টি করেছে। সেই আলাদা অস্তিত্বকে মানুষ স্বীকৃতি দিতে আজ অপারগ। আমরা সবাই এই আলাদা অস্তিত্বকে ‘হিজড়া’ হিসেবে চিনি। কেড়ে নিয়ে খাওয়ার প্রবৃত্তির উদয় হয় অভাব থেকে। এমন অভাব না, যা পরে পাওয়ার আশা আছে, বরং এমন অভাব যা পূরণ হওয়ার কোনো আশাই নেই। আজকে আমাদের মানবাধিকার হতে বঞ্চিত করা হলে, আমরা জোর প্রতিবাদ জানাবে এবং আমাদের নিশ্চয়তা আছে অধিকার পাওয়ার। কারণ আমরা স্বীকৃত মানুষ। কিন্তু সে স্বীকৃতি সমাজ হিজড়াদের দেয়নি। এই কথা, আমরা কিংবা আপনার নয়, বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাৎকারে দেয়া হিজড়াদের করুণ স্বীকারোক্তি। এই দুনিয়ায় এতো ধর্ম, বর্ণ, গোত্র থাকতে পারলে একটি স্বীকৃত ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ থাকলে সমস্যা কোথায়?

একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হিজড়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি তার মাতা-পিতার প্রতি অসম্ভব কৃতজ্ঞ। কারণ জন্মের পর, তারা তাকে ফেলে দেন নি। তার পিতা-মাতা একজন স্বাভাবিক মানুষও তার মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য করেননি। কিন্তু, তিনি হতাশ ছিলেন এই জায়গায়, তিনি হিজড়া হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনভাবে এই পরিচয় নিয়ে বাঁচতে পারেননি। তিনি সমাজে পরিচিতি পেয়েছেন পুরুষ হিসেবে। কেননা, আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ ব্যতীত অন্য কোনো সত্ত্বার স্বাধীন স্বীকৃতি নেই। বাংলাদেশের হিজড়ারা সমাজে থাকা সত্ত্বেও সমাজ থেকে বিভিন্ন যেখানে যুগ এগিয়ে যাচ্ছে, যুগের সাথে নতুন নতুন কর্মবিভাজনের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, সেই দিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যায়, হিজড়াদের অন্য কোনো চাকরির সুব্যবস্থা নেই। নেই কোনো কোটার সুবিধা। অধিকাংশ হিজড়াদেরকে রাস্তায় টাকা খুঁজতে দেখতে পাওয়া যায়। এখনও এদেশে কোথাও কারো বাচ্চা হলে, হিজড়াদের ডেকে নিয়ে আসা হয় আর্শীবাদ দিতে। আমাদের সমাজে এই ধারণাটি গেঁথে গেছে যে, হিজড়াদের আর্শীবাদ পেলে যেমন কারো মঙ্গল হয়, ঠিক তেমনই অভিশাপ পেলে আমঙ্গলও হয়। এই মঙ্গল এবং অমঙ্গলের দ্বন্দ্বে, মানুষ নিস্তার পাওয়ার লক্ষ্যে টাকা দিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, তারা আমাদের সুনজরে না পড়লে ও কুনজর হতে রেহাই পায়নি। আমাদের সমাজে হিজড়ারা জাতিগতাবেই একটি ভীতির নাম। তাদের ছায়াও যেনো একটি ত্রাস। সেই ত্রাসের সুযোগ নিয়ে লুটপাটের উদ্দেশ্যে একদল সুযোগসন্ধানী লোক বড় বড় শপিংমিলে ঢুকে হিজড়ার ছদ্মবেশে আতংক সৃষ্টি করেছে। আর এর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে হিজড়াদেরকেই। তাই তাদের মতে সমাজ, তাদের কোনো সম্মান দেবে না। কিন্তু, তাদের নাম ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করবে এবং সে অর্থে হিজড়াদেরও কোনো হক নেই। তাদের হক শুধুমাত্র অসম্মান এবং বিরক্তিতেই। ভিক্ষুককে ভিক্ষা না দিতে চাইলে ও মানুষ এড়িয়ে যায়। কিন্তু হিজড়াদের ক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে। তাদের গায়ে হাত তোলে, তাদের মারধর করে, এমনকি যে এই বিষয়ে সম্পৃক্ত নয়, সে ও দূর থেকে পাথর ছুঁড়ে মারে। এটা শুধু মুদ্রার এক পিঠ। অপর পিঠের গল্পে দিনের আলোতে তারা অস্পৃশ্য, কিন্তু রাতের আঁধারে তারা সমাজে রাঘব-বোয়ালদের যৌন চাহিদার খোরাক। এখানেও একের পর এক তাদের নিয়ে ব্যবসা করা হয়। তাদেরও বাজারমূল্য আছে, যা একেবারে নগণ্য বললেই চলে। তাদের জীবন এমনই। ফুলকানা থাকা সত্ত্বেও পানির নিচে শ^াস নিতে বলা।

“পানিতে তো অক্সিজেন আছে। আর শ^াস নিতে তো এই লাগে।” অপারগতা এবং অক্ষমতা ব্যক্ত করে কোনো লাভ নেই, টিকে থাকতে হলে শ^াস বন্ধ রাখতে হবে, যতক্ষণ পারা যায়। যেহেতু তাদের জন্য কোনো দুয়ার খোলা নেই। তাই নিজেদের দুয়ার নিজেরাই তৈরি করে যাচ্ছে তারা। উদ্দেশ্য হেনস্তা বা বিরক্ত করা নয়, চূড়ান্ত উদ্দেশ্যে একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো মর্যাদা নিয়ে বাঁচা। তবে আশার কথা বাংলাদেশের দিগন্তে এক নতুন সূর্যের উদয় হয়েছে। সেই সাথে উন্মেষ ঘটছে এক নতুন ভোরের। বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে হিজড়াদের অধিকার বিষয়ে সচেতন হয়েছে। এদেরকে ‘তৃতীয় জেন্ডার’ হিসেবে ভোট দানের সুযোগ দিচ্ছে। হিজড়ারা বিধাতার সৃষ্টি। স্বয়ং বিধাতা যদি তাদেরকে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করে থাকেন তবে, আমি কিংবা আপনারাই বা কে তাদের সাথে অমানুষের মতো আচরণ করার। হিজড়ারা প্রতিনিয়ত তাদের বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছে। এই লড়াই শুধু তাদের একার নয়। এই লড়াই আমাদের সবার। কারণ অস্তিত্বের লড়াই কখনও একার হয় না। অস্তিত্বের লড়াই হয় সবার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট