চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

শিশুবিয়ে ও উন্নয়ন-প্রগতিতে এর কুপ্রভাব

নারগিস সুলতানা

১ নভেম্বর, ২০২০ | ২:৩৩ অপরাহ্ণ

কোভিড ’১৯ এবং সামাজিক অস্থিরতা বাল্যবিয়ে ত্বরান্বিত করছে। বাল্যবিয়ে বাংলাদেশের একটি সামাজিক ব্যধি হিসেবে চিহ্নিত। ব্রিটিশ আমলে ১৯২৯ সালে এ সংক্রান্ত আইনে বলা হয় মেয়েদের বিবাহযোগ্য বয়স ১৪ এবং ছেলেদের ১৮। যদিও সে সময় আইন ও বিচারব্যবস্থা অসাম্প্রদায়িক নীতির ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এর পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক আইনকেও অক্ষুন্ন রাখা হয়। পরবর্তীতে বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত বহু আইন পরিবর্তিত, সংশোধিত, পারিমার্জিত হয়েছে।

সর্বশেষ বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ রোধ আইন ২০১৭ পাস হয়। তাতে বলা হয়, বিয়ের ন্যূনতম বয়স বরের ক্ষেত্রে ২১ আর মেয়ের ক্ষেত্রে ১৮। কিন্তু  এ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাল্যবিবাহ চলছে। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর প্রতিকার, প্রতিরোধ হচ্ছে তা শিশুবিয়ের পরিসংখ্যানের তুলনায় অত্যন্ত কম।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফ গত বছরের মার্চ মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বাংলাদেশের শতকরা ৫৯ শতাংশ কিশোরী তাদের ১৮ বছরে পৌঁছানোর আগেই বিয়ে হয়ে যায়। আর ১৫ বছরে পৌঁছানোর আগেই বিয়ে দেয়া হয় ২২ শতাংশ কিশোরীকে। চলতি বছর বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে বাল্যবিয়ে হয় নয়জনের এবং বাল্যবিয়ের হাত থেকে রক্ষা পায় ৪৮ জন কিশোর-কিশোরী। এ তো গেলে কাগজে-কলমের কথা। এর বাইরে হরহামেশা বাল্য বিয়ে ঘটছে।

আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট, অজ্ঞতা, বেশি সন্তানের জন্ম দেয়া, আর্থিক দৈন্য, সামাজিক বিশৃঙ্খলা এড়াতে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের বাল্যবিবাহ দেন। এর সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে ‘কোভিড-১৯’। এবং সমাজে চলমান ধর্ষণ, খুন। অভিভাবকেরা কোনোভাবেই তাদের সন্তানদের নিয়ে নিরাপদে জীনবযাপন করতে পারছেন না। কন্যা-সন্তানটির বয়স ৫/৬ বছর হলেই বাবা-মায়েরা চিন্তিত হয়ে পড়ছেন। তারা ভাবছেন সন্তানের নিরাপত্তা কি তারা দিতে পারবেন? অনেক সন্তানের মা-বাবারা উচ্চশিক্ষিত, কিন্তু তাদের চিন্তাধারা হচ্ছে কন্যা-সন্তানটি কোনমতে এসএসসি পাশ করলেই বিয়ে দিয়ে দেবেন। পরবর্তীতে স্বামী সংসারে গিয়ে লেখাপড়া করবে। তার নিরাপত্তার দায়িত্ব স্বামীর ওপর বর্তাবে। আসলে কি তাই?

আমাদের মেয়েরা কি সত্যিই নিরাপদ? যদি তাই হয় তাহলে সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে বেঁধে রেখে কীভাবে তার স্ত্রীকে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় ধর্ষণ-নির্যাতন করা হয়? নোয়াখালীতে গৃহবধূকে অস্ত্রের মুখে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে দেয়া হয়? বাস্তবতা হলো আমাদের কন্যা-সন্তানেরা শহর কিংবা গ্রামে কোন জায়গায় নিরাপদ নয়।

বর্তমানে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, এর থেকে উত্তরণের পথ আমাদের জানা নেই। তাছাড়া প্রযুক্তিক দিক দিয়ে আমরা যতটাই এগিয়েছি ততটাই পিছিয়েছি নৈতিকতার দিক থেকে। আমাদের নৈতিকতার এই অধঃপতন জাতির জন্য অশনি সংকেত। কোভিড-১৯ আমাদের আর্থিক খাতের ব্যাপক ধ্বস্ধসঢ়; নামিয়েছে। বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত যারা আছেন, তারা সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন। এহেন অনেক পবিরার তাদের ১৪/১৫ বয়সী কন্যা-সন্তানকে অভাবে এবং সামাজিক অনাচারের হাত থেকে বাঁচাতে গোপনে বিয়ে দিয়েছেন।

কোন খারাপ পরিস্থিতিতে পড়লে বেশিরভাগ বলি হয় মেয়েরা, তা সহজেই বোধগম্য। অথচ আমরা নারী অধিকারের কথা বলি। নারী জাগরণের কথা বলি। বেগম রোকেয়া প্রায় দেড়শ’ বছর আগে নারীদের উন্নয়নের কথা বলে গেছেন। তিনি তার পুরোজীবন নারীর উন্নত জীবনযাত্রা ও শিক্ষার উন্নয়নে ব্যয় করে গেছেন। তার পরবর্তীতে অনেক মহিয়ষী নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন এবং নারীর মৌলিক উন্নয়নের কথা বলে গেছেন। কিন্তু এর বাস্তবিক ফল কি হল? যেখানে মেয়েদের সম্ভ্রমের নিরাপত্তা নেই, সেখানে উন্নত জীবন এবং শিক্ষার কী মূল্য থাকলো। আমাদের সমাজ এবং সমাজের মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। রাষ্ট্রের প্রদত্ত আইনগুলোর কঠোর প্রয়োগ হতে হবে। প্রতিটি বাবা-মাকে সন্তানকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। তাহলে হয়ত একটা সময়ে আমরা আমাদের সন্তানদের সুখী, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা দিতে পারবো।

লেখক: নারগিস সুলতানা প্রাবন্ধিক, পরিবেশ ও মানবাধিকারকর্মী।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট