চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে

আবদুল্লাহ আল নোমান

২৬ মার্চ, ২০২১ | ৬:৪৫ অপরাহ্ণ

বৃটিশদের তাড়িয়ে শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে এক হাজার মাইল দূরত্বের দুই ভূখ- নিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছিল। এ রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে প্রথম শ্রেণির নাগরিক হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। জাতিরাষ্ট্র গঠিত হয় ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির সমন্বয়ে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি-কৃষ্টির উপরই আঘাত হানে। এ আঘাত সর্বতোভাবেই রাজনৈতিক। ফলে পূর্ব বাংলার মানুষের মনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্রমে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাইলে বাংলার আপামর ছাত্র-জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

ক্ষোভ-বিক্ষোভ আর ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মধ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়। অনেকের প্রাণের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু তাও মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছিলো-
বৃটিশদের তাড়িয়ে গড়া পাকিস্তানেও কোন ন্যায্যতা পূর্ব বাংলার মানুষ পাচ্ছে না। রাজনৈতিক কর্মী ছাড়াও সাধারণ জনগণের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হচ্ছিল। যার প্রতিফলন দেখা যায় ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে। ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ছয় দফা স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এলো ৭০ সালের নির্বাচন। সেই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সংখ্যা গরিষ্ঠ আসনে ভোটে জয়লাভ করেছিল আওয়ামীলীগ। কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা দিতে চায়নি। এতে পূর্ব বাংলার মানুষ আরো বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
আমরা মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে বাম ধারার রাজনীতির অনুসারী হিসেবে ভিতরে ভিতরে স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য প্রস্ততি নিচ্ছিলাম। সশস্ত্র সংগ্রামছাড়া স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়- এ আদর্শকে সামনে রেখে মার্চ মাসে আমরা স্বাধীন জনগণ তান্ত্রিকপূর্ব বাংলার কর্মসূচি দিই। আমাদের লক্ষ্য ছিল আন্দোলনকে ধীরে ধীরে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে নিয়ে যাওয়া। আমাদের কর্মী ও নেতৃত্বকে সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তুলি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, তৎকালীন সামরিক সরকার এ সংবাদ পেয়ে আমাকে ৭ বছরের সশ্রম কারাদ-, দশ বেত্রাঘাত এবং আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে।
৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এলো মুক্তিযুদ্ধ। তখন ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপের সঙ্গে জড়িত ছিলাম আমি। যুদ্ধের প্রথমদিকে চট্টগ্রাম থেকে প্রশিক্ষণের জন্য এবং নিরাপত্তার স্বার্থে অনেককে ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্প ও আশ্রয় শিবিরে পাঠানোর কাজ করেছি।
১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-বুদ্ধিজীবীদের আশ্রয় ও পরামর্শস্থল ছিল রাউজানের নূতন চন্দ্রের কু-েশ্বরী কমপ্লেক্স। আমাদের গ্রামের বাড়ির পাশে এই কমপ্লেক্স। তৎকালীন অনেক রাজনীতিকেরই যাতায়াত ছিল সেখানে। পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে আসা ইপিআর সদস্যদের খাদ্য সরবরাহ ও যুদ্ধ প্রস্তুতিতে সহযোগিতা দেন নূতন চন্দ্রের ছেলে প্রয়াত সত্য রঞ্জন সিংহ ও প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ। এ বাড়িতে বসেই ডা. আবু জাফর, ড. এ আর মল্লিক (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য), অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল ওয়াহাবসহ অনেকে মুক্তিসংগ্রামের প্রস্তুতি ও কলাকৌশল নিয়ে আলাপ-আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত নিতেন।
পাকিস্তানি সেনারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছালে ৩১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ২৮টি পরিবারের সদস্যরা কু-েশ্বরী বালিকা বিদ্যা মন্দিরের বিভিন্ন কক্ষে আশ্রয় নেন এবং ৭ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান, ড. মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক ফজলে হোসেন, ড. রশিদুল হক, ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী প্রমুখ। এছাড়া এসেছিলেন মাহবুব তালুকদার, এম এ হান্নানসহ অনেকে। আমার মনে হচ্ছিল পাক আর্মি কু-েশ্বরী কমপ্লেক্সে আঘাত করতে পারে। তাই ৭১ সালের ১২ এপ্রিল একটি গাড়ি নিয়ে ওই কমপ্লেক্সে গিয়ে নূতন চন্দ্র সিংহকে বললাম, কাকা, আপনার নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া উচিৎ। পরিবারসহ আমার সঙ্গে চলুন; কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। বললেন, ‘আমি এখান থেকে যাব না। তুমি আমার পরিবারের অন্যদের নিয়ে যাও।’আমি বললাম, আমি ব্যবস্থা করে এসেছি। আপনিও চলুন। কিন্তু তিনি গেলেন না। বললেন, ‘আমি বাংলাদেশেই থাকবো। ভারতে যাবনা। মরলে এখানেই মরবো’। আমি তার পরিবারের অন্যদের নিয়ে গাড়িতে ফটিকছড়ি হয়ে রামগড় থেকে ভারতের ত্রিপুরার সাব্রুমের দিকে যাত্রা করলাম। পরে শুনলাম, পরদিন ১৩ এপ্রিল নূতন চন্দ্র সিংহকে পাকহানাদার বাহিনী হত্যা করেছে। গহিরায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে পাকবাহিনী আগুন লাগিয়েছে। নূতন চন্দ্র সিংহকে বাঁচাতে না পারাটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার জন্য অত্যন্ত বেদনার।

জিয়া এবং মার্চ মাস
২৫ মার্চ রাতে পাকহানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর বর্বর আক্রমণ শুরু করলো। ২৬ মার্চ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, তখনকার অষ্টম বেঙ্গলে সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজরজিয়া, রাত বারটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে ‘উই রিভোল্ট’ বলে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। সে সময় তিনি চেষ্টা করলেন লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী ও মেজর রফিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে, কিন্তু পারলেন না। ২৬ মার্চ মেজর জিয়া চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে চট্টগ্রাম শহর অভিমুখে যাত্রা করলেন। আওয়ামীলীগ নেতা এম আর সিদ্দিকীসহ আরো কয়েকজনকে তিনি চট্টগ্রামের একটি বাসায় পেলেন। যে জায়গায় জিয়া আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে আলোচনা করেছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, আপনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু অনেকেই এখানে ভুল ব্যাখ্যা দিতে পারে। সামরিক বাহিনীর একজন মেজর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করলো। রাজনৈতিক নেতৃত্ব কোথায়? এখানে একটা সংশয় সৃষ্টি হতে পারে। আওয়ামীলীগ নেতারা জিয়াউর রহমানকে পরামর্শ দিলেন, আপনি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিন আবার। কর্নেল শওকতের ভাষায়, তখন জিয়া বললেন, আমার তো কোন আপত্তি নেই। কে করবেন এই দায়িত্ব পালন? দায়িত্ব পালনে কেউ সরাসরি নাম ধরে ঘোষণা দিতে চাইলেন না। তখন সবাই আবার সিদ্ধান্ত নিল। অন বিহাফ অফ শেখ মুজিবুর রহমান বলে আপনিই আবার স্বাধীনতার ঘোষণা দিন। তখন সবার সম্মতিক্রমে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ‘আই, অন বিহাফ অফ শেখ মুজিবুর রহমান’ বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন।
অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা নিয়ে এখন অনেক কথা বলা হচ্ছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া সম্পর্কে অনেক কটূক্তি করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। যুদ্ধে তার ভূমিকা ও অবদান অস্বীকার করার চেষ্টা দৃশ্যমান। এখন আবার জিয়াউর রহমানের বীর উত্তম উপাধি বাতিলের চেষ্টাও শুরু হয়েছে।
কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা বার্তা বা ঐতিহাসিক বক্তব্য, যা এখন আওয়ামী লীগের নেতারা একমাত্র ‘ঘোষণা’ দাবি করছেন, সেই বক্তব্যের সাথে মেজর জিয়া-কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্যে সাংঘর্ষিক কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান (৭১ সালের মেজরজিয়া) ‘উই রিভোল্ট’ বলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন। পরে অন বিহাফ অফ শেখ মুজিবুর রহমান বলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এখানে রাজনৈতিকভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বকে জিয়া চ্যালেঞ্জ করেন নি। অথবা শেখ মুজিবুর রহমানও তার জীবদ্দশায় এ নিয়ে কিছু বলেন নি।
পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের সপ্তাহ খানেক পর জিয়াউর রহমানকে একজন সাংবাদিক কিছু কথা লেখার জন্য অনুরোধ জানান। জিয়া বলেছিলেন, ‘আমি একজন সৈনিক। আর লেখা একটি ঈশ্বর প্রদত্ত শিল্প। সৈনিকেরা স্বভাবতই সেই বিরল শিল্প ক্ষমতার অধিকারী হয় না। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ছিলো এমনই আবেগধর্মী যে আমাকেও তখন কিছু লিখতে হয়েছিলো। তখন কলম তুলে নিতে হয়েছিলো হাতে।’
পরে জিয়াউর রহমান আরও লিখেছিলেন, ‘চট্টগ্রামে আমরা ব্যস্ত ছিলাম অষ্টম ব্যাটালিয়নকে গড়ে তোলার কাজে। এটা ছিল রেজিমেন্টের তরুণতম ব্যাটালিয়ন। এটার ঘাঁটি ছিল ষোলশহর বাজারে। ’৭১-এর এপ্রিল মাসে এই ব্যাটালিয়নকে পাকিস্তানের খারিয়ানে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তাই অগ্রগামী দল হিসেবে আমাদের দু’শজন জোয়ানকে আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। বাকিরা ছিল একবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের সৈনিক। আমাদের তখন যে সব অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয়েছিল তার মধ্যে ছিল, তিনশ’ পুরনো ৩০৩-রাইফেল, চারটা এলএমজি ও দুটি তিন ইঞ্চি মর্টার। গোলাবারুদের পরিমাণও ছিল নগণ্য। আমাদের এন্টি-ট্যাংক বাভারী মেশিন গান ছিল না।’
‘ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠেছিল, তখন আমি একদিন খবর পেলাম তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিহারিদের বাড়িতে বাস করতে শুরু করেছে। খবর নিয়ে আমি আরো জানলাম, কমান্ডোরা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ নিয়ে বিহারিদের বাড়িগুলোতে জমা করেছে এবং রাতের অন্ধকারে বিপুল সংখ্যায় তরুণ বিহারিদের সামরিক ট্রেনিং দিচ্ছে। এসব কিছু দেখে এরা যে ভয়াবহ রকমের অশুভ একটা কিছু করবে তার সুস্পষ্ট আভাস আমরা পেলাম।’
‘এরপর এলো ১ মার্চ। সারাদেশে শুরু হলো ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন। এর পরদিন দাঙ্গা হলো। বিহারিরা হামলা করেছিল এক শান্তিপূর্ণ মিছিলে। এর থেকেই ব্যাপক গোলযোগের সূচনা হলো। এই সময়ে আমার ব্যাটালিয়নের এনজিওরা আমাকে জানাল, প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিংশতি তমবালুচ রেজিমেন্টের জওয়ানরা বেসামরিক পোশাক পরে বেসামরিক ট্রাকে করে কোথায় যেন যায়। তারা ফিরে আসে আবার শেষ রাতের দিকে। আমি উৎসুক হলাম। লোক লাগালাম খবর নিতে। খবর নিয়ে জানলাম প্রতিরাতেই তারা যায় কতগুলো নির্দিষ্ট বাঙালি পাড়ায়। নির্বিচারে হত্যা করে সেখানে বাঙালিদের। এই সময় প্রতিদিনই ছুরিকাহত বাঙালিদের হাসপাতালে ভর্তি হতেও শোনা যায়।’
‘এ সময় আমাদের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জানজুয়া আমার গতি বিধিরও পরলক্ষ্য রাখার জন্যও লোকলাগায়। মাঝেমাঝেই তার লোকেরা যেয়ে আমার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে শুরু করে। আমরা তখন আশঙ্কা করছিলাম, আমাদের হয়তো নিরস্ত্র করা হবে। আমি আমার মনোভাব দমন করে কাজ করে যাই এবং তাদের উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেয়ার সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা করি। এ সময় বাঙালি দোকানপাটে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ক্রমেই বাড়তে থাকে।’
‘আমাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করা হলে আমি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করব কর্নেল (তখন মেজর) শওকত আমার কাছে জানতে চান। ক্যাপ্টেন শমসের মবিন এবং মেজর খালেকুজ্জামান আমাকে জানান, স্বাধীনতার জন্য আমি যদি অস্ত্র তুলেনিই, তাহলে তারাও দেশের মুক্তির জন্য প্রাণ দিতে কুণ্ঠা বোধ করবেন না। ক্যাপ্টেন অলি আহমদ আমাদের মাঝে এসব খবর আদান-প্রদান করতেন। জেসিও এবং এনসিওরাও দলে দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে জমা হয়ে আমার কাছে আসতে থাকে। তারাও আমাকে জানায় যে কিছু একটানা করলে বাঙালি জাতি চিরদিনের জন্য দাসে পরিণত হবে। আমি নীরবে তাদের কথা শুনতাম। কিন্তু আমি ঠিক করেছিলাম উপযুক্ত সময় এলেই আমি মুখ খুলবো।’
‘সম্ভবত ৪ মার্চ আমি ক্যাপ্টেন অলি আহমদকে ডেকে নিই। সেটি ছিল আমাদের প্রথম বৈঠক। আমি সোজাসুজি বললাম, সশস্ত্র সংগ্রামের সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। ক্যাপ্টেন আহমদও আমার সাথে একমত হন। আমরা পরিকল্পনা তৈরি করি এবং প্রতিদিনই আলোচনা বৈঠকে মিলিত হতে শুরু করি। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙালি ও পাকিস্তানি সেনাদের মাঝেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠেছিল।’
জিয়ার চিন্তার ফসল হলো ‘উই রিভোল্ট’। জিয়া অনেক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তা না হলে তিনি ৭ মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের প্রতিক্রিয়া দিতেন না। ভাষণে জিয়া বলেছিলেন, ‘ভাষণ যখন শুনেছিলাম, তখন বুঝলাম নতুন দিগন্তে আমরা যাত্রা করছি’। এছাড়া জিয়া আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়েও সমালোচনা করেছেন। একে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর গর্হিত কাজ বলে অভিহিত করেছিলেন। জিয়া বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতনের হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়’।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ৭১ সালে সেনাবাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে তৎকালীন মেজর জিয়া সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ৭৫ সালের পট পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত এ নিয়ে কোন কথা বলেননি।
সেনানায়ক থেকে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে দেখলেন, দেশে গণতন্ত্র নেই। মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাপূরণে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে- এমনি এক পটভূমিতে তিনি তখন দেশের হাল ধরলেন। খালকাটা কর্মসূচি, উৎপাদনবৃদ্ধির রাজনীতি শুরুকরলেন। দেশে শিক্ষা ও শিল্প বিপ্লব করলেন। শিক্ষা বিস্তারে দেশে বয়স্ক শিক্ষা অর্থাৎ নৈশ বিদ্যালয় চালু করেছিলেন। গ্রামে গ্রামে নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করলেন জিয়াউর রহমান। দেশে শিল্পকল কারখানায় দুই শিফটের পরিবর্তে তিন শিফট চালু করলেন তিনি। খাদ্য উৎপাদনে বিরাট পদক্ষেপ নিলেন। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র, স্বাধীন স্বার্বভৌম ন্যায় বিচার ভিত্তিক জনকল্যাণমূলক একটি রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রে মানুষের ভোটের অধিকার থাকবে। নির্বাচনে মানুষ নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করবে। সেই সাথে সামাজিক ন্যায় বিচার ও মানবিকভাবে মানুষের মত বাঁচার অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। আজকে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে আমরা যদি পেছন ফিরে তাকাই, যতটুকু অর্জন করার কথাছিল তা আমরা অর্জন করতে পারিনি।
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমাদের আজও লড়াই করতে হচ্ছে। আমাদের মধ্যে মত পার্থক্য থাকবে। কিন্তু তা হিংসাত্মক হবেনা। ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। দিনের ভোট রাতে হবেনা- এই নিশ্চয়তা জনগণ পেলে দেশ গঠনে তারা মুক্তিযুদ্ধের মত শতশত মাইল হাঁটতে ও প্রস্তুত থাকবে। দেশ গঠনে এগিয়ে আসবে।
দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এমনটাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রত্যাশা করছি। আর তাহলেই কেবল ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মাহুতি সার্থক তা পাবে। শহীদের আত্মা শান্তি পাবে। মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের পরিবার-পরিজন স্বজন হারানোর বেদনা থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস-চেয়ারম্যান

পূর্বকোণ/মামুন

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট