নারায়ণগঞ্জের সানারপাড়ে ইসলামী ব্যাংকের একটি এজেন্ট ব্যাংক আউটলেটের সামনে জটলা পাকিয়ে অবস্থান করছিলেন জনাদশেক গ্রাহক। তারা সকলেই সানারপাড়ে ইসলামী ব্যাংকের এজেন্টের কাছে টাকা জমা রেখেছিলেন।
সপ্তাহখানেক আগে তারা জানতে পারেন, এজেন্ট ব্যাংকের ইনচার্জ গ্রাহকের জমা রাখা টাকা নিয়ে পালিয়েছেন।
যারা প্রতারণার অভিযোগ করছেন, তাদেরই একজন শারমীন আক্তার। ইতালি প্রবাসী স্বামীর ২২ লাখ টাকা জমা রেখে পুরোটাই খুইয়েছেন তিনি। টাকা জমার বিপরীতে যে কাগজ পেয়েছেন তার সবটাই জাল।
শারমীন বলছেন, তিনি কয়েকমাস আগে এজেন্টের কাছে একাউন্ট খুলেছিলেন। তারপর ১৫ লাখ টাকা টার্ম ডিপোজিট করেন।
“এজেন্ট আমাকে ডিপোজিটের একটা রিসিট দেয়। তখন তো জানতাম না যে এটা নকল। এখন শুনলাম যে এটা নকল। আমার মতো আরো অনেককেই নকল কাগজ দিয়ে টাকা নিজের পকেটে নিয়ে গেছে।”
শারমীনের দাবি, ১৫ লাখ টাকার বাইরে তার একাউন্টে প্রবাসী স্বামীর পাঠানো সাত লাখ টাকা ছিল, সেখান থেকেও এজেন্ট আউটলেটের ইনচার্জ কৌশলে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে টাকা তুলে নিয়েছে।
“আমার স্বামী রেমিটেন্স পাঠায়, কিন্তু মোবাইলে এসএমএস আসে না। আমি ব্যাংকে গেলাম। এজেন্টের লোক বলে যে এসএমএস পাবেন, সার্ভারে সমস্যা। আপনাকে এসএমএস এর জন্য নতুন করে আবেদন করতে হবে। এই বলে সে আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয়। কিন্তু সেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে সে আমার টাকা তুলে নিয়েছে।”
বাংলাদেশে প্রান্তিক পর্যায়ে ব্যাংকিং সেবা পৌছে দিতে প্রায় এক দশক আগে চালু হয়েছিল এজেন্ট ব্যাংকিং। যেখানে টাকা তোলা, জমা দেওয়া থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের মতো কার্যক্রম পরিচালিত হয় স্বল্প খরচে।
তবে এসব এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে লেনদেন করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন গ্রাহকদের অনেকেই। এসব অভিযোগ দিনকে দিন জোরালো হচ্ছে।
এজেন্ট ব্যাংকগুলোতে কিভাবে ঘটছে প্রতারণার ঘটনা? আর প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা টাকা ফেরত পাবে কিভাবে?
ভূক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা কী ?
নারায়ণগঞ্জের সানারপাড়ে ভূক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানকার ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট শাখায় প্রতারণার শিকার হয়েছেন অন্তত ২০ জন। টাকার পরিমাণ চার কোটি টাকারও বেশি।
ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকেই অফিস তালা দিয়ে পালিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। আর যিনি এজেন্ট তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
কিন্তু টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুক্তভোগীরা। কারণ এজেন্ট যাকে ইনচার্জের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
অন্যদিকে তারা যে টাকা জমা রেখেছিলেন, তার কোন বৈধ কাগজ নেই। কেউ কেউ পূর্ব সম্পর্কের কারণে টাকা জমা দিয়েও রিসিট নেননি। অথবা মোবাইলে যে ব্যাংকের পক্ষ থেকে এসএমএস আসছে না, বরং ব্যক্তিগত নাম্বার থেকে এসএমএস আসছে সেটাকেও তারা সন্দেহের চোখে দেখেননি। এখন ব্যাংকের কাছে গেলে ব্যাংক বলছে, তারা যে নিয়মকানুন মেনে টাকা জমা রাখেননি এর দায় ব্যাংকের নয়।
মুরশেদা বেগম নামে একজন বলছিলেন, “মেইন ব্রাঞ্চে গিয়েছিলাম। উনারা কোন পাত্তাই দিচ্ছে না। উনারা বলছেন, কাগজ ছাড়া টাকা জমা রাখছেন কেন? বুঝে-শুনে টাকা কেন রাখেন নাই?”
মুরশেদা বেগম প্রশ্ন তোলেন, “কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এখানে ব্যাংকের এজেন্ট করার জন্য উনারাই তো অনুমতি দিয়েছে। তাহলে উনারা কেন দেখেন নাই এসব ব্যাপার?”
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মুখপাত্র নজরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, ব্যাংক সিস্টেমের বাইরে গিয়ে কোন গ্রাহক যদি ব্যক্তিগতভাবে এজেন্ট বা তার কর্মচারীর সঙ্গে লেনদেন করে, তাহলে তার দায় গ্রাহকের। তবে গ্রাহক যেন টাকা ফেরত পায় সে বিষয়ে গ্রাহককে আইনী সহায়তা দেয়া হয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে।
টাকা ফেরতের দায় কার?
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংকিংয়ের নিয়ম মেনে টাকা জমা রাখলে তখনি শুধু ব্যাংক এর দায় নেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, অনেক গ্রাহক সচেতনভাবে এজেন্ট ব্যাংকিং করছেন না। অর্থাৎ তিনি হয়তো এজেন্ট শাখায় গিয়ে টাকা জমা দিলেন, কিন্তু এজেন্টের কাছ থেকে রিসিট জমা নিলেন না।
এসব ক্ষেত্রে প্রতারণা ঘটলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী এর দায় ব্যাংকের উপর বর্তায় না।
মি. হক বলেন, “সবসময় গ্রাহকদের বলা হয়েছে যে আপানি যদি কোন ব্যাংকের এজেন্টের সঙ্গে ব্যাংকিং করেন, তাহলে সবসময় সিস্টেম জেনারেটেড রিসিট নেবেন। এজেন্ট টাকা নিয়েছে এবং ব্যাংকের সিস্টেম থেকে রিসিট দিয়েছে, এইরকম ঘটনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব ব্যাংকের। ব্যাংক টাকা ফেরত দিতে বাধ্য।
“কিন্তু আপনি যদি বৈধ কোন ডকুমেন্ট ছাড়া লেনদেন করে থাকেন, সেক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাংক নির্ধারণ করতে পারবে না যে এই লেনদেনটি হয়েছে নাকি হয়নি। এক্ষেত্রে গ্রাহককে আইনের আশ্রয়ে যেতে হবে,” বলেন মি. হক।
ব্যাংকগুলো যে জালিয়াতি ঠেকাতে এজেন্টদের উপর কার্যকর নজরদারি করতে পারছে না এখন সেটাও উঠে আসছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এটাকে নজরদারির দুর্বলতা হিসেবে দেখতে নারাজ।
মেজবাউল হক বলছেন, কিভাবে নজরদারি হবে, এজেন্ট কাকে নিয়োগ দেয়া যাবে, সিকিউরিটি মানি কত রাখা হবে এর সবকিছুই নীতিমালায় বলা আছে।
“মনিটরিং কিন্তু একটা পর্যায় পর্যন্ত আছে। আপনি যদি শতকরা হার দেখেন, তাহলে এরকম প্রতারণার ঘটনা খুবই কম। এখানে ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই নীতিমালা মেনে সচেতন হতে হবে একই সঙ্গে এখানে গ্রাহককেও সচেতন হতে হবে।”
বাংলাদেশে প্রান্তিক পর্যায়ে ব্যাংকিং সেবা পৌছাতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের যাত্রা শুরু ২০১৩ সালে। বিভিন্ন ব্যাংকের এমন আউটলেটের সংখ্যা এখন ২১ হাজার। যেগুলোর মাধ্যমে বাংকিং ব্যবস্থায় ডিপোজিট এসেছে ৩৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
তবে এই খাতে গত ১০ বছরে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে ৩০টি আউটলেটে। তবে আউটলেট কম হলেও প্রতিটি এজেন্ট শাখার বিপরীতে সর্বস্ব খুইয়েছেন বহু গ্রাহক।
বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে গ্রাহকদের আইনী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও বাস্তবতা হচ্ছে প্রতারণার মামলা করে টাকা ফেরত পাওয়া বেশ সময়সাপেক্ষ। গ্রাহকদের সংকটটা এখানেই।
সূত্র: বিবিসি
পূর্বকোণ/এএইচ